বাংলাদেশের 'নায়করাজ' রাজ্জাক

কখনও তিনি বলেননি, তিনি ওপারের মানুষ। ধ্যানে-জ্ঞানে বাংলাদেশের পর্দাতেই বেঁচেছেন তিনি।

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 August 2020, 11:40 AM
Updated : 23 August 2020, 04:02 PM

নায়ক-রাজ রাজ্জাক। যাকে একনামে ভালোবাসে এখনও বাংলাদেশের মানুষ। তার প্রয়াণে এদেশ হারিয়েছে এক দেশপ্রেমিককে। যিনি রুপালি পর্দায় নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন উজাড় করে। এই উজ্জ্বল নক্ষত্রকে নিয়ে শুধু বিশেষ দিবসেই লেখা যথেষ্ট নয়। রাজ্জাককে নিয়ে তাই এবার লিখলেন আরাফাত শান্ত।

নায়করাজ কেন রাজ্জাক?

কারণ তার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা কোনো পুরস্কার প্রাপ্তি বা কারও সার্টিফিকেট না।

তিনি একটা সিনেমায় রিক্সাচালকের অভিনয় করছিলেন। রিকশা চালানোর দৃশ্য ধারণ শেষ, তাও তিনি রিক্সায় বসা। এক মহিলা ডাক দিল। বাচ্চা-সহ স্কুলে যাবে। তিনি গেলেন ভাড়া ঠিক করলেন, মহিলা উঠল।

দূরে থাকা সিনেমার লোকজন কীভাবে জানি টের পেয়ে গেল বিষয়টা। থামালেন তারা, বললেন আপা করেন কি? ইনি নায়ক রাজ্জাক।

মহিলা জানাল আমি তো ভাবলাম রিক্সাচালক, আর উনিও তো কিছু জানালেন না, দিব্যি ভাড়াটারা বেশি চাইলেন।

নায়ক রাজ্জাকের কথায়, “সেদিন আমি বুঝেছেন আমি অভিনেতা হিসাবে সফল।”

তেমন আলোচনা আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই চলে যায় নায়ক রাজ্জাকের মৃত্যুবার্ষিকী। এটা হওয়ারই কথা। কাউকেই আমরা তেমন মনে রাখি না। মনে রাখার সব দায় এখন যারা তাকে ভালোবাসতো তাদেরকেই নিতে হবে।

আমি হিসাব করে দেখেছি রাজ্জাক সাহেবকেও আমি খুব ভালোবাসি না, যেমন নায়ক আলমগীরকে টিভির স্ক্রিনে ভালো লাগতো।

মাফলার সোয়েটার পরিহিত আলমগীর, নায়িকা রোজিনার সঙ্গে পাহাড়ের কোলে নাচছে, ব্যাপারটা ইন্টারেস্টিং লাগতো ছোটবেলাতেই।

রাজ্জাককে ভালোবাসতেন আমার বাবা। প্রচুর সিনেমা দেখেছেন হলে বসে। রাজ্জাককে খ্যাতিমান পুরাতন অভিনেতা ছাড়া মনে রাখার তেমন কারণ নেই।

তবে মোটিভেশনের যুগে রাজ্জাককে নিয়ে আপনি অন্যভাবেও ভাবতে পারেন।

’৬৪ সালের রায়টে পশ্চিম বাংলা থেকে আসা এক ছেলে, যার নাকের অগ্রভাগ আগুনে পুড়ে যাওয়া, চেহারাও সেই অর্থে নায়কোচিত নয়, যে লোকটা বিটিভিতে প্রায় নিউজ প্রেজেন্টারের চাকরি নিয়েই নিয়েছিল, আট আনা ভাড়া বাঁচাতে ফার্মগেট থেকে গুলিস্তান হেঁটে যেত, কন্ঠে কলকাতার মুসলমানদের মতো কথা বলা।

কয়েকটা স্টুডিও মাত্র, তাতেই যেয়ে বসে থাকতো কাজের আশায়। সেই লোকের সব চেয়ে জনপ্রিয় নায়ক হওয়ার গল্প নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণার।

‘বেহুলা’ ছবির নায়কের চরিত্রে জহির রায়হান নেন রাজ্জাককে। রাজ্জাক পাঁচ হাজার টাকা পেয়েছিলেন ছবিটি করে। এরপর জহির রায়হানের ‘আগুন নিয়ে খেলা’ ছবি করে পেলেন সাত হাজার টাকা। রাজ্জাক পায়ের নিচে দাঁড়ানোর মতো মাটি পেলেন।

রাজ্জাক অভিনীত জহির রায়হানের ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য একটি মাইলফলক। এরই মধ্যে তিনি ‘আগুন নিয়ে খেলা’, ‘আবির্ভাব’, ‘এতটুকু আশা’, ‘কাচ কাটা হীরা’, ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ ইত্যাদি ছবি করে ফেলেছেন।

একাত্তরে এই মানুষটা মারাই যেত যদি না তিনি পাকিস্তানি মেজরের স্ত্রী তার এক উর্দু সিনেমায় বোনের চরিত্রে অভিনয় না করতেন। জহির রায়হান আর তাকে ‘জীবন থেকে নেয়া’র সেট থেকে আটক করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়েছিল আর্মি।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে রাজ্জাক প্রায় অনেকদিন এক নাম্বার হিরো। তিনশত ছবি করেছেন। প্রযোজনা করেছেন কিছু ব্যবসা সফল ছবি।

আলমগীর কবিরের ভাষায় বলতে হয়, “এফডিসির বাণিজ্যিক মসলা সিনেমার ভেতর থেকে বের হতে পারেন নাই। আন্তর্জাতিক সেরকম ডিরেক্টরের সঙ্গে ছবি করেননি, সেরকম ইন্ডাস্ট্রিও আমরা গড়ে তুলতে পারিনি। লোকাল পরিচালকদের মেলোড্রামা মার্কা সিনেমা করে করেই উনার দিন গেছে। তবে আমার প্রিয় হল নায়ক রাজ্জাকের লিপের গানগুলো, এত শ্রুতিমধুর গান আর কারও সিনেমায় ছিল না। তিনি নাকি তার গানের রেকর্ডিংয়ের দিন শিল্পীর আগে গিয়ে বসে থাকতেন স্টুডিওতে। যাত্রার ঢং মার্কা সিনেমাতেও তার সহজাত অভিনয় ছিল। স্পন্টেনিয়াস থাকতেন সব সময়। তারকাদের বই পড়তেন, তাদের জীবনের কথা পড়ে হয়ত নিজেকেও সেরকম ভাবতেন। উত্তম কুমারের অনুসরণ করাটা তার হবি ছিল হয়ত। এত বড় তারকা হওয়ার পরও তার স্ক্যান্ডাল ছাড়া জীবন ও পরিমিতিবোধ ছিল অবাক হওয়ার মতো ব্যাপার। কিছুদিন তিনি কলকাতাতে সিনেমা করেছিলেন। খুবই সম্মান পেতেন, হিরোর মতো ট্রিট করা হত তাকে।”

দীর্ঘ অভিনয় জীবনে অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। এর মধ্যে আছে স্বাধীনতা পদক (২০১৫), পাঁচবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (সেরা অভিনেতা), মেরিল-প্রথম আলো আজীবন সম্মাননা ২০১৪।

‘রাজ্জাক সাহেব’কে কালজয়ী অভিনেতা হিসেবে হয়ত অনেকেই মনে রাখবে না। তবে গণ-মানুষের নায়ক হিসেবে তিনি হৃদয়ে থাকবেন। বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই।