অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ৭০% কার্যকর

ব্রিটিশ ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকাকে সঙ্গে নিয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় যে টিকা তৈরি করেছে, তা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীকে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পেরেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Nov 2020, 08:13 AM
Updated : 30 Dec 2020, 09:15 AM

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি জানিয়েছে, তৃতীয় ধাপের ট্রায়ালে এ টিকার দুই ধরনের ডোজের তথ্য বিশ্লেষণে একটিতে ৯০ শতাংশ এবং অন্যটিতে ৬২ শতাংশ কার্যকারিতা দেখা গেছে।

অর্থাৎ, গড়ে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে এ টিকা কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে ডোজের মাত্রা পরিবর্তন করে দিলে তা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার এই টিকার তিন কোটি ডোজ কিনতে ইতোমধ্যে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়া এবং বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করেছে বাংলাদেশ সরকার।

মানুষের ওপর তৃতীয় ধাপের পরীক্ষা শেষে সোমবার এ টিকার কার্যকারিতার তথ্য প্রকাশ করেছেন অক্সফোর্ডের গবেষকরা। 

টিকার দৌড়ে থাকা দুই মার্কিন কোম্পানি ফাইজার ও মডার্নার তৈরি ভ্যাকসিন ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৯৫ শতাংশের মত কার্যকারিতা দেখিয়েছে।

তবে অক্সফোর্ডের টিকা তুলনামূলকভাবে অনেক সস্তা এবং সহজে সংরক্ষণযোগ্য বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে বিবিসি।

অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকা বলছে, বিভিন্ন বয়স শ্রেণি, এমনকি বয়স্কদেরও যে এই টিকা করোনাভাইরাস থেকে সুরক্ষা দিতে পারে, পরীক্ষায় তার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভ্যাকসিনোলজির অধ্যাপক সারা গিলবার্ট বলেন, “কোভিড-১৯ যে বিপর্যয় ডেকে এনেছে, তার অবসানের জন্য এই টিকা ব্যবহারের পথে আমরা আজ আরও এক ধাপ এগিয়ে গেলাম।” 

অ্যাস্ট্রাজেনেকা জানিয়েছে, আগামী এক বছরে তারা পুরো বিশ্বের জন্য তিন বিলিয়ন ডোজ টিকা তৈরি করবে। যুক্তরাজ্য সরকার ইতোমধ্যে এর ১০ কোটি ডোজের অর্ডার দিয়ে রেখেছে। 

অক্সফোর্ডের এই টিকা উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সেরাম ইনস্টিটিউট অব ইনডিয়া। বাংলাদেশও ভারত থেকে ওই টিকার তিন কোটি ডোজ কেনার জন্য চুক্তি করেছে।

ট্রায়ালে কী পাওয়া গেছে

যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলে প্রায় ২০ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর টিকার পরীক্ষামূলক প্রয়োগে যে ফলাফল পাওয়া গেছে, তার ফলাফলই সোমবার জানিয়েছে অক্সফোর্ড ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা।

এ ধরনের পরীক্ষায় স্বেচ্ছাসেবীদের দুটি গ্রুপে ভাগ করা হয়। একটি গ্রুপকে দেওয়া হয় পরীক্ষায় থাকা টিকা, অন্য গ্রুপকে ডামি ইনজেকশন দেওয়া হয়, যাতে টিকা থাকে না। কোন গ্রুপ টিকা পেয়েছে তা স্বেচ্ছাসেবীদের বলা হয় না।

একটি পরীক্ষায় দেখা গেছে, যাদের এক মাসের ব্যবধানে দুই ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ৩০ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন, বাকিরা সুস্থ ছিলেন। আর যাদের ডামি ইনজেকশন দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১০১ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ গবেষণায় ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা ভাইরাসের বিরুদ্ধে কার্যকর সুরক্ষা দিতে পেরেছে বলে গবেষকদের ভাষ্য।

দ্বিতীয় পরীক্ষা চালানো হয় তিন হাজার স্বেচ্ছাসেবীর ওপর । তাদের একটি অর্ধেক ডোজের পর একটি পূর্ণ ডোজ টিকা দেওয়া হয়। তাদের ৯০ শতাংশের ক্ষেত্রে এই টিকা সুরক্ষা দিতে পেরেছে।

বিবিসি লিখেছে, এই টিকা বাজারে ছাড়ার আগে নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন প্রয়োজন হবে। এ ভ্যাকসিন কতটা নিরাপদ, কতটা কার্যকর এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া কতটা মানসম্পন্ন তা বিচার করে নিয়ন্ত্রক সংস্থা চূড়ান্ত অনুমোদন দেবে। আগামী কয়েক সপ্তাহে সেই প্রক্রিয়া চলবে।   

তবে সরকারিভাবে যে টিকার অর্ডার দেওয়া হয়েছে, তা কারা পাবে, তা সরকারই ঠিক করবে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক এর আগে জানিয়েছিলেন, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে যারা সামনের সারির যোদ্ধা, অর্থাৎ চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য, তারাই এ টিকা আগে পাবে, কারণ তাদেরই আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি। 

কীভাবে কাজ করে এ টিকা?

মডার্না বা ফাইজার যে টিকা তৈরি করেছে, তাতে করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোডের একটি অংশ সরাসরি মানুষের দেহে প্রয়োগ করা হয়, যাতে শরীরে এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে।

তবে অক্সফোর্ডের টিকা তৈরি হয়েছে ভিন্ন প্রক্রিয়ায়। শিম্পাঞ্জির মধ্যে দেখা যায় এমন এক ধরনের সর্দি-জ্বরের ভাইরাসের জিন বদলে দিয়ে এই টিকা তৈরি করা হয়েছে।

জিন বদলে দেওয়ার সময় করোনাভাইরাসের জেনেটিক কোডের একটি অংশ সেখানে দিয়ে দেওয়া হয়েছে, যাকে বলা হয় স্পাইক প্রোটিন।

টিকা দেওয়ার পর মানুষের শরীর ওই স্পাইক প্রোটিন চিনে নিয়ে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলে। আর যার মধ্যে কার্যকরভাবে সেই অ্যান্টিবিডি তৈরি হচ্ছে, তাকে আর করোনাভাইরাস কাবু করতে পারবে না।

অক্সফোর্ডের টিকার দুই ডোজের চেয়ে দেড় ডোজ কেন বেশি ভালো ফল দেখাচ্ছে, সে বিষয়ে এখনও নিশ্চিত নন গবেষকরা।

বিবিসি লিখেছে, শুধুতেই বড় ডোজ দিলে মানুষের ইমিউন সিস্টেম বা রোগী প্রতিরোধ ব্যবস্থা হয়ত সেই ভ্যাকসিনে সেভাবে সারা দিচ্ছে না, কারণ এটা তৈরি হয়েছে সাধারণ সর্দি-জ্বরের ভাইরাস ব্যবহার করে।  

আবার এমনও হতে পারে যে শুরুতে অর্ধেক ডোজ ব্যবহার করলে শরীরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মত প্রতিক্রিয়া তৈরি করা সহজ হচ্ছে, তাতে তুলনামূলকভাবে ভালো প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারছে মানব দেহ।

 

কোন ভ্যাকসিন ভালো?

ফাইজার বা মডার্নার ভ্যাকসিন যেখানে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালে ৯৫ শতাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর হতে দেখা গেছে, সেখানে অক্সফোর্ডের টিকার গড়ে ৭০ শতাংশ কার্যকারিতা অনেককে হতাশ করতে পারে।

তবে বিবিসি লিখেছে, ৭০ শতাংশ কার্যকর হলেও এ ভ্যাকসিন বহু মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে। তাছাড়া দাম আর সংরক্ষণ পদ্ধতি এ ভ্যাকসিনকে এগিয়ে রাখবে।

অক্সফোর্ডের টিকা রেফ্রিজারেটরের সাধারণ তাপমাত্রাতেই সংরক্ষণ করা যায়; ফলে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে এই টিকা পৌঁছানো তুলনামূলক সহজ।  

কিন্তু ফাইজারের টিকা মাইনাস ৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং মডার্নার টিকা মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হয়, যা সাধারণ রেফ্রিজারেটরে সম্ভব নয়।

বিবিসির প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, অক্সফোর্ডের টিকার প্রতি ডোজের দাম পড়বে তিন পাউন্ডের মত (বাংলাদেশি মুদ্রায় ৩৩৯ টাকা)। আর ফাইজারের টিকার দাম হবে ১৫ পাউন্ডের মত, মডার্নার টিকায় লাগবে ২৫ পাউন্ড।