কত শত জেলিফিস আর শামুক-ঝিনুক যে মরে পড়ে আছে। আহা! না জানি আবার কী হয়েছে সমুদ্রটার!
Published : 20 Aug 2023, 10:51 AM
ছোট্ট আমায়রা সোফার এক কোণে বসে বড় বোন মানহার ছোটবেলার হাড়িপাতিল দিয়ে খেলছে। মানহা তখন তাদের স্কুলের একটা প্রকল্প তৈরিতে ভীষণ ব্যস্ত। কিন্তু সব তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে! মানহার মাথায় তো কিছুই আসছে না!
ক্লাস টিচার প্রকৃতি থেকে শিক্ষণীয় একটা বিষয়ে সবাইকে প্রকল্প তৈরি করতে বলেছে। কিন্তু সে কিছুই পারছে না, তাই তার মনটাও খারাপ। অন্যদিকে বাসায় আমায়রা ও মানহার মাঝে যে সবচেয়ে সৃজনশীল সে তখন চুপচাপ ছবি আঁকতে ব্যস্ত। তার নাম মুনতাহা। বাসার সবাই ছোট্ট করে তাকে ‘মুন’ ডাকে। মুন তার ঘরে বসে হাত ঢেকে ঢেকে সমুদ্রের ছবি আঁকছে।
ওহ! তুমি কি তার ছবি দেখতে চাইছো? তার ছবি আঁকার মাঝে কেউ সেটা দেখে নিলেই সর্বনাশ! ব্যস! সেটাকে ছিঁড়ে কুটিকুটি করে একাকার করে দেয়। মুন নানা বিষয়ে সারাদিন ছবি আঁকে। কিন্তু সমুদ্র তার ভীষণ ভালো লাগে। তাই সমুদ্র নিয়েই বেশি ছবি আছে।
শেষ যেদিন পুরো পরিবারের সবাই মিলে সমুদ্র দেখতে গেল, মুন তখন কিছু বালি আর শামুক-ঝিনুক কুড়িয়ে এনেছে। তারপর সেইসব পড়ার টেবিলের কাছে বোতলে রেখে দিয়েছে। রোজ তার স্কুল থেকে এসে একবার এই বোতল দেখা চাই, যে তার বোতলে কেউ হাত দিল কিনা, কিংবা শামুক- ঝিনুক দু-একটা কমে গেল কিনা!
সারাদিন বাসাটাকে শোরগোলে মাথায় করে রাখা এই তিনজনই এখন নিজের মতো ব্যস্ত। তাই বাসা এখন কিছুটা শান্ত। অন্যদিকে তারা কেবল তখনই শান্ত থাকে যখন তাদের নানু তাদেরকে বিভিন্ন রকম গল্প শোনায়। সবাই তো ব্যস্ত, তাহলে নানু কোথায়? হুম। তাদের নানু তখন টেলিভিশনের রিমোট দিয়ে বিভিন্ন চ্যানেল পরিবর্তন করছে।
হঠাৎ একটা খবর শুনে নানু জোরে ডাকল সবাইকে। মুন আর মানহা তো হুড়মুড়িয়ে ড্রয়িংরুমে এসে হাজির। কী হয়েছে নানু? নানু তখন টিভির দিকে তাকিয়ে বলল, দেখ দেখ! হাজার হাজার মাছ মরে সমুদ্র থেকে ভেসে আসছে। কত শত জেলিফিস আর শামুক-ঝিনুক যে মরে পড়ে আছে। আহা! না জানি আবার কী হয়েছে সমুদ্রটার!
এ দৃশ্য দেখে মুনের চোখ তো ছলছল। তার তো আবার খুব মায়া! সে নানুকে জড়িয়ে ধরে বলল, নানু, কীভাবে ওরা মরে গেল? মানহাও তখন সোফার পেছনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে দেখছে। এত হাজার হাজার মাছ সমুদ্রতীরে ভেসে আসছে। শত শত মানুষ সে মাছ কুড়িয়ে বালতিতে ভরে নিয়ে যাচ্ছে। মুন তখন আবার জিজ্ঞেস করলো, বলো না নানু, কীভাবে মারা গেল ওরা?
নানু তখন আবার বলল, ওই যে প্লাস্টিক আছে না! হাজার হাজার প্লাস্টিক পানিতে মিশে গিয়েও পানি বিষাক্ত করে দেয়।
নানু তখন বলল, সমুদ্রে বড় বড় ঝড় এলে সব এলোমেলো হয়ে যায়। ঝড়ে অনেক প্রাণী মারা যায়। আবার যখন সমুদ্রে জাহাজ থেকে তেল পড়ে তখনও পানি বিষাক্ত হয়ে প্রাণী মারা যায়। আর সমুদ্রের নিচে যে শৈবাল আছে সেই শৈবাল যখন মারা যায় তখন জলজ প্রাণীরা ক্ষুধার্ত থাকে। না খেলে কেউ কি বাঁচে বল? মুন আর মানহা বলল, না নানু!
নানু তখন আবার বলল, ওই যে প্লাস্টিক আছে না! হাজার হাজার প্লাস্টিক পানিতে মিশে গিয়েও পানি বিষাক্ত করে দেয়। তাই আমি আসলে জানি না এরা কোন কারণে কীভাবে মারা গেছে! এতক্ষণে মানহা বলে উঠল, তাহলে নানু, আমাদের কি কিছু করার নেই? আমরা কি কিছু করতে পারি না ওদের জন্য?
নানু তখন বলল, হ্যাঁ পারি। তোমরা যে ছাদবাগানে গাছ রোপণ করো, এরকম সব জায়গায় এখন থেকে গাছ রোপণ করতে হবে। তাতে পৃথিবীতে কার্বন ডাই-অক্সাইড কমবে। আর এতে করে প্রকৃতিতে ঝড়-বৃষ্টি কম হবে। আর যেখানে সেখানে ময়লা ফেলা যাবে না। এসব ময়লা প্লাস্টিক সামুদ্রিক পাখিরা, অবুঝ প্রাণীরা তো না বুঝে খেয়ে ফেলে। তাই তোমরা-আমরা সচেতন হলে সামুদ্রিক প্রাণীদের রক্ষা করা যাবে। এরা তো আমাদের পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষা করে, তাই না! তাই ওরা না বাঁচলে তো, আমরাও বাঁচব না!
সব কথা শুনে মানহা বলল, ইউরেকা! নানু, আমি প্রকল্পের বিষয় পেয়ে গেছি। আমি এক্ষুণি সমুদ্র ও তার প্রাণীদের নিয়ে লিখব। এ কথা বলেই সে এক দৌড়ে চলে গেল। কিন্তু মুনের চোখ তো তখনও ছলছল। সে শুধু টিভির স্ক্রিনের দিকেই তাকিয়ে আছে। যদিও খবর অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। হঠাৎ তখন আমায়রা এসে হাত মুখে বালি নিয়ে ছোট্ট দুই হাতে মুনকে আধভাঙা শব্দে কিছু একটা দিয়ে বলল, আপুপুপু ... তিনুক নাও। তিনুক!
ব্যস! মুনের আর বুঝতে বাকি রইল না যে তার ছোটবোন তার বোতলটা ফেলেই ঝিনুকগুলোকে কুড়িয়ে এনেছে। এবার তো মুন ঝরঝর করেই কেঁদে ফেললো। নানু তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, কিচ্ছু হয়নি। চলতো আমরা দেখে আসি আমায়রা সোনা আর কোথায় কোথায় ঝিনুকগুলো রেখেছে!
এই বলে মুনকে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সে আরও বলল, তুমি যদি সমুদ্রের ওই প্রাণিগুলোকে বাঁচাতে চাও তাহলে এখন একটা গাছ রোপনের ছবি আঁকবে ও ছবিতে এটাও আঁকবে যে ময়লা এখানে সেখানে না ফেলে সঠিক জায়গায় ফেলতে হবে। তুমি কি জানো, তোমার এমন একটা ছবি সবাইকে আরও সচেতন করতে পারে? তখন এমন করে মাছ, শামুক ঝিনুক আর মরবে না। তাহলে চলতো তুমি আর আমি মিলে একটা ছবি আঁকি। আর হ্যাঁ এই ছবিটা কিন্তু ছিঁড়ে ফেলা যাবে না কেমন!
এবার মুনের ঠোঁটের কোণে একটু হাসির দেখা মিলল।