রাজ্জাকের চলে যাওয়ার দিনে লক্ষ্মী কুঞ্জে এক সন্ধ্যা

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি রাজ্জাকের মৃত্যুর পঞ্চম বছর পূর্ণ হল রোববার।

মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2022, 06:58 PM
Updated : 21 August 2022, 06:58 PM

‘নায়করাজ’ রাজ্জাক নেই, পাঁচ বছর হয়ে গেল, অথচ তাকে ছাড়া বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের কথা ভাবাই যায় না। রাজ্জাক পৃথিবীকে বিদায় জানালেও এখনও তরুণ শিল্পীরা তাকেই ‘আইডল’ মানেন।

রোববার ছিল বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের এই কিংবদন্তির পঞ্চম মৃত্যুবার্ষিকী। ‘তরুণ শিল্পীদের চোখে নায়করাজ রাজ্জাক’- এমন একটি প্রতিবেদন তৈরির ভাবনা থেকে বিকালে হালের নায়ক বাপ্পি চৌধুরীকে ফোন করে জানা গেল, তিনি রাজ্জাকের বাসায় যাচ্ছেন।

‘আমিও আসছি’ বলেই মহাখালী থেকে বেরিয়ে গুলশানে; শেষ বিকালে গরমের তেজ কমে আসছে। বাপ্পির গাড়িতেই যাওয়া হল লক্ষী কুঞ্জে, স্ত্রীর নামে গুলশানের এই বাড়ির নাম রেখেছিলেন নায়ক সম্রাট।

দারোয়ান বাপ্পিকে দেখেই ফটক খুলে দিল। বোঝা গেল, বাপ্পি প্রায়ই আসেন, তাই চেনা। জানতে চাইলে মৃদু হাসলেন বাপ্পি; বললেন, “প্রায়ই আসা হয়। সত্যি বলতে বাপ্পারাজ ভাই, সম্রাট ভাইদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে আনন্দ পাই। ভদ্র ও রুচিশীল দুজন মানুষ।”

কেয়ারটেকার ডেকে নিয়ে বসালেন ড্রইংরুমে। বেশ বড় ড্রইংরুম। তিন পাশে সোফা, দুটি টি টেবিল। দুটি শোকেস। সেগুলো ভর্তি পুরস্কার ও ক্রেস্ট। পাঁচ-ছয়টি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও সেখানে, যেগুলো রাজ্জাকের পাওয়া। দেয়ালে সাঁটানো কয়েকটি ছবি।

Also Read: রাজ্জাক: বাঙালি তারুণ্যের মানচিত্র

দু মিনিটও হয়নি, নায়করাজের ছোট ছেলে খালিদ হোসাইন সম্রাট এলেন। বসলেন পাশে। বাপ্পির মা অসুস্থ। কিছুদিন আগে ভারত থেকে চিকিৎসা নিয়ে ফিরেছেন। প্রথম দেখায়ই সম্রাট তাই বাপ্পির মায়ের কথাই জিজ্ঞেস করলেন। বাপ্পি জানালেন, এখন ভালো। তবে অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

কথার পিঠে কথায় জানা গেল, ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছিলেন বাপ্পির মা। সম্রাট বললেন, তিনি নিজেও ভুল চিকিৎসার শিকার হয়েছিলেন। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে দুজনার আলাপের মধ্যেই সম্রাটের স্ত্রী এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘চা না কফি?’ চায়ে মতৈক্য হল। বাপ্পি বিস্কুটও চাইলেন।

এরপর ড্রইংরুমে প্রবেশ নায়করাজের স্ত্রী খায়রুন্নেছা লক্ষ্মীর। বাপ্পি উঠে গিয়ে সালাম করলেন। তিনিও বাপ্পির মায়ের কথা জিজ্ঞেস করলেন। কিছুক্ষণ বসলেন, আলাপ করলেন। তাতে ঘুরে-ফিরে উঠে এল শরীর, স্বাস্থ্য আর চিকিৎসার কথা। চা এল, তবে বাপ্পির আবদারের বিস্কুট এল না। এল গরম গরম কাবাব আর কালোজাম।

এসব আলাপের ভিড়ে নায়ক রাজ্জাক কিংবা সিনেমার কথা আসছিলই না, অথচ সময় গড়াচ্ছে। কথা প্রসঙ্গে সম্রাট বললেন, “মৃত্যুর আগে সবার আচরণ বদলে যায়। একটু লক্ষ্য করলে সেটা বোঝা যায়। কিংবা মৃত্যুর পর এসব নিয়ে ভাবলে ধরা দেয়। যেমন বাবা মৃত্যুর আগের কয়েকদিন দেখি খুব বেশি বেশি আম খাচ্ছেন। একদিন বললাম, আপনি এত আম খাচ্ছেন। আপনার সুগার বেড়ে যাবে। স্বাস্থ্য বেড়ে যাবে। এর মধ্যে যদি কোনো সিনেমার কাজ শুরু করেন কীভাবে করবেন? বাবা বললেন, ‘ওজন কমিয়ে নেব’।

“বাবা জীবনেও ফ্রাইড চিকেন খেতেন না। একদিন আমাকে বললেন, ‘আমার জন্য ফ্রাইড চিকেন আনো তো’। আমি ও আমার স্ত্রী অবাক। আনলাম। বাচ্চাদের সঙ্গে আনন্দ নিয়ে ফ্রাইড চিকেন খেলেন। এভাবে আরও অনেক অদ্ভুত আচরণ করেছেন বাবা। আমরা পরে মিলিয়ে দেখেছি এগুলো তিনি আগে করেননি।”
সম্রাটকে জিজ্ঞেস করলাম, পাঁচ বছর আগের এই দিনে, ঠিক এই সন্ধ্যার সময়টায় কী করছিলেন?

Also Read: বাংলাদেশের 'নায়করাজ' রাজ্জাক

তিনি বললেন, “এই সময় হাসপাতালে সবাই অপেক্ষা করছিলাম। ডাক্তার ডেকে জানালেন ‘আব্বা নাই’। আমরা অপেক্ষা করছিলাম। তাকে নিয়ে যাওয়া হলো। ঠিক এই সময়টায় তার গোসল দেওয়া হচ্ছিল। খুব শকিং একটা সময় ছিল। যার বাবা চলে গেছেন তারাই কেবল অনুভূতিটা বুঝতে পারবেন। কী কষ্ট লাগে। সে সময়টায় কোনো কিছু বুঝে ওঠা যায় না। মেনে নেওয়া যায় না। কোনো বুঝই থাকে না মানুষের।”

জানতে চাইলাম সর্বশেষ কোন কথাটা বলেছিলেন আপনাকে- সম্রাট বললেন, “আমাকে ডাক দিয়ে নিয়ে বললেন, ‘আমার শরীরটা খারাপ লাগছে। ব্যথা করছে। আমাকে একটু ধর’। আমি ধরে দাঁড়ালাম। বললেন, ‘বসা আমাকে’। এরপর হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।”

নায়করাজ তার সন্তানদের কঠোর শাসনে রাখতেন। রুটিন মানতে হত সবাইকে। শুটিংয়ে বাইরে থাকলেও ফোন করে খোঁজ নিতেন। এই স্মৃতিগুলো বেশি মনে পড়ে বলে সম্রাটের।

বাপ্পি চৌধুরীর কাছে জানতে চাইলাম, “আপনার কোন স্মৃতিটা বেশি মনে পড়ে?” বাপ্পি বললেন, “তার সঙ্গে প্রথম সিনেমায় তিনি আমার বাবা ছিলেন। একটা শটের জন্য দাঁড়িয়েছি, তার লাঠিটা আমাকে নিয়ে আসতে হবে। আমি ভয় পাচ্ছিলাম। ফলে শটটা ঠিকঠাক হচ্ছিল না। নায়করাজ রাজ্জাকের সামনে, আর আমি এনজি (বাতিল) শট দিচ্ছি, এটা সবার জন্য কষ্টদায়ক। তখন পরিচালক শাহীন ভাই বললেন, ‘বাপ্পিরটা পরে করি। আপনারটা আগে শেষ করে নিই’। তখন রাজ্জাক সাহেব বললেন, ‘সমস্যা নেই। ছেলেটার চোখ কথা বলে। তুই শট নে। আমি আছি’। আমাকে ডেকে বললেন, ‘এই শোন, তুই এভাবে করবি। এভাবে তাকাবি। এটা মনে রাখবি’। আমার ভয় কেটে গেল। শটটা ঠিকঠাক শেষ হলো।”

“তরুণদের জন্য তিনি ছিলেন বিরামহীন শিক্ষক, এই বিষয়টা সবচেয়ে বেশি মিস করি,” বললেন বাপ্পি।

কথাবার্তা চলার মধ্যেই নায়করাজের বড় ছেলে বাপ্পারাজ এলেন। কুশল বিনিময়ের পর পাশেই বসলেন। চলচ্চিত্রের সঙ্কট নিয়ে নানা কথা বললেন। বাপ্পির সঙ্গে করা সিনেমা ‘নায়ক’-এর খবর জিজ্ঞেস করলেন।

মাগরিবের আজান হলো। দুইভাই একসঙ্গে উঠে গেলেন নামাজে। নামাজ থেকে ফিরে রওনা হলেন বনানী কবরস্থানে, সঙ্গী হলাম। প্রয়াত নায়কের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে তিন নায়ক দোয়া করলেন। সেই দোয়ায় যোগ দিলেন আওয়াল শেখ আফনান নামে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী, যার গ্রামের বাড়ি রংপুর।

কথা বলে জানা গেল, তিনি রংপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন নায়করাজ রাজ্জাকের কবর জিয়ারত করতে। বনানী কবরস্থান থেকে যখন বের হচ্ছি- শরতের ‘নীল আকাশের নিচে’ ‘পিচ ঢালা পথ’-এ তখন ‘আলোর মিছিল’। পেছনে রইল বাংলা চলচ্চিত্রের ‘রংবাজ’।