সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। শরণখোলা থানার ওসি ও ডিউটি অফিসার দুজন সুন্দরবনের মানচিত্র সামনে নিয়ে চার কিশোরকে উদ্ধারের পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন।
Published : 15 Apr 2025, 10:44 AM
কথা শেষ করার আগেই ডিউটি অফিসারের রুমে সে পুলিশ কনস্টেবলের ডাক পড়ে। ‘দেখি কী করা যায়’ বলে বসিয়ে রেখে সেই যে তিনি গেছেন, তারই আর কোনো দেখা নেই। শিশির মামা বসেই আছেন। এদিকে ইমরানের বাবা ও অন্যরা এখনও এসে পৌঁছাতে পারেননি। শিশির মামা যখনই জিজ্ঞেস করছেন তখনই বলছেন, ‘এই তো আমরা এসে পড়ছি, আর বেশিক্ষণ লাগবে না। তুই কী ওসি সাবরে ঘটনা খুলে বলেছিস? আরে ওসি সাব না থাকলে অন্য যে আছে তাকে বল।’
শিশির মামা বিরক্ত হয়ে ফোনে রেখে দেন। কিন্তু তাকে আর বেশিক্ষণ বসে থাকতে হয় না। শরণখোলা থানার ওসি সাহেব এসে থানার গেটে নামেন। পরনের পোশাক দেখে অনুমান করা যায়, উনি ফ্রেশ হয়ে মাত্র খাবার টেবিলে বসছিলেন হয়তো। পরনে গ্যাবারডিন কাপড়ের ফুল প্যান্ট, হাফ স্লিভের কলারসহ টি-শার্ট। গাড়ি থেকে নেমে হন্তদন্ত হয়ে নিজের রুমে ঢোকার মুখেই শিশির মামাকে দেখতে পেয়ে থামেন। ‘কী ব্যাপার আপনারা এত রাতে এখানে কেন?’
প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করেই শিশির মামাকে ইশারায় ডেকে নিজের রুমের দিকে হাঁটতে শুরু করেন। চেয়ারে বসতে বসতে একজন কনস্টেবলকে ডেকে ডিউটি অফিসারকে নিয়ে আসতে বলেন। কনস্টেবল বের হয়ে যেতেই শিশির মামা ও তার সঙ্গীদের বসতে ইশারা করে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনারা কী জন্যে এসেছেন বলেন তো! ডিউটি অফিসার চলে আসলে হয়তো আর শুনতেই পারবো না।’
আদতে ঠিক তাই ঘটে। শিশির মামার মুখ থেকে 'স্যার' শব্দটা বের হতে না হতেই দরজায় টোকা দিয়ে 'মে আই কাম ইন স্যার' বলতে বলতে অনুমতির অপেক্ষা না করে, ডিউটি অফিসার হন্তদন্ত হয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন।
কী ব্যাপার হাবিব সাব, ঘটনা কী বলেন তো! জরুরি সেবা থেকে কাকে যেন কী করতে বলেছে!
স্যার, জরুরি মানে একদম ফায়ার-আর্জেন্ট। চারটা ছেলে সুন্দরবন ঘুরতে গিয়ে বনের ভেতর হারিয়ে গেছে। ওরা উদ্ধারের জন্য ৯৯৯ –এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছে। ওরা যে নম্বর থেকে ফোন দিয়েছিল সেই মোবাইল নম্বরটি দিয়েছে। জরুরি পরিষেবার অফিসারেরা ছেলেগুলোকে উদ্ধারের জন্য দ্রুত প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে বলছে স্যার।
এতটুকু শুনেই শিশির মামা মাঝখান থেকে চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমিও এই বিপদের জন্যই আসছি স্যার। এই চারজনের মধ্যে একজন আমার আপন ভাগনে।’ একথা শুনে এতক্ষণে ওসি সাহেব ও ডিউটি অফিসারসহ উপস্থিত সবাই অবাক চোখে একযোগে শিশির মামার দিকে তাকান এবং মনোযোগ দেন। মনোযোগ পেয়ে শিশির মামা যতটুকু যা জানেন তা গড়গড় করে বলতে শুরু করেন। এরই মধ্যে ইমরানের বাবা ও আদনানের বাবাসহ কয়েকজন হন্তদন্ত হয়ে ওসি সাহেবের রুমে প্রবেশ করে। বাকিরা রুমের বাইরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলেও সবার কথাবার্তায় ছোটখাটো একটা হট্টগোল শুরু হয়। ওসি সাহেবের ইশারায় ডিউটি অফিসার উঠে গিয়ে সবাইকে শান্ত হতে বলে আবার রুমে ফিরে আসেন।
ওসি সাহেব দ্রুততম সময়ে চার কিশোর, তাদের সুন্দরবন ভ্রমণ ও বনের ভেতর আটকে পড়া সম্পর্কে প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য ডাইরিতে নোট করেন। তারপর উপস্থিত সবাইকে নিয়ে জরুরি মিটিংয়ে বসেন। মিটিংয়ের আলোচনায় কিশোর দলটিকে উদ্ধারের জন্য প্রথমেই যে কয়েকটি বিষয় জরুরি হয়ে ওঠে সেগুলো হলো-
১. বনের ভেতরে চার কিশোরের অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া,
২. সুন্দরবনের কোন অংশ দিয়ে প্রবেশ করলে কিশোরদের কাছে দ্রুত পৌঁছানো সহজ হবে তা ঠিক করা,
৩. কিশোরদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করা এবং নিরাপদ থাকার জন্য তাদেরকে কিছু নির্দেশ দেওয়া,
৪. উদ্ধার অভিযানে বনবিভাগের অভিজ্ঞ কর্মীদের সম্পৃক্ত করা এবং
৫. উদ্ধার অভিযান পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক পুলিশফোর্স ও কিছু জিনিসপত্র সংগ্রহ করা।
পাঁচ নম্বর পয়েন্ট নিয়ে কথা উঠতেই ডিউটি অফিসার জানান, “স্যার আশপাশে আমাদের যে কজন ফোর্স বা স্টাফ বসবাস করে, তাদেরকে আমি অলরেডি ডেকে পাঠিয়েছি। আশা করছি অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা পৌঁছে যাবে।” ওসি সাহেব কথাটা শুনে সন্তুষ্ট হন এবং ‘ওয়েল ডান’ বলে সাধুবাদ জানান।
সময় গড়িয়ে যেতে থাকে। শরণখোলা থানার ওসি ও ডিউটি অফিসার দুজন সুন্দরবনের মানচিত্র সামনে নিয়ে চার কিশোরকে উদ্ধারের পরিকল্পনা সাজাতে থাকেন। পরিবারের পক্ষ থেকে আসা কয়েকজন কিশোরদলের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করতে থাকেন। এর মধ্যে কয়েকবার কল রিসিভ হলেও কথা কিছুই বোঝা যায়নি। মেসেজের মাধ্যমে কিছু কথা আদান-প্রদান হয়েছে। আদনান ও জিসানের বাবা মেসেজ দিয়ে চারজনকে সবসময় একসাথে থাকতে বলে দিয়েছেন। ওরাও রিপ্লাই দিয়ে বলেছে, “আমরা চারজন একসাথেই আছি।”
কিন্তু ওরা বনের কোন দিকে, কোথায় ও বনের কতটা গভীরে আছে সে বিষয়ে কিছুই বলতে পারেনি। তবে আধঘণ্টা ধরে আর কারও সাথেই কোনো যোগাযোগ করা যাচ্ছে না। মেসেজেরও কোনো রিপ্লাই পাওয়া যাচ্ছে না। ইতোমধ্যে ডেকে পাঠানো কনস্টেবলরা সবাই এসে গেছেন। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে। ওসি সাহেব ও ডিউটি অফিসার দুজন, সবাইকে নিয়ে আবারও মিটিংয়ে বসেছেন। ওসি সাহেব, সবাইকে এই উদ্ধার অভিযানের পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এবং ডিউটি অফিসার, পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই উদ্ধার অভিযানটিকে সফল করতে কার কী করণীয় ও দায়িত্ব তা সবাইকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন।
পরিকল্পনা অনুযায়ী এই উদ্ধার অভিযানটি পরিচালনার জন্য দুটি দল করা হয়েছে। ওসি সাহেব ও ডিউটি অফিসার, দুজন দুটি দলকে নেতৃত্ব দিবেন। প্রতিটি দলে মোট নয়জন করে সদস্য নেওয়া হয়েছে। সামনের শরণখোলা ফরেস্ট অফিস থেকে প্রতি দলে আরও একজন করে সদস্য যুক্ত হবেন বলে কথা হয়ে আছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শরণখোলা ফরেস্ট অফিস থেকে দুটি দল বিপরীত দুই দিক থেকে বনের ভেতর প্রবেশ করবে। চার কিশোরের বাড়ি থেকে আসা পরিবারের সদস্যদের মধ্য থেকে কাউকেই সাথে নেওয়া হয় না। শুধু তিন মৌয়াল ও শিশির মামাকে নেয়া হয়।
ইমরান, জিসান ও আদনানের বাবা-চাচা এবং মিঠুর চাচাসহ বাড়ি থেকে আসা সবাইকে থানায় রেখে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। তারা যাওয়ার জন্য অনেক পীড়াপীড়ি করেন, জেদ দেখান, অনুরোধ করেন। কিন্তু ওসি সাহেব তাদের কোনো কথাকেই গ্রাহ্য করেন না। জেদ বা অনুরোধ কোনো কিছুই আমলে নেন না। তার সাফ কথা, ‘এই অভিযানে আপনাদেরকে সাথে নিলে আমাদের ঝামেলা বরং বাড়বে, কমবে না। তাছাড়া আপনারা যেহেতু আগে কখনো বনের গভীরে প্রবেশ করেননি, আপনাদের এই বন সম্পর্কে তেমন কোনো অভিজ্ঞতাই নেই। আপনারা আমাদেরকে সাহায্য করার পরিবর্তে অসুবিধাই করবেন বেশি। তাই কোনোভাবেই আপনাদেরকে আমরা সাথে নিতে পারবো না।
ওসি সাহেব মনে মনে আরও একটা কথা ভাবেন, কিন্তু চার কিশোরের অভিভাবকদের কাউকেই তিনি কথাটা বলতে পারেন না। এই দুরন্ত কিশোরদেরকে উদ্ধার করা গেলেও কোন অবস্থায় তাদের পাওয়া যাবে বা আদৌ চারজনের সবাইকে জীবিত পাওয়া যাবে কিনা, নিশ্চিত করে সেসব কিছুই বলা যাচ্ছে না। যদি তেমন কোনো অবস্থা তৈরি হয় তাহলে কিশোরদের বাবা-চাচাদের সামাল দেওয়াই তখন আরেক মুশকিল হয়ে যাবে।
কিন্তু এই আশঙ্কার কথাটি দু-একবার ওসি সাহেবের মনের কোনায় উঁকি দিয়ে গেলেও তাদের কষ্ট পাওয়া কথা ভেবে, তাদের দুশ্চিন্তা বেড়ে যাওয়ার ভয়ে, তিনি অভিভাবকদের এ কথাটি বলতে পারেন না। অথবা বলেন না। বরং ওসি সাহেব তাদেরকে নানান কথা বলে অভয় দেন, আশ্বস্ত করেন। আসার পর থেকে ওসি সাহেব এবং ডিউটি অফিসারের বিভিন্ন কর্মতৎপরতা ও আন্তরিক প্রচেষ্টা দেখে তারাও সে আশ্বাসে বিশ্বাস করেন। ভরসা পান। ওসি সাহেবের যুক্তিপূর্ণ কথায় তারা থানার দায়িত্বে থাকা তিন পুলিশ কনস্টেবলের সাথে থানাতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
চলবে...