সাম্পানের সামনের দিকটা বাঁকানো চাঁদের মতো, যাতে সমুদ্রের ঢেউ কেটে সামনের দিকে যেতে পারে।
Published : 09 May 2024, 01:38 PM
‘সাম্পান, হুনি (শুঁটকি), দরগা- এ নিয়ে চাটগাঁ’, এমন একটি প্রবাদ প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামে প্রচলিত আছে। ‘সাম্পান’ নামের জলের গাড়িটি চট্টগ্রামের নামের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত আছে। এই জলের গাড়ি ‘কেঁ..কুরুত... কেঁ...কুরুত’ শব্দ করতে করতে চট্টগ্রামের খাল-বিল-নদী-নালার বুক চিরে ছুটে চলেছে শতাধিক বছর ধরে।
চট্টগ্রাম আরাকান রাজাদের অধীনে আসার পর থেকে এখানে নৌ-চলাচল শুরু হয়। তখন নৌকা ব্যবহার হতো যুদ্ধ বাহন হিসেবে। ইতিহাসে আছে, আরাকান রাজাদের মতো শক্তিশালী নৌ-বল ভারতবর্ষে অন্য কারো ছিল না। পর্তুগিজ জলদস্যুরা বাংলায় ডাকাতির প্রয়োজনে নৌকার ব্যবহার করত। বাংলার জলপথ রক্ষার জন্য যুদ্ধ-নৌকা রাখার নিয়ম ছিল।
নৌকার আদি নাম ছিল ‘নওয়ারা’। চট্টগ্রামের মানুষ নৌকাকে সাম্পান এবং সাম্পানকে নৌকা বলে। নদীবেষ্টিত বাংলার নিরাপত্তার স্বার্থে এ জনপদে প্রথম নৌকা তৈরির কাজ শুরু করেছিলেন সপ্তদশ শতকের শেষভাগে নবাব শায়েস্তা খাঁ। তিনি প্রথমবার ৩০০ নৌকা তৈরি করিয়েছিলেন। তখনও পর্যন্ত সাম্পানের ধারণা এ জনপদের মানুষের মধ্যে আসেনি। সাম্পান তৈরির চিন্তা চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের মধ্যে আসে আরও পরে। চট্টগ্রামের অনেক ব্যবসায়ীর চাঁদ সওদাগরের মতো বাণিজ্যে যাত্রা করার জন্য নিজস্ব জাহাজ ছিল। চট্টগ্রামে সেসব জাহাজ তৈরি হতো।
চট্টগ্রামের গোসালডেঙ্গা, হালিশহরের হিন্দু বালামী ও বাহারূয়ারা এসব জাহাজ তৈরির প্রধান কারিগর ছিলেন। তারা রেঙ্গুন (মিয়ানমারের সাবেক রাজধানী) গিয়ে প্রথম সাম্পান দেখতে পান। পালতোলা সাম্পান জাহাজের মতো দ্রুতগতিতে চলত বলেই চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা এর প্রতি আকৃষ্ট হন। তারা জাহাজের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারের জন্য এই সাম্পান চট্টগ্রামে নিয়ে আসেন। বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের পর চট্টগ্রামে জাহাজের কদর ধীরে ধীরে কমে যায়।
চৌধূরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি লিখেছেন, ‘...মুসলমান কারিগরগণ সাম্পান প্রস্তুত করে। পুরাকালে এদেশে সাম্পানের ব্যবহার ছিল না; প্রথমতঃ রেঙ্গুন হইতেই ইহার আমদানী হয়। এখন ইহা এদেশে বহুল পরিমাণে ব্যবহৃত হইতেছে। এবং প্রতি বৎসর ছোট বড় শত শত সাম্পান প্রস্তুত হয়। এ দেশীয় সাম্পানওয়ালারা ঐ সকল সাম্পানে করিয়া আকিয়াব, রেঙ্গুন, সুন্দীপ প্রভৃতি স্থানে গমনাগমন করে। পালসহযোগে ইহা স্টিমারের ন্যায় খুব বেগে চলে। পাল তুলিয়া পবন ভরে সাম্পান বহর যখন কর্ণফুলী নদী বাহিয়া সারি সারি চলিতে থাকে তখন দূর হইতে ইহার দৃশ্য বড় নয়ন মনমুগ্ধকর। বর্তমানে এত বড় বড় সাম্পানও তৈয়ার হয় যে তাহার এক একটীতে ২০০০ আড়ি ও ততোধিক ধানের বোঝাই করিতে পারা যায়।’
সাম্পানের ‘কেঁ..কুরুত... কেঁ...কুরুত’ শব্দটা হালিশ চালানোর সময় ককিয়ে ওঠার শব্দ। সাম্পানের পেছনের দিকে দুই পাশে দুটি খুঁটি আটকানো থাকে। সেই খুঁটি দুটির সঙ্গে বেতের আংটা দিয়ে হালিশকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়। মাঝি দাঁড়িয়ে একটু সামনের দিকে ঝুঁকে দুই হাতে হালিশে চাপ দিলে বেত আর কাঠের সংঘর্ষে ‘কেঁ..কুরুত... কেঁ...কুরুত’ শব্দের সৃষ্টি হয়। এ শব্দটি চট্টগ্রামের সাম্পানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ছোট বড় নানা মাপের সব সাম্পানে মাস্তুল থাকে। মাস্তুলে নানান রঙের পাল খাটানো হয়। কখনো কখনো আরও একটা ছোট তিনকোণা পাল ছোট খুঁটিতে খাটানো হয়। পালে হাওয়া লাগলে সাম্পান দ্রুতগতিতে ছুটে। লম্বা দাঁড়কে ‘হালিশ’ বলে। দাঁড়ের হাতলকে বলে ‘পইর’। দু’পায়ের ফাঁকে হাঁটু বরাবর আবদ্ধ থাকে ‘হাইল’। হাইলকে কক্সবাজারে বলা হয় ‘সুপন’। সাম্পানের দিক ঘোরানোর জন্য সেটি পা দিয়েই ঘোরানো হয়। সাম্পানে সর লাগানো হলে তা বেশ জোরে চলে।
সাম্পান শব্দটা এসেছে চীনা শব্দ ‘সাং পাং’ থেকে। এর অর্থ হচ্ছে তিন মাথা। সাধারণত নৌকা বা অন্যান্য নৌ-যানের দুটো মাথা বা গলুই থাকে। সাম্পানে গলুই থাকে তিনটি। সামনে একটা, পেছনে দুটো। পেছনের গলুই দুটো মেষের শিংয়ের মতো দু’ভাগে বিভক্ত। এ কারণেই এর নামকরণ করেছে সাম্পান। আরাকানি ভাষায় সাম্পানকে বলে ‘থাম্মান’। জাপানিরা বলে ‘জুমপেন’। মালয় ভাষায় বলে ‘সামপেন’। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ‘সাম্মান’।
কারো কারো মতে, সাম্পান একটি ক্যান্টনিজ শব্দ। এ ভাষায় ‘সাম’ অর্থ তিন এবং ‘পান’ র্অথ কাঠের টুকরো। এ থেকে সাম্পান নামের উদ্ভব। এর আভিধানিক অর্থ ‘তিন টুকরো কাঠ’। একটি সম্পূর্ণ কাঠের টুকরো দিয়ে চ্যাপ্টা তল, তার দুই পাশে আস্ত আরো দুটি টুকরো জোড়া দিয়ে চীনা সাম্পানের কাঠামো তৈরি হয়। কিন্তু চট্টগ্রামের সাম্পান আস্ত কাঠের টুকরো দিয়ে তৈরি হয় না। তাতে ব্যবহৃত হয় কাঠের সরু ফালি। চট্টগ্রামের সাম্পানের কিছু উপাদানের নকশা চীনা সাম্পানের মতো।
সাম্পানের গঠন ও নির্মাণশৈলী অন্যসব নৌকার চেয়ে ভিন্ন। সাম্পানের সামনের দিকটা বাঁকানো চাঁদের মতো, যাতে সমুদ্রের ঢেউ কেটে সামনের দিকে যেতে পারে। পেছনের দিকটা একরকম সোজা বলা যায়। দেখতে অনেকটা হাঁসের মতো। বাংলাদেশে দুই ধরনের সাম্পান আছে। সমুদ্র উপকূলের আশপাশে চলার জন্য ছোট সাম্পান আর সমুদ্রে চলাচলের জন্য বড় সাম্পান। এসব সাম্পান দৈর্ঘ্যে ৬ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত হয়। মাছ ধরার সাম্পানের দৈর্ঘ্য প্রায় ২৭ ফুট, প্রস্থ ৯ ফুট।
দীনেশচন্দ্র সেন তার ‘বৃহৎবঙ্গ’ বইতে সাম্পান সম্পর্কে লিখেছেন, ‘দেখতে এটি হাঁসের মতো। এটি তৈরি হয়েছে চীন দেশের নৌকার আদলে।’ বইলাম, চাপালিশ, গামারি ও গর্জন ইত্যাদি কাঠ দিয়ে চট্টগ্রামের কারিগররা সাম্পানগুলো তৈরি করতেন। মিয়ানমার ও কক্সবাজারের টেকনাফের বেশিরভাগ সাম্পান ছিল সেগুন কাঠের তৈরি। এসব সাম্পানে করে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা শুধু বাণিজ্যে যেতেন না, একস্থান থেকে অন্যস্থানে যাতায়াত এবং নদীতে বা গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন।
সাম্পান ও সাম্পান মাঝি নিয়ে জীবনকথা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলার শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতিতে স্থান করে নিয়েছে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক লোকসঙ্গীতে সাম্পান ও সাম্পান মাঝি একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। ‘অস্তিত্বের দূরতম দ্বীপে এই দুঃসহ নির্জনে/ কেবল তোমার জন্যে বসে আছি উন্মুখ আগ্রহে/ সুন্দর সাম্পানে চড়ে মাধবী এসেই বলে- যাই। ‘মাধবী এসে বলে: যাই’ শিরোনামে রফিক আজাদের এই কবিতার মতো অসংখ্য কবিতা, গল্প ও উপন্যাসের চিত্রকল্পে সাম্পানের উল্লেখ রয়েছে।
সাম্পান আর সাম্পানওয়ালার কথা আছে এমন আঞ্চলিক গানের সংখ্যাও কম নয়। এসব গানে প্রেম, বিরহ প্রকাশের সময়ে সাম্পান ও সাম্পান মাঝির দেখা পাওয়া যায়। কর্ণফুলী নদী ছিল বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ভ্রমণের প্রিয় একটি স্থান। তিনি স্থানীয় যুবকদের নিয়ে কর্ণফুলী নদীতে সাম্পানে চড়ে নৌবিহার করতেন। ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে ‘কর্ণফুলী’ নামের কবিতায় নজরুল সাম্পানের কথা উল্লেখ করেছেন।
সাহিত্যিক আলাউদ্দিন আল আজাদ ১৯৬২ সালে লিখেছেন ‘কর্ণফুলী’ নামে উপন্যাস। তার আগে ১৯৪৬ সালে কবি ওহীদুল আলম ‘কর্ণফুলীর মাঝি’ নামে একটি কাহিনিকাব্য লিখেছিলেন। এখানেও সাম্পান ও সাম্পান মাঝির কথা উল্লেখ আছে। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯০৭ সালের ১৭ জুন চট্টগ্রাম এসে পরদিন গিয়েছিলেন কর্ণফুলী নদী দেখতে। কবি মাঝি-মাল্লা আর খালাসিদের সঙ্গে কথা বলে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় কর্ণফুলীর রূপ দেখে লিখেছিলেন, ‘যতবার চোখ মেলে তাকাই ততবার বিধাতাকে ধন্যবাদ জানাই।’ আশুতোষ চৌধুরীর সংগৃহীত প্রায় তিনশ বছর পুরোনো ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকার’ (চতুর্থ খণ্ড, দ্বিতীয় সংখ্যা) ‘নসর মালুম’-এ সাম্পান মাঝির কথা আছে।
বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত শিল্পী কল্যাণী ঘোষ তার ‘চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান’ বইয়ে লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের দীর্ঘদিনের ঐতিহ্যের সঙ্গে সাম্পান ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। উল্লেখ্য, চীন সাগরের উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরের উপকূল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলের এই বিশেষ ধরনের নৌকার বড় বৈশিষ্ট্য হলো ঝড়-ঝঞ্ঝার মধ্যেও ডোবে না। সাম্পানের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কারণে সাম্পানের ওপর ভিত্তি করে চট্টগ্রামের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোগ্রামও তৈরি হয়েছে।’ বিশ্ববিদ্যালয়টির ধূসর রঙের লোগোটি শিল্পী কামরুল হাসান এঁকেছেন সাম্পানের আদলে, এতে সাম্পানের সামনের দিকটা অনুকরণ করা হয়েছে। ধূসর রঙেও সাম্পানের রঙের প্রভাব কাজ করেছে।
তথ্যসূত্র
১. চৌধূরী শ্রীপূর্ণচন্দ্র দেববর্ম্মা তত্ত্বনিধি: চট্টগ্রামের ইতিহাস।
২. কল্যাণী ঘোষ: চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান।
৩. নিতাই সেন: চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ নজরুল ও অন্নদাশঙ্কর।
৪. নাসির উদ্দিন হায়দার: ওরে কর্ণফুলীরে সাক্ষী রাখিলাম তোরে...।
৫. কাজী নজরুল ইসলাম: চক্রবাক।
৬. দীনেশচন্দ্র সেন: বৃহৎবঙ্গ।
৭. দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’।