
পানির জন্য হাহাকার মিরপুরে
কাজী নাফিয়া রহমান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published: 11 May 2017 09:03 AM BdST Updated: 11 May 2017 09:03 AM BdST
রোদে শুকাতে দেওয়া শতাধিক জামা-কাপড়, বালতি-বাসন-পাতিল নিয়ে ব্যস্ত নারী-পুরুষ; স্বাভাবিকভাবেই একে কোনো বাড়ির দৃশ্য মনে হলেও তা আসলে ঢাকার মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের সি ব্লকের একটি পানির পাম্প।
প্রায় তিন মাস ধরে পানি পাচ্ছেন না এ এলাকার বাসিন্দারা।
বুধবার ঘুরে দেখা যায়, পুরো এলাকাতেই পানির তীব্র সংকট। সেখানকার ‘সবুজ-বাংলা আবাসিক’ এলাকার বাসিন্দারা বলছেন, ২০-২৫ দিন ধরে একটুও পানি পাচ্ছেন না তারা।
এক বছর আগে এই এলাকায় পানির নতুন লাইন বসানোর পর এবারই প্রথম বড় ধরনের পানি সংকটের মুখোমুখি হওয়ার কথা জানান তারা। তাদের অভিযোগ, কর্তৃপক্ষ আশ্বাস দিয়ে এলেও সমস্যার কোনো সমাধান হচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট নলকূপের পানির প্রবাহ অর্ধেকের চেয়েও বেশি কমে যাওয়ায় এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে বলে ওয়াসার কর্মীরা জানালেও এর সমাধানে কোনো উদ্যোগের খবর দিতে পারেননি তারা।
পেশায় চিকিৎসক সবুজ-বাংলা আবাসিক এলাকার বাসিন্দা মরিয়ম খানম বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এর আগে পানির জন্য এত ‘সাফারার’ হইনি। এবারই এত কষ্ট হচ্ছে। নতুন লাইন দেওয়ার পর থেকেই আমরা পানি পাই না। মাস খানেক ধরে দেখা যেত দুদিনে একবার পানি দিচ্ছে, কিন্তু গত দুই সপ্তাহ ধরে একেবারেই পানি আসছে না।

এই অবস্থায় ভাড়াটিয়াদের গালাগাল শুনতে করতে হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “তারা তো টাকা দিয়ে থাকে। পানি না পেলে ভাড়া থাকবে কেন?”
সি ব্লকের ‘তারা মেডিকেল’ পাম্পের অপারেটর নজরুল ইসলাম মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখানে প্রথম কূপ যখন ছিল, সেটির পানি ১০ বছর ধরে সঠিকভাবে পেয়েছি। কিন্তু দ্বিতীয় কুপ বসানোর পরই সমস্যা দেখা দেয়। তিনবছর আগে বসানো এই কূপে প্রথমে প্রতি মিনিটে ৩২০০ লিটার পানি আসত। কিন্তু এখন প্রতি মিনিটে আসছে ১০০০ লিটার পানি।”
তিনি বলেন, “ছয় মাস ধরে পাম্পের প্রোডাকশন (পানি উত্তোলন) কমছে, আর সমস্যা বাড়ছে। আমরা কিছু পদক্ষেপ নিয়েছি, কিন্তু এখন আর পানি বাড়ার সম্ভাবনা নেই। তাই নতুন কূপ খননের সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ, যতদিন এই কূপ খনন না হবে ততদিন এ সমস্যা দূর করা সম্ভব না। তবে আমরা চেষ্টা করছি ইন্টার কানেকশনের মাধ্যমে রাতে কিছুটা পানি দেওয়ার।

নতুন সংযোগ লাইনের কারণে এই পাম্পের অন্তুর্ভুক্ত ১০ নম্বর ও ১১ নম্বর রোডে পানির সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এক বছর আগে নতুন লাইন বসানো হয় এলাকায়। স্থানীয়দের সাথে ঝামেলার কারণে সে কাজটি পুরোটা শেষ হয়নি। ওই লাইন বসানোর পর থেকেই সমস্যা দেখা দেয়। পুরনো- নতুন লাইনের ঝামেলার কারণে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। একদিকে চালু করে আর একদিকে বন্ধ করে যে ধাপে ধাপে পানি ছাড়ি আমরা, তার কারণেও পানির সংকট।”
পাম্প সংশ্লিষ্ট ওয়াসার কর্মীরা জানান, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহযোগিতায় পানির নতুন সংযোগ লাইন বসানোর পর থেকে চলা এ সংকটে স্থানীয় বাসিন্দাদের চাপে তারাও নাজেহাল হচ্ছেন। আর এর সাথে গত ছয়মাস ধরে যুক্ত হয়েছে পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার নতুন সংকট।

ডেসকোতে চাকরি করা এনায়েত হোসেন ভাড়া থাকেন একই এলাকায়।
তিনি বলেন, “গত বছর পানির নতুন লাইন বসানোর পর কিছুটা পানি এসেছিল। কিন্তু গত দুই মাস ধরে পানির সমস্যা চলছে।”
স্থানীয় বাড়ির মালিক মেহেরুন্নেসা বলেন, “পানি ছাড়া মওতের অবস্থা হইছে। এক্কেবারে মরুভূমি অবস্থা। কালকে দুই রাকাত নফল নামায পড়ে দোয়া করছি যাতে পানি আসে।
“পানি ছাড়া কি চলা যায়? একবেলা না খেয়ে থাকলে সহ্য করা যায়, কিন্তু পানি ছাড়া থাকা সম্ভব না। পুরানো লাইনে এ সমস্যা ছিল না। ভাড়াটিয়ারা বলছে, চলে যাবে।"
তিনি বলেন, “মিরপুর ১৩ নম্বর থেকে লোক এসে দেখে গেছে। তারা বলছে, নতুন বসানো পাইপ উঁচু, তাই পানি আসছে না।”
সবুজ বাংলা আবাসিক এলাকার বিক্রমপুর জেনারেল স্টোরের মালিক ফরিদুল ইসলাম বলেন, “কয়দিন ধরে একফোঁটা পানিও আসছে না। আশপাশের এলাকা থেকে পানি এনে নিত্য প্রয়োজনীয় কাজগলো করছি।”

অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকার বাসিন্দারা কিছুটা পানি পেলেও উঁচুতে থাকা বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন।
১১ নম্বরের সি ব্লকের ১২ নম্বর রোডের ১ নম্বর লাইনের গৃহিনী পারুল আক্তার বলেন, “এখানে যাদের উঁচুতে বাড়ি, তাদের কারোরই পানি নাই। কালকে যা পানি আসছে তাও ময়লা। পানি থাকে না, গ্যাস থাকে না; কি মসিবতে যে আছি!”
একই রোডের ২ নম্বর লেনের ‘ভাই ভাই ভিলার’ কেয়ারটেকার সিরাজুল ইসলাম বলেন, “যত উঁচুতে বাড়ি, তত সমস্যা। আমাদেরও পানি নাই দীর্ঘদিন ধরে।”
বিসমিল্লাহ জেনারেল স্টোরের দোকানী আব্দুল রাজ্জাক বলেন, “দিনে অল্প সময়ের জন্য পানি আসে। সবাই একসাথে পানি নিলে পানি পাওয়া যায় না। তাই পালা করে পানি তুলি আমরা। তাতে দেখা যায়, এক বাড়ির লোক ২০ মিনিটের বেশি সময় পায় না পানি রাখার জন্য।
“গত পরশু ইঞ্জিনিয়ার এসে রাত ৮টা পর্যন্ত ছিল, বলেছিল সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সমস্যার তো এখনো সমাধান হয়নি।”
কর্তৃপক্ষের এমন আশ্বাসে ক্ষুব্ধ ১১ নম্বর রোডের ৪ নম্বর লাইনের অস্থায়ী নিবাসের বাসিন্দা আব্দুল লতিফ বলেন, “ইঞ্জিনিয়াররা আসে মাঝে মাঝে। তারা ঠিক হবে বলে যায়, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। পানির টাকা তো ঠিকই দিতে হচ্ছে।”

এ এলাকার কয়েকটি বিহারী ক্যাম্পের বাসিন্দারা দীর্ঘদিন ধরে পানি পাচ্ছেন না।
এমসিসি ক্যাম্পের ডিশ ব্যবসায়ী জিল্লুর রহমান বলেন, “২-৩ মাস ধরে পানি নেই, গরম যত বাড়ছে পানি তত কমছে। খাওয়া-দাওয়াও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, যেটকু কাজ করছি তা কুয়া আর চাপকলের পানি দিয়ে। কিন্তু এত চাহিদা যে, এখন কুয়ার পানিও পাচ্ছি না।”
পার্শ্ববর্তী এফজি ক্যাম্পেও পানি সংকটে গোসল-খাবারসহ নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে বলে জানান তিনি।
সি ব্লক উন্নয়ন কমিটির সাধারণ সম্পাদক ও পল্লবী থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আইন বিষয়ক সম্পাদক সাজিদুল ইসলাম লাড্ডান বলেন, “পুরো ৩ নম্বর ওয়ার্ডেই পানির সমস্যা। স্থানীয়দের অভিযোগ শুনে আমরাও বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি বিষয়টি সমাধান করতে। ওয়াসার লোকজনের সাথেও কথা বলেছি। তারা আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন, কিন্তু সমস্যার তো সমাধান হচ্ছে না।”
বুধবার দুপুরে সি ব্লকের এভিনিউ-৫ পানির পাম্পে গিয়ে দেখা যায়, অনেক নারী-পুরুষ পানির জন্য পাম্পে ভিড় করেছেন। কেউ বালতি বা কলসিতে করে পানি নিয়ে যাচ্ছেন, আবার কেউ বাসন-পাতিল পরিষ্কার করছেন। আর পাম্পের ভিতরেই রোদে শুকাতে দেওয়া হয়েছে শাড়ি, লুঙ্গিসহ নিত্য ব্যবহার্য কাপড়।

“এই পাম্পে এসে কিছুটা পানি পাওয়া যায়, সেটি আমরা নিয়ে গিয়ে কাজ চালাই। কাপড় ধোয়ার কাজটিও এই পাম্পেই করতে হচ্ছে কয়েক মাস ধরে।”
তিনি বলেন, “নতুন লাইন বসানোর সময় বলা হয়েছিল যে, আটতলায়ও পানি উঠবে। কিন্তু এখন নিচতলায়ও কোনো ঘরে পানি পাওয়া যায় না। নতুন পাইপ উঁচু করে বসানোর কারণে এ সমস্যা হচ্ছে।”
পাম্পসংলগ্ন ২২ নম্বর লাইনের ২ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা রওশন আরা বেগম বলেন, “পুরনো লাইনে আমরা ২৪ ঘণ্টা পানি পেতাম। কিন্তু নতুন লাইন বসার পর থেকেই আর পানি পাচ্ছি না। আমি তো পাম্পের সাথের বাসায় থাকি, আমার ঘরেই পানি আসে না।”
তিনি বলেন, “বিদেশিরা মাঝে মাঝে আসে। তারা বলে সমাধান হয়ে যাবে, বিদেশ থেকে লোক আসবে; কিন্তু সমাধান তো হয় না। এখন আন্দোলন করে পাম্প ভেঙ্গে দেওয়া ছাড়া তো কোনো রাস্তা নেই।”

তিনি বলেন, “স্থানীয়রা আমাদের উপর প্রচুর চাপ দেন। আমরা স্যারদের জানাই, তারা বিষয়টি দেখবেন বলে জানান; এইভাবেই চলছে।”
এ বিষয়ে যোগাযোগ করলে মিরপুর এলাকার পানির নিয়ন্ত্রক ঢাকা ওয়াসার মডস জোন ১০ এর উপ-সহকারী প্রকৌশলী সজল মজুমদার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের যে পাম্পটা দিয়ে পানি সরবরাহ হয়, বিদ্যুৎ না থাকার কারণে সেখানে সমস্যাটা হয়েছে।”
তবে পাম্পের অপারেটর আনারুল বলছেন, বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে পানির সংকট দেখা দিচ্ছে না, বরং নতুন সংযোগের উঁচু পাইপই এর জন্য দায়ী।
পরে আবার যোগাযোগ করলে ওয়াসার প্রকৌশলী সজল মজুমদার বলেন, “গরমের মওসুম হওয়ায় পানির সরবরাহ কমে গিয়েছে। এলাকাবাসীর সমস্যার সমাধানের বিষয়ে বক্তব্য দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। ওয়াসার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সঠিক তথ্য দিতে পারবেন।”
এ বিষয়ে কথা বলতে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার তাকসিম এ খানকে বুধবার রাতে ফোন করা হলে তিনি ‘অসুস্থ’ জানিয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
আরও পড়ুন
WARNING:
Any unauthorised use or reproduction of bdnews24.com content for commercial purposes is strictly prohibited and constitutes copyright infringement liable to legal action.
সর্বাধিক পঠিত
- কাশ্মীরের পুলওয়ামায় বন্দুকযুদ্ধে নিহত ৯
- মাহমুদুলের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের দারুণ জয়
- ছেলে সন্তানের জন্ম দিলেন আইএসের শামীমা বেগম
- অবশেষে হচ্ছে বিপিএলের বাইরে টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট
- স্মিথের সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশের সামনে বড় লক্ষ্য
- আরও ৩টি ব্যাংক অনুমোদন
- ৫ সেঞ্চুরিতেও আশরাফুলের ১৫ লাখ যে কারণে
- মাহমুদউল্লাহ-বোল্টের শাস্তি
- ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে কে কোন দলে
- ‘বদিকে দিয়ে মাদক, শাজাহান খানকে দিয়ে দুর্ঘটনা রোধ সম্ভব?’