হ্যারি বেলাফন্টে: অধিকার আদায়ে সংগ্রামী তারকার চির বিদায়

যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকারের আন্দোলনে ভূমিকাকে এই শিল্পীর বর্ণাঢ্য জীবনের ‘বড়’ অর্জন হিসেবে দেখা হয়।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 April 2023, 06:24 AM
Updated : 26 April 2023, 06:24 AM

যুক্তরাষ্ট্রের গায়ক, নাগরিক অধিকারকর্মী ও অভিনেতা হ্যারি বেলাফন্টে মারা গেছেন।

মঙ্গলবার ম্যানহটনে নিজের বাড়িতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে ৯৬ বছর বয়সী এই শিল্পীর মৃত্যু হয় বলে তার মুখপাত্র কেন সানশাইন জানিয়েছেন।

বিবিসি জানিয়েছে, ইতিহাসের অন্যতম সফল আফ্রিকান-আমেরিকান এই অস্কার জয়ী পপ তারকার ‘আইল্যান্ড ইন দ্য সান’, ‘মেরি’স বয় চাইল্ড’সহ আরও কয়েকটি গান এখনও মানুষের মুখে মুখে ফেরে।

যুক্তরাষ্ট্রে কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক অধিকারের আন্দোলনে রাখা ভূমিকাকে এই শিল্পীর বর্ণাঢ্য জীবনের ‘বড়’ অর্জন হিসেবে দেখা হয়।

তার মৃত্যুতে শোক জানিয়ে অপরাহ উইনফ্রে সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছেন, “আমাদের সবার কাছে একজন নায়ক ছিলেন আপনি। আপনার সংগীত, শিল্পী মন, আপনার কাজ, নাগরিক অধিকার এবং ন্যায়বিচারের জন্য আপনার লড়াইকে ধন্যবাদ জানাই। আপনি ছিলেন পৃথিবীতে এক আশীর্বাদ।“

গায়ক ও গীতিকার জন লেজেন্ড বলেছেন, "আমাদের ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে হবে যে আমরা ৯৬ বছর ধরে হ্যারি বেলাফন্টেকে পেয়েছি। তিনি অনেক কিছু দিয়েছেন, অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে বেঁচে আছেন এবং একটি জাতি এবং বিশ্বের উন্নতিতে তার ভূমিকা আছে।“

অভিনেত্রী মিয়া ফ্যারো এক টুইটে বেলাফন্টেকে 'সুগায়ক' এবং ‘আদর্শবাদী ও যত্নশীল মানুষ' হিসেবে বর্ণনা করেছেন।

তিনি বলেন, "আমরা যদি তার মত হতে পারতাম, তবে এটা চমৎকার একটা পৃথিবী হতে পারত।"

যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের নেতা মার্টিন লুথার কিংয়ের মেয়ে বার্নিস ইনস্টাগ্রামে বেলফন্টেকে নিয়ে ‘আবেগঘন’ পোস্ট দিয়েছেন।

লিখেছেন, “আমার পরিবারের জন্য সহানুভূতিশীল মানুষ ছিলেন তিনি। আমার এবং আমার ভাইবোনদের ছেলেবেলায় দেখভাল করেছেন, আমাদের অনেক দায়িত্ব নিয়েছেন। ওপারে ভালো থাকুন স্যার। আপনাকে ভুলব না।“

ব্যক্তি জীবনে তিনবার বিয়ে করেন বেলাফন্টে। তার প্রথম স্ত্রী অভিনেত্রী-মডেল শারি, এ সংসারে তার দুই সন্তান। সেই বিয়ে ভাঙার পর বিয়ে করেন জুলিয়া রবিনসনকে, এখানেও তার দুই সন্তান। তার তৃতীয় স্ত্রী পামেলা, যিনি মৃত্যুর সময় বেলাফন্টের পাশে ছিলেন।

বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার

‘কিং অব ক্যালিপসো’ খেতাবে ভূষিত বেলাফন্টে ১৯২৭ সালে নিউ ইউর্কের হারলেমে এক দরিদ্র ক্যারিবিয়ান অভিবাসীর ঘরে জন্ম নেন। লেখাপড়া ছেড়েছিলেন হাইস্কুলের গণ্ডি না পেরিয়েই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে মার্কিন নৌবাহিনীতে যোগ দিয়েছিলেন এই শিল্পী। নিউ জার্সির এক ঘাঁটিতে গোলাবারুদের ‘লোডার’ হিসেবে কাজ করতেন।

যুদ্ধ শেষে অভিনেতা হওয়ার স্বপ্ন নিয়ে নির্মাতা এরউইন পিসকাটোরের ড্রামাটিক ওয়ার্কশপে অভিনয় শেখায় মনপ্রাণ ঢেলে দেন বেলাফন্টে। সে সময় তার সঙ্গে অভিনয় শিখতেন মারলন ব্রান্ডো, ওয়াল্টার ম্যাথ ও টনি কুটিসের মত অভিনেতারা।

বেলাফন্টে অভিনয় শেখার খরচ তুলতেন নিউ ইয়র্কের বিভিন্ন ক্লাবে গান গেয়ে। ওই সময়ে মাইলস ডেভিস, চার্লি পার্কারের মত শিল্পীদের দলে তার জায়গা হয়েছিল।

গান গাইতে গাইতে একটি রেকর্ডিংয়ে চুক্তির সুযোগ আসে বেলাফন্টের। পরে মার্কিন লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে ফোক গানের আর্কাইভে পড়াশোনা শুরু করেন তিনি। 

বেলাফন্টের প্রথম অ্যালবাম আসে ১৯৫৪ সালে। এর পর চলে লোকগীতি, পপ আর জ্যাজ গাওয়া। অল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয় অ্যালবাম আনেন।

‘সুখ্যাতি’ এই শিল্পীর জীবনে এসেছিল আগেই। জনপ্রিয়তা আসে ১৯৫৬ সালে তৃতীয় অ্যালবাম ‘ক্যালিপসো’ প্রকাশে পরপরই।

বিলবোর্ডে শীর্ষস্থান দখল করে ‘ক্যালিপসো’। এটিকে যুক্তরাষ্ট্রে এক মিলিয়নের বেশি কপি বিক্রি হওয়া একক কোনো শিল্পীর প্রথম অ্যালবাম বলে মনে করা হয়।

ক্যারিয়ারে ৩০টির বেশি অ্যালবাম প্রকাশ করেছেন হ্যারি বেলাফন্টে। ১৯৫৩ সালে তার অভিনয়ের সুযোগ আসে ব্রডওয়েতে। সহচরিত্রে কাজের জন্য টনি অ্যাওয়ার্ডও জেতেন তিনি।

হলিউডেও ডাক পেয়েছিলেন বেলফন্টে। ‘আইল্যান্ড ইন দ্য সান’ চলচ্চিত্রে প্রধান চরিত্রে তিনি অভিনয় করেন, যেখানে তার সহ অভিনেতা ছিলেন জেমস ম্যাসন, জোয়ান ফন্টেইন এবং জোয়ান কলিন্সের মত শিল্পীরা।

১৯৫৭ সালে ‘লুক ম্যাগাজিনে’ তাকে প্রথম ‘কৃষ্ণাঙ্গ ম্যাটিনি আইডল’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়।

হ্যারি বেলাফন্টের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন মার্টিন লুথার কিং। বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের দৃঢ় সমর্থক ছিলেন বেলাফন্টে।

বিভিন্ন আন্দোলনে আর্থিক সহায়তার পাশাপাশি মার্টিন লুথার কিংসহ অন্য অধিকারকর্মীদের জেল থেকে ছাড়িয়ে আনতে জামিনের দায়িত্বও তিনি নিতেন।

নেলসন ম্যান্ডেলার সঙ্গেও হৃদ্যতার সম্পর্ক ছিল বেলাফন্টের। আফ্রিকায় দারিদ্র্য, বর্ণবাদ ও এইডসের বিরুদ্ধে প্রচারাভিযান চালিয়েছিলেন তিনি। উনিসেফের শুভেচ্ছাদূতও হয়েছিলেন।

একবার ইথিওপিয়ায় দুর্ভিক্ষের ওপর একটি সংবাদ প্রতিবেদন দেখে হ্যারি বেলাফন্টে সিদ্ধান্ত নেন, যুক্তরাষ্ট্রের শিল্পীদের একত্রিত করে গান গেয় দুর্ভিক্ষ পীড়িতদেরে জন্য তহবিল সংগ্রহ করবেন।

এ উদ্দেশ্যে ১৯৮৫ সালে তারকা সংগীত শিল্পীদের নিয়ে ‘উই আর দ্য ওয়ার্ল্ড’ শিরোনামে এক কনসার্ট আয়োজন করেন বেলাফন্টে, যেখানে মাইকেল জ্যাকসন, স্টিভ ওয়ান্ডার, ব্রুস স্প্রিংস্টিন, বব ডিলান, রে চার্লসের মত তারকারা একসঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন।

২০১১ সালে ন্যাশনাল পাবলিক রেডিওকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বেলাফন্টে বলেন, "অনেকেই আমাকে বলে, একজন শিল্পী হিসেবে আপনি অধিকারকর্মী হওয়ার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন? আমি তাদের বলি, আমি শিল্পী হওয়ার আগে অনেক দিন ধরে একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম।“

বয়স বাড়লেও বর্ণবাদ, বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ ছিলেন বেলাফন্টে। ২০০৬ সালে ভেনেজুয়েলার প্রেসিডেন্ট উগো চাভেসের সঙ্গে এক বৈঠকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশকে 'বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্ত্রাসী' আখ্যায়িত করে আলোচনার জন্ম দেন তিনি।

কাজের স্বীকৃতিতে বিনোদন জগতের চারটি বড় পুরস্কার, এমি, গ্র্যামি, অস্কার ও টনি অর্জন করা শিল্পীদের একজন বেলাফন্টে। এছাড়াও পেয়েছেন ‘কেনেডি সেন্টার অনার’, ‘ন্যাশনাল মেডাল অব আর্টস’সহ নানা পুরস্কার।