দান্তে আলিগিয়েরি (১২৬৫-১৩২১) ছিলেন ইতালির এক মহান কবি, যাকে আধুনিক ইতালীয় ভাষার জনক বলা হয়।
Published : 01 Apr 2025, 12:58 AM
মার্চের শেষ প্রান্তে বসন্ত এসে তার কোমল স্পর্শ রেখে যাচ্ছে প্রকৃতিতে। সূর্য মৃদু আলো ছড়াচ্ছে, বাতাসে এক অদৃশ্য সুরের দোলা, চারপাশে যেন এক অপার্থিব মুগ্ধতা। এমনই এক সকালে আমার সহপাঠী নাদিসা পাঠালো এক আকর্ষণীয় প্রস্তাব— টলমিনের রহস্যঘেরা প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাওয়ার নিমন্ত্রণ।
একদিন সকাল পৌনে দশটায় বাসে উঠে রওনা দিলাম টলমিনের পথে। নোভা গোরিছা থেকে প্রায় ৪০ কিলোমিটার পথ, যেখানে সোচা নদী এক বিশ্বস্ত সহযাত্রীর মতো পথের বাঁকে বাঁকে বয়ে চলেছে। কিন্তু এই নদী শুধু এক প্রবাহমান জলধারা নয়, এটি ইতিহাসের স্রোতও বহন করছে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের অন্যতম প্রধান যুদ্ধক্ষেত্র ছিল এই সোচা নদীর উপত্যকা, যেখানে ইতালীয় ও অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ ঘটেছিল।
এই নদী শুধু যুদ্ধের নয়, কবিতারও সাক্ষী। স্লোভেনিয়ার কবি সিমন গ্রেগরচি এবং ইতালির কবি জিউসেপ্পে উঙ্গারেত্তির কবিতায় সোচা নদী এক অবিস্মরণীয় প্রতীক হয়ে আছে। এমনকি, ‘দ্য ক্রনিকলস অব নার্নিয়া: প্রিন্স ক্যাসপিয়ান’ চলচ্চিত্রের কিছু দৃশ্য এই নদীর তীরে ধারণ করা হয়েছিল, যেখানে প্রকৃতির অনন্য সৌন্দর্য ও ইতিহাসের আবহ একাকার হয়ে গেছে।
টলমিনের কেন্দ্রে পৌঁছেই আমরা হাঁটা শুরু করলাম টলমিন্সকা কোরিতার গিরিখাতের দিকে। প্রবেশদ্বারে সাড়ে ছয় ইউরোর টিকিট কেটে যেন প্রকৃতির এক গোপন দরজা খুলে গেল। সংকীর্ণ পথে এগিয়ে আমরা এসে দাঁড়ালাম ‘শয়তানের সেতু’— যা স্থানীয় ভাষায় পরিচিত ‘হুদিচেভ মোস্ত’ নামে। কিংবদন্তি বলে, একসময় এই সেতু কাঠের ছিল, কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইতালীয় সৈন্যরা একে লোহার কাঠামোয় রূপান্তরিত করে। নিচে সোচা নদী গর্জন করছে, যেন অতীতের রক্তস্নাত স্মৃতি এখনো তার বুকে বয়ে চলেছে।
গিরিখাতের পাথরের প্রাচীরগুলো সুউচ্চ এবং সরু পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হয়, প্রকৃতিই এখানে তার নিজস্ব ভাস্কর্য নির্মাণ করেছে। ক্ষয়প্রাপ্ত পাথরের স্তরে স্তরে প্রকৃতির হাজার বছরের শিল্পকর্ম ছাপ রেখে গেছে। গুহার মধ্যে ঢুকতেই অনুভব হলো এক অদ্ভুত নীরবতা, যেন সময় এখানে থমকে আছে।
গিরিখাতের পথ ধরে পৌঁছলাম এক রহস্যময় স্থানে— ‘জাদ্লাস্কা গুহা’। স্থানীয়রা একে ‘দান্তের গুহা’ নামে চেনে। কারণ জনশ্রুতি রয়েছে, দান্তে আলিগিয়েরি তার ‘ডিভাইন কমেডি’-র ‘ইনফার্নো’ অংশের নরকের বিবরণ এই গুহা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লিখেছিলেন।
দান্তে আলিগিয়েরি (১২৬৫-১৩২১) ছিলেন ইতালির এক মহান কবি, যাকে আধুনিক ইতালীয় ভাষার জনক বলা হয়। তার মহাকাব্যিক সৃষ্টি ‘ডিভাইন কমেডি’ মধ্যযুগীয় ইউরোপের ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তাধারাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। এই কাব্যের ‘ইনফার্নো’ অংশে তিনি নরকের বর্ণনা দেন, যেখানে বিভিন্ন স্তরে পাপীদের শাস্তি ভোগ করতে দেখা যায়। বিশ্বাস করা হয়, দান্তে যখন রাজনৈতিক কারণে নির্বাসিত ছিলেন, তখন তিনি ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চল ভ্রমণ করেছিলেন। এই সময় তিনি স্লোভেনিয়ার টলমিন অঞ্চলের জাদ্লাস্কা গুহায় এসেছিলেন এবং এখানকার গহীন, অন্ধকার প্রকৃতি তাকে নরকের কল্পচিত্র আঁকতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
গুহার প্রবেশপথ থেকে ভেতরে ঢুকতেই অনুভূত হলো এক শীতল অন্ধকার। বাতাস ভারী, চারপাশে স্যাঁতসেঁতে পাথরের গন্ধ। পাথরের স্তম্ভগুলো যেন যুগের পর যুগ ধরে অতীতের রহস্য ধরে রেখেছে। স্থানীয় কিংবদন্তি বলে, একসময় এখানে সাধুদের আশ্রম ছিল, যারা প্রকৃতির রহস্য ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য গভীর ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন।
এই গুহার গহীন অন্ধকারে দাঁড়িয়ে দান্তের লেখা নরকের চিত্র যেন বাস্তব হয়ে ওঠে। পাথরের দেয়ালে এক অদ্ভুত ছায়া খেলে যায়, যেন অতীতের প্রতিধ্বনি এখনো এখানে প্রতিফলিত হয়। কালের স্রোতে এই গুহা সাক্ষী হয়ে আছে সভ্যতার বিবর্তনের, যুদ্ধের অন্ধকার অধ্যায়ের এবং মানুষের অদম্য কৌতূহলের।
গুহা থেকে বের হয়ে আমরা এগোলাম এক অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সেনা কবরস্থানের দিকে। ১৯১৬ সালে মাউন্ট ভোডেল ও মাউন্ট ক্রানের যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত প্রায় ৩ হাজার ৩০০ সৈনিক এখানে চিরনিদ্রায় শায়িত। পাহাড়ের ছায়ায় দাঁড়িয়ে থাকা এই কবরস্থান এক নীরব অথচ গভীর আবেগের প্রতীক।
প্রত্যেকটি নামহীন সমাধির সামনে দাঁড়ালে মনে হয়, যেন যুদ্ধের ছায়া এখনো এখানে ঘুরপাক খাচ্ছে। কারও পরিচিতি নেই, নেই কোনো নামফলক— শুধু একসাথে শুয়ে থাকা সৈনিকদের অসীম শূন্যতা।
টলমিনের মাটিতে আজও প্রতিধ্বনিত হয় কিংবদন্তির সুর, পূর্বপুরুষের কাহিনি ভেসে বেড়ায় বাতাসে। প্রকৃতির বিস্ময়কর নিয়ম আর ইতিহাসের গভীর থেকে উঠে আসা রহস্যময়তার ব্যাখ্যা লুকিয়ে থাকে এইসব গল্পে। তার মধ্যে জেগে ওঠে ‘ডুগা বাবা’, এক বন্য নারী, যিনি জাদ্লাস্কা ইয়ামার অন্ধকারে বাস করতেন। গুহার দ্বারে বসে তিনি টলমিন্সকা গর্জেসের প্রবেশপথে প্রহরা দিতেন, পথিকদের কৃষির গোপন বিদ্যার বিনিময়ে অসাধ্য কাজে বাধ্য করতেন। আজ তিনি নেই, কিন্তু তার কাঠের ভাস্কর্য গুহার সামনে দাঁড়িয়ে— নিশ্চুপ, জীবন্মৃতের মতো আমাদের দিকে তাকিয়ে, যেন এখনও সময়ের অগাধ গহ্বরে রাজত্ব করে।
টলমিন শহরটি যেন এক অদৃশ্য সেতু, যা অতীত ও বর্তমানকে একসূত্রে গেঁথে রেখেছে। একবার যদি টলমিনের এই মায়াবী দৃশ্যপট ও গহন ইতিহাসের মাঝে হারিয়ে যান, তবে ফিরে আসা কঠিন। একদিকে প্রকৃতির বিশুদ্ধতা, অন্যদিকে রক্তস্নাত অতীত— টলমিন যেন নরকের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে এক স্বর্গীয় নীরবতা রচনা করেছে।