ক্যারিয়ারের ৩৫ বছর পাড়ি দেওয়া এই শিল্পী এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এমনও সময় গেছে যে প্রায় দিনরাত কাজ করে একদিনে ২৮ গান তিনি রেকর্ড করেছেন।
Published : 20 Mar 2023, 01:13 PM
হিন্দি সিনেমার গান যাকে বানিয়েছে উপমহাদেশের ‘মেলোডি কিং’, সেই সংগীত শিল্পী কুমার শানুর উপলব্ধি, এখনকার হিন্দি গান শোনার যোগ্যতা হারিয়েছে।
প্রযোজক-নির্মাতা-পরিচালকেরা সংগীত শিল্পীদের কাজের ক্ষেত্রে নাক ‘গলিয়ে’ কাজের ‘ক্ষতি’ করছেন বলেও অভিযোগ করেছেন তিনি।
নব্বইয়ের দশকে হিন্দি সিনেমার গানের ‘দাপুটে’ এই শিল্পী কাজ করেছের অনু মালিক, নাদিম-শ্রাবণ, যতীন-ললিতের মত জনপ্রিয় সংগীত পরিচালকদের সাথে। ‘সাজন’, ‘বাজিগর’, ‘১৯৮৪: আ লাভ স্টোরি’, ‘দিল হ্যায় কি মানতা নাহিন’, ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘আকেলে হাম আকেলে তুম’ এবং ‘কুলি নম্বর ওয়ানের’ মত হিট সিনেমায় কুমার শানুর কণ্ঠ হয়ে ওঠে সিনেমার নায়কের কণ্ঠ।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ক্যারিয়ারের ৩৫ বছর পাড়ি দেওয়া এই শিল্পী বলেছেন, এমনও সময় গেছে যে প্রায় দিনরাত কাজ করে একদিনে ২৮টি গান তিনি রেকর্ড করেছেন।
এখন কাজের চাপ কমেছে, ৬৬ বছর বয়সে এসে শানু মনে করেন, সংগীত ছাড়া তার জীবন যাপন করাই দুষ্কর।
কুমার শানু তার শিল্পী জীবনের সূচনাকাল, উত্থান, আদর্শ, লক্ষ্য, কয়েক প্রজন্মের শিল্পী ও গানের পার্থক্য নিয়ে কথা বলেছেন। আরও বলেছেন, তিনি সবচেয়ে কম শোনেন নিজের গান। কারণ গান বাজলে নার্ভাস হয়ে ভাবতে বসেন, কোথায় কোথায় ভুল করেছেন তিনি।
প্রশ্ন: আপনার রেকর্ড করা গানের সংখ্যা কত জানা আছে?
কুমার শানু: ২১ হাজারের বেশি হবে। আমি ২৬টি ভাষায় গান করেছি। অনেক দেশে প্রোগ্রাম করার আগে দেখেছি নানা ভাষায় গাওয়া আমার গান বাজানো হচ্ছে । এ বছরেও কিছু কাজ আছে, ২২ হাজার ছাড়িয়ে যাবে আশা করি।
প্রশ্ন: ইন্ডাস্ট্রিতে ৩৫ বছর… পেছনে তাকিয়ে নিজের সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন কী?
কুমার শানু: অল্প কথায় বলা কঠিন। দিনগুলো চলে গেছে স্বপ্নের মত। তবে সে সময় সংগ্রামের কষ্ট বুঝিনি, এখন পারছি। মানুষের এত ভালোবাসা পাব, এখানে দাঁড়াব এসে ভাবিনি। প্রত্যয় ছিল, গান চালিয়ে যেতে হবে, আর সেই লক্ষ্য থেকে এক চুল নড়িনি। ওই জেদ আমাকে সাহায্য করেছে। তবে আমি কেন, যে কারো জন্যই সংগ্রামের সিড়ি না থাকলে লক্ষ্য অর্জন দূরের কথা, টিকে থাকাই দুষ্কর।
প্রশ্ন: সানু ভট্টাচার্য কীভাবে কুমার শানু হলেন?
কুমার শানু: সংগীত পরিচালক কল্যাণজি, আনন্দজি আমাকে এই নাম দিয়েছিলেন। কারণ মানুষ যাতে আমাকে কেবল বাঙালি গায়ক হিসেবে চিহ্নিত করতে না পারে। কারণ বাঙালিদের উর্দু উচ্চারণ ভালো ছিল না। বাঙালি গায়ক যারা ছিলেন, তারা উর্দুতে গান করলেও তাদের উচ্চারণে সমস্যা ছিল। কিন্তু আমার উর্দু ছিল শক্তপোক্ত। কিন্তু সেটি গান করার সময়, কথায় উর্দু টান আসত না। তাই তারা আমার নামের সঙ্গে শানু নামটি জুড়ে দেন, যাতে আমাকে কেবল বাঙালি গায়ক ভাবা না হয়।
প্রশ্ন: আপনার বাবা পশুপতি ভট্টচার্য নিজেও একজন সংগীত শিল্পী ছিরেন, কলকাতায় বেড়ে ওঠার আভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
কুমার শানু: আমি ছিলাম তবলাবাদক। বাবা আমাকে তার সঙ্গে বসিয়ে গান গাইতে বাধ্য করতেন। বাড়িতে বিশুদ্ধ শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চা হত। আমি ধীরে ধীরে ঝুঁকলাম বাণিজ্যিক গানে। চর্চা পর্ব কঠিন ছিল। প্রথমদিকে নিজের চর্চার ও লেখাপড়ার সময় ছাড়া বাকিটা সময় বাবার গান শুনতাম; বলা ভালো, শুনতে হত। আর বাইরে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে রেডিওতে হিন্দি গান শুনতাম।ওই হিন্দি গানগুলো খুব ভালো লাগতো। আমি মনে করি, সংগীত শিক্ষার গোড়াপত্তন ওই ‘শোনার’ মাধ্যমে আমার হয়েছে।
প্রশ্ন: ‘আশিকির’ আগের সময় কেমন ছিল?
কুমার শানু: মুম্বাইয়ে আসার ছয় দিনের মাথায় হোটেলে গান গাওয়া শুরু করি। রোজগারের ওই টাকা দিয়ে একটি ক্যাসেট তৈরি করি। এরপর গানের ওই ক্যাসেট নিয়ে সংগীত পরিচালকদের কাছে যাই। আমার উপর আর্শীবাদ ছিল যে, কোনোদিন টাকাপয়সার কষ্ট করতে হয়নি। ছয় কি সাত বছর হোটেলে গান গাওয়ার পর যখন ১৯৯০ সালে সিনেমা ‘আশিকি’ মুক্তি পেল, এবং তাতে আমার গান ‘সুপার হিট’ হল, তখন কিন্তু আমি একবারের জন্যও মনে করিনি আমি ‘তারকা’ হয়ে গেছি। আমার মনে হয় আমি আসলে বদলাইনি। আমার বন্ধু মহল পাল্টায়নি। শৈশব কৈশোরের বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিই, মাছ-ভাত দিয়ে একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া হাসাহাসি চলে। কখনও আমার শেকড়-অতীতকে ছেড়ে দিইনি।
প্রশ্ন: গান ছাড়া আপনার জীবন কল্পনা করতে পারেন?
কুমার শানু: না অসম্ভব। তাই হয় নাকি! গান ছাড়া সব শূন্য, ফাঁকা। আমি গান ছাড়া নিঃশ্বাস নিতে পারব না, আমার জীবন থেকে গান কেড়ে নিলে কি হবে আমি জানি না।
প্রশ্ন: কোন ধরনের গান শুনতে পছন্দ করেন?
কুমার শানু: লতাজি (লতা মঙ্গেশকর), কিশোর কুমার, মোহাম্মদ রফি– আমি পুরনোতেই আছি। একটা কথা বলা হয়নি আগে, সেটা হল শোনার ব্যাপারে এড়িয়ে চলি নিজের গান, ভয় লাগে ভুলগুলো যদি কানে বাজে! ইংরেজি গানও শুনি। কিন্তু আজকালকার হিন্দি গান একেবারেই শুনি না, কারণ শোন যায় না। এখন যেসব হিন্দি গান তৈরি হচ্ছে, সেগুলো শোনার মত নয়, তাই আমি শুনি না।
প্রশ্ন: নব্বইয়ের দশকে সব তারকাদের জন্য গান গেয়েছেন। সালমান বা শাহরুখের জন্য গান আলাদা করতেন কীভাবে?
কুমার শানু: এই কৃতিত্ব অভিনেতাদের। এটা সত্য যে রেকর্ডিয়ের সময় সংগীত শিল্পীদেরও কিছুটা অভিনয় করতে হয়। ধরুন, যখন সালমানের জন্য গেয়েছি, তার ব্যক্তিত্বটা মাথায় রেখে গাইতাম। তিনি কীভাবে পারফর্ম করবেন সেটা অনুমান করে গানের ‘ডেলিভারি’ দিতে হত। আর পর্দায় গানটা নিজস্ব করে নেন অভিনেতারা। তবে কোন গানে কোন তারকাকে বেশি উপভোগ করেছি, সেই বিচারে যাব না।
প্রশ্ন: নব্বইয়ের দশকে দেখা গেছে দিনে প্রায় চব্বিশ ঘণ্টা কাজ করেছেন? কীভাবে সম্ভব?
কুমার শানু: আপনি যদি ভাবেন আমাকে দিনে ১০টি গান রেকর্ড করতে হবে, হে ঈশ্বর কেমন করে করব! তাহলে কোন কাজ এগোবে না। চাপ মাথায় না নিয়ে চাপের কাজ করুন, ফায়সালা হয়ে যায়। তাই করেছি আমি। সব গান আবার এক স্টুডিওতে রেকর্ড হয় না, দৌড়াতে হত, ওই যাত্রা ক্লান্তিকর। তাই দিনরাত ধরে কাজ করার পর বাড়িতে পৌঁছানোর পর ক্লান্ত লাগত।
একটা উদাহরণ দিই। একদিন গুণে দেখা হল, দিনে আমি ২৮টি গান গেয়েছিলাম। সেটা সম্ভব হয়েছিল কারণ একটি স্টুডিওতে বসে কাজ করেছিলাম, তাই পেরেছিলাম।
প্রশ্ন: নব্বইয়ের সঙ্গে তুলনা টেনে কি বলা যায় আজ সংগীতে ভিন্নভাবে কাজ করা হচ্ছে?
কুমার শানু: পার্থক্য আসা স্বাভাবিক। আমি যত গান গেয়েছি, রেকর্ডিংয়ের সময় অভিনেতারা আসেননি। এর অর্থ কী? অর্থ হল অভিনেতারা তাদের উপস্থিতি দিয়ে গায়কের উপরে হস্তক্ষেপ করতেন না, ‘এটা করুন, সেটা হলে ভালো হত- বলে পরিবেশ জটিল করতেন না। গানের রেকর্ডিংয়ের দায়িত্ব কেবল সংগীত পরিচালক ও গায়ক-গায়িকাদের উপরে বর্তাতো।
‘হস্তক্ষেপ’ এখন বড় সমস্যা। এই কাজ প্রত্যেকে করছে। প্রযোজক, পরিচালক, অভিনেতা-সবাই। তারা সুরকারকে বলে বসে ‘আপনি শুধু গান তুলে দেন, বাকিটা দেখে নেব।’ কি দেখে নেবেন তারাই জানেন। আমাদের সময়ে গান নিয়ে আলোচনা কথাবার্তা শুধু সংগীত পরিচালকের সাথে হত।
দেখুন, আমি এখন শিল্পী, বা সিনেমা নির্মাণ সংশ্লিষ্টদের আত্মবিশ্বাসের অভাব দেখি। বহু গান আছে আট থেকে দশ জন মিলে গাইছে। সেখানে হয়ত দলগত বিষয়টির দরকার সেই। কিন্তু করা হচ্ছে। এখনকার নির্মাতারা বুঝতে পারেন না, কোন ধারাটি ধরে রাখা ভালো। এই পরিস্থিতিতে শিল্পী হিসেবে নিজেকে চিহ্নিত করা কঠিন।
প্রশ্ন: নাদিম-শ্রাবণ, যতীন-ললিত, অনু মালিকের মত সুরকার, সংগীত পরিচালকেরে সঙ্গে আপনার কাজের বন্ধন জোরাল ছিল। একেক জনের কাজের ধরন আলাদা। তাদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতেন কীভাবে?
কুমার শানু: একজন গায়ক বা গায়িকার আরেকটি দায়িত্ব হল সুরকারের নির্দেশ মত কাজ করা। আমি জানি নাদিম-শ্রাবণের ট্র্যাক কেমন, তাদের সঙ্গে তাদের ধরন বুঝে কাজ করার চেষ্টা করেছি। আনন্দ মালিক বা বাপ্পি লাহিড়ির সঙ্গে কাজের ক্ষেত্রে আবার তাদের স্টাইল অনুসরণ করেছি। তাদের উপর নিজেকে ছেড়ে দিয়েছি। আবার তারাও শিল্পীদের বৈশিষ্ট্য বুঝে সুর করতেন, কাজ করতেন। পারস্পরিক বোঝাপড়া ভালো হওয়া আসল কথা।
প্রশ্ন: ক্যারিয়ারে কোনো কাজকে এখনও সবচেয়ে কঠিন বলে মনে হয়?
কুমার শানু: হ্যাঁ আছে কিছু। সেই ৯৩-৯৫ সালের দিকের কথা। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিষয়, যা নিয়ে কথা বলতে চাই না তেমন এটা। তবে কাটিয়ে উঠেছি। এখন মনে করি, ওই সময়ে বুদ্ধিমানের মত সতর্কভাবে কাজ করেছি। ব্যক্তি ও পেশাগত জীবন আলাদা রেখেছি। স্টুডিওতে যখন পা রেখেছি, বাড়ির সমস্যা ঘরের দরজার সুইচ বন্ধ করে ঢুকেছি। নিজেকে বলেছি, গান ছাড়া আর কিছু মনে নেই। আমার জগত হল স্টুডিও ঘর, সংগীত পরিচালক, সহকর্মী এবং একটি মাইক্রোফোন।