বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার একটি আশঙ্কা তারা আগেই করেছিলেন। সে অনুযায়ী তখন ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত।
Published : 11 Sep 2024, 09:16 AM
বর্ষা মৌসুমের শেষে এসে দেশে মশাবাহিত রোগ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ফের বাড়ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যাও।
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা অগাস্ট মাসের দ্বিগুণেরও বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসের দিকে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ার একটি আশঙ্কা তারা আগেই করেছিলেন। সে অনুযায়ী তখন ব্যবস্থা নিলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে দেখা গেছে, সেপ্টেম্বরের ১০ দিনে সারাদেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ১৬ হাজার ৮১৯ জন। এ সময় মৃত্যু হয়েছে ১০২ জনের।
বর্তমানে দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ১৬৬৪ জন রোগী। একদিনে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীর এই সংখ্যা এ বছর সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে দেখা গেছে, গত জানুয়ারি মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ১০৫৫ জন। ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৩৯ জন, মার্চ মাসে ৩১১ জন, এপ্রিল মাসে ৫০৪ জন, মে মাসে ৬৪৪ জন রোগী ভর্তি হন হাসপাতালে। জুলাই মাসে ভর্তি হন ২৬৬৯ জন।
অগাস্ট মাসে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৬৫২১ জন, যা জুলাইয়ের প্রায় আড়াইগুণ। আর সেপ্টেম্বরের প্রথম ১০ দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি হয়েছেন ৩৯৭৮ জন রোগী।
সোমবার সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু নিয়ে ভর্তি হয়েছেন ৬১৫ জন রোগী, যা এ বছর একদিনে ভর্তি রোগীর সর্বোচ্চ সংখ্যা। এদিন সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৫ জনের মৃত্যু হয়। এই সংখ্যাও এ বছর একদিনে সর্বোচ্চ।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গত কয়েকদিনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জানুয়ারি মাসে দৈনিক গড়ে ৩৪ জন, ফেব্রুয়ারি মাসে ১২ জন, মার্চে ১০ জন, এপ্রিলে ১৭ জন, মে মাসে ২১ জন, জুন মাসে ২৭ জন করে রোগী ভর্তি হয়েছিল। জুলাই মাসে তা বেড়ে গড়ে ৮৬ জনে দাঁড়ায়। অগাস্ট মাসে দৈনিক গড়ে ২১৭ জন রোগী ভর্তি হয়েছে হাসপাতালে।
আর সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ১০ দিনে দৈনিক ভর্তি রোগীর গড় সংখ্যা ৩৯৮ জন।
রোগী বাড়ছে ঢাকার হাসপাতালে
এ বছর সারাদেশে যত রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে, তার প্রায় অর্ধেক ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে। এ বছর ভর্তি রোগীর মধ্যে ৯৫২৭ জন ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায়। ঢাকায় ভর্তি হয়েছেন ৭২৯২ জন রোগী।
ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালেও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ভর্তি রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।
মঙ্গলবার ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ৯৩৮ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন। গত সপ্তাহ আগে ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ৭৬৮ জন।
মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৮৭ জন, মিটফোর্ড হাসপাতালে ৪১ জন, বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটে ১৩ জন, শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ৫৫ জন, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৯৫ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ৫৯ জন, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ৪৯ জন এবং ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড-১৯ হাসপাতালে ৪৪ জন রোগী ভর্তি ছিলেন।
ঢাকার সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগে ভর্তি রয়েছেন ঢাকার পীরেরবাগের কলেজ ছাত্র আবদুল কাইয়ুম। তার মা সেলিনা বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সোমবার তার ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন। এর তিনদিন আগে ডেঙ্গু আক্রান্ত হন কাইয়ুম।
“এর আগে বাইরে চিকিৎসা দিছিলাম, ডাক্তার স্যালাইন দিত, বাসায় নিয়া দিতাম। কিন্তু আমার ছেলে কিছুই খাইতে পারে না, খালি বমি করে দেয়। এজন্য হাসপাতালে নিয়া আসছি। আমাদের এলাকায় মশা বেশি দেখি না, দুয়েকটা হয়ত কামড় দিছে,” বলেন সেলিনা।
সাভারের আশুলিয়ার একটি পোশাক কারাখানার কর্মী আজগর হোসেন তিনদিন ধরে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি। তিনি বলেন, সপ্তাহখানেক আগে প্রচণ্ড শরীর ব্যথার সঙ্গে জ্বর আসে। স্থানীয় চিকিৎসকের পরামর্শে পরীক্ষা করালে ডেঙ্গু ধরা পড়ে। প্রথমে আশুলিয়ার মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। অবস্থার অবনতি হলে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি হন।
“প্রচণ্ড মাথা ব্যথা হয়, যন্ত্রণা করে, শোয়া থেকে উঠতে পারি না। চোখে রক্ত জমছিল, শরীরের বিভিন্ন জায়গায় র্যাশ হইছে। আশুলিয়ার হাসপাতালে চারদিন ভর্তি ছিলাম। কিন্তু শরীর আরও খারাপ করায় সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে আইসা ভর্তি হইছি।”
বাড্ডার সাত বছরের শিশু তাহরিমা আক্তার রাইসা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মহাখালীর ডিএনসিসি হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। রাইসার মা পারভীন পলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে গত রোববার তার মেয়েকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছেন।
“জ্বর আর বমি ছিল। চারদিন জ্বরে ভুগছে, কিছু খাচ্ছিল না। ডাক্তারের পরামর্শে টেস্ট করাইলাম, দেখি ডেঙ্গু হইছে। এখানে শনিবার ভর্তি করাইছি। এখন অবস্থা আগের চেয়ে ভালো।”
নাখালপাড়ার দেড় বছর বয়সী আরাফাত হোসাইন রাফিও ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে।
রাফির নানী মানসুরা বেগম বলেন, “তার প্রচণ্ড জ্বর আসে। আর খিঁচুনিও হয়েছিল। খাওয়াদাওয়া করে না, এ কারণে হাসপাতালে নিয়া আসছি। এখন শরীর কিছুটা ভালো।”
ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল জহিরুল ইসলাম মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঢাকাসহ সারাদেশেই ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। এ অবস্থায় আমাদের হাসপাতালেও গত কয়েকদিন ধরে রোগী কিছুটা বাড়ছে।”
আশঙ্কা সত্যি হচ্ছে?
ঢাকায় মশার ঘনত্ব মাপতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল ও এইডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় গত ১৭ এপ্রিল থেকে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত জরিপ চালানো হয়। সে সময় ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৯৯টি ওয়ার্ডের ৩১৫২টি বাড়ি পরিদর্শন করেন জরিপকারীরা।
পরে ২৮ মে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, পরিদর্শন করা বাড়ির মধ্যে ৪৬৩টিতে এইডিস মশার লার্ভা এবং পিউপা পাওয়া গেছে; যা পরিদর্শন করা মোট বাড়ির ১৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ।
লার্ভা পাওয়ার শতকরা হার বা হাউস ইনডেক্স ১০-এর বেশি হলে মশার ঝুঁকিপূর্ণ উপস্থিতি বিবেচনা করা হয়।
সেদিন মশার এই উপস্থিতিকে উদ্বেগজনক বলেছিলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। তারা আশঙ্কা করেছিলেন, বর্ষায় এইডিস মশার ঘনত্ব আরও বাড়বে।
সেই জরিপের পর আর কোনো জরিপ করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। সে কারণে ঢাকায় বর্তমানে মশার উপস্থিতি কেমন তা জানা যায়নি।
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের সঙ্গে চুক্তির আওতায় নিয়মিত মশার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগ। সে অনুযায়ী প্রতি সপ্তাহে প্রতিবেদন দেওয়া হয় ডিএনসিসিকে।
বর্তমানে ঢাকায় মশার উপস্থিতি কেমন জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বলেন, চুক্তির শর্ত অনুযায়ী জরিপের তথ্য তিনি বাইরে প্রকাশ করতে পারেন না। তবে ঢাকায় এইডিস মশার বর্তমান উপস্থিতি ‘খুবই উদ্বেগজনক’।
মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমাদের পর্যবেক্ষণের যে ফলাফল তা খুবই উদ্বেগজনক, মশার লার্ভার উপস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ মাত্রার চেয়ে অনেক বেশি। এতে পূর্ণবয়স্ক এইডিস মশাও বেশি হবে।”
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বর্ষার পরে ডেঙ্গুর বিস্তারের আশঙ্কা তারা আগেই করেছিলেন।
কিন্তু বর্ষার পর ডেঙ্গুর প্রকোপ কেন বাড়ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “সাধারণত প্রচুর বৃষ্টিপাত হলে পাত্রগুলো মশার ডিম পাড়ার উপযোগী হয়। মশা সেই পাত্রের পানিতে ডিম দিলে তা থেকে মশা হতে লাগে পনের দিন, ডেঙ্গুর জীবাণু বহন করার উপযোগী হওয়ার জন্য আরও ১০ দিন সময় লাগে। সব মিলিয়ে ২৫-৩০ দিন। এটাকে আমরা বলি ‘ল্যাগ পিরিয়ড’। এ কারণে জুলাই-অগাস্টে বৃষ্টিপাতের পর ডেঙ্গু বাড়তে থাকে সেপ্টেম্বরের দিকে।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরশেনের স্বাস্থ্য বিভাগের একজন কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে ডিএসসিসি এলাকার হাসপাতালে ভর্তি রোগীর যে তথ্য দেওয়া হয় তা বেশিরভাগই ঢাকার বাইরের। আমাদের এখানে প্রতিদিন গত ৩০ থেকে ৪০ জন রোগী ভর্তি হচ্ছেন যারা ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এলাকার। গত বছরের এই সময় তা ছিল প্রায় ২০০ জনের মত। সে হিসাবে এবার ডেঙ্গু পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।”
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ওই কর্মকর্তা বলেন, “ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে ডিএসসিসি নিয়মিত কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। সোমবারও স্কুলের শিক্ষার্থীদের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে উদয়ন স্কুলে গিয়েছিলাম। এছাড়া আমরা প্রতিদিন সকালে লার্ভিসাইডিং, বিকেলে এডাল্টিসাইডিং করি।”