‘রুচির দুর্ভিক্ষ’ কাটিয়ে উঠতে সুস্থ সংস্কৃতির বিকাশের আহ্বান আবার জানিয়েছেন অভিনয়শিল্পী, নাট্যনির্দেশক ও সংগঠক মামুনুর রশীদ।
সোমবার ‘বিশ্ব নাট্য দিবস সম্মাননা ২০২৩’ গ্রহণের পর বক্তব্যে তিনি এ্ই আহ্বান জানান।
সম্প্রতি অন্য আরেকটি অনুষ্ঠানে মামুনুর রশীদ বলেছিলেন, “এখন রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে। এর মধ্য দিয়েই হিরো আলমের উত্থান হয়েছে।”
মামুনুর রশীদের বক্তব্যটি এরই মধ্যে সোশাল মিডিয়ায় তীব্র আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। হিরো আলমও এনিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন।
এর মধ্যেই নাট্য দিবসের অনুষ্ঠানে এসে মামুনুর রশীদ আগের অভিমতই প্রকাশ করেন।
তিনি বলেন, “আপনারা যারা স্যোশাল মিডিয়া ব্যবহার করেন, তারা দেখেছেন, আমার একটি উক্তি নিয়ে হাজার হাজার কমেন্ট হচ্ছে।
“আমি বলেছি, রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে- সেই দুর্ভিক্ষের মধ্য দিয়ে হিরো আলমের উত্থান হয়েছে। এই উত্থান জাতির জন্য আমাদের সংস্কৃতির জন্য ভয়ংকর। এই উত্থানের মূলে আমাদের রাজনীতি আছে, আমাদের মিডিয়ার একটা বড় ভূমিকা আছে।”
তিনি বলেন, “সোশ্যাল মিডিয়ায় আমাকে অনেকেই আমাকেও অভিযুক্ত করেছেন, যে এই রুচির দুর্ভিক্ষের জন্য আমরাও দায়ী। হ্যাঁ, আমরাও অবশ্যই দায়ী। কিন্তু যারা অভিযুক্ত করছেন, তারা জানেন না, আমরা যারা ৫০ বছর ধরে নাটক করছি, তারা কী কষ্ট করে রাতের পর রাত নিজের জীবনকে বিপন্ন করে রক্ত-ঘাম করে থিয়েটার করেছি।”
সোমবার সন্ধ্যায় ঢাকায় জাতীয় নাট্যশালা মিলনায়তনে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট (আইটিআই) বাংলাদেশ কেন্দ্র, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন ও পথনাটক পরিষদের যৌথ আয়োজনে বিশ্ব নাট্য দিবস পালিত হয়।
নাট্য দিবসের সম্মাননা পাওয়ার অনুভূতি জানিয়ে মামুনুর রশীদ বলেন, “আমার আজ মিশ্র প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। একাধারে আমি নাটকের জন্য সম্মানিত হচ্ছি। আবার অন্যদিকে নাটকের দর্শক ভীষণভাবে কমে গেছে। নাটকের দর্শক কমে গেল কেন?
“আমাদের পাশের দেশ ভারতের কলকাতায় একটা ছোট্ট শহরেও অনেকগুলো মঞ্চ আছে। কিন্তু আমাদের ঢাকা শহরে এই শিল্পকলা একাডেমি ছাড়া নাটক করার মতো আর কোনো মঞ্চ নেই। উত্তরা থেকে যে দর্শক নাটক দেখতে শিল্পকলা একাডেমিতে আসবে, তাকে ২ ঘণ্টার নাটক দেখার জন্য আরও ৪ ঘণ্টা যানজটে বসে থাকতে হয়। তাহলে এই ৫/৬ ঘণ্টা খরচ করে আর নাটক দেখতে অনেকেই আসতে চায় না।”
এই সমস্যার পাশাপাশি ‘নাট্য সংস্কৃতি’ গড়ে তুলতে না পারার কথাও বলেন প্রবীণ এই নাট্যকার-নির্দেশক-অভিনয়শিল্পী।
তিনি বলেন, “নাট্য সংস্কৃতির মধ্যে শুধু নাটকের লোক নয়, আমরা দর্শককেও রুচিবান করতে পারিনি। রুচির দুর্ভিক্ষ দর্শকের মধ্যেও হচ্ছে। তারা এখন যেসব নাটক বা অনুষ্ঠান পছন্দ করছে, আমরা সেই বিষয়গুলো কল্পনাও করিনি বা ভাবিনি। নাট্যসংস্কৃতির বিষয়টিকে এখন গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন।”
নাট্যদলগুলোর মধ্যে ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে মামুনুর রশীদ বলেন, “আমাদের মাঝে ছোট ছোট যে সংকট বা ঝামেলা, সেগুলো দ্রুত মিটিয়ে ফেলা ভালো। পৃথিবীটা এত বিধ্বস্ত, এত বিভক্ত। আমাদের সমাজ এত বিভক্ত, আমাদের রাজনীতি এত বিভক্ত।
“যে অনুষ্ঠানে আমি বলেছিলাম- ‘রুচির দুর্ভিক্ষ চলছে’ সেখানে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরও ছিলেন। যখন আমি বলেছি, আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিটা ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। তিনিও সেটা স্বীকার করেছেন।”
“থিয়েটারে আমরা বিভেদ চাই না, আমরা বৃহত্তর ঐক্য চাই। যাতে আগামী দিনে সমস্ত অনাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারি। আজকের বিশ্ব নাট্য দিবসে আমি আহ্বান করবো, যেন আমরা সবাই মিলে নাট্য সংস্কৃতিটাকে আরও সুদৃঢ় করতে পারি। আমাদের মাঝে ঐক্যটা ভীষণ জরুরি,” বলেন তিনি।
আনন্দ শোভাযাত্রা
এর আগে বিকাল ৫টায় বের হয় বিশ্ব নাট্যদিবসের বর্ণিল শোভাযাত্রা। একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সামনে থেকে বের হয়ে চারুকলা ভবনে গিয়ে শেষ হয় শোভাযাত্রাটি। পরে সন্ধ্যা ৬টায় একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা প্লাজায় আয়োজন করা হয় প্রীতি সম্মিলনীর। নাট্যশালার লবিতে ১৩ দফা দাবি জানিয়ে ব্যানার উপস্থাপন করে গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশন।
বিশ্বজুড়ে নাট্যকর্মী ও শিল্পপ্রেমীদের মাঝে ইতিবাচক সম্পর্ক তৈরি ও সৌহার্দ্য স্থাপন, নাটকের বার্তা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিয়ে এর শক্তিকে নতুন রূপে আবিষ্কারের লক্ষ্যেই প্রতিবছর দিবসটি পালন করা হয়ে থাকে বলে আয়োজকরা জানান।
সন্ধ্যা ৭টায় জাতীয় নাট্যশালার মূল হলে অনুষ্ঠিত হয় আলোচনা পর্ব। এ সময় বিশ্ব নাট্যদিবসের বাণী পাঠ, বিশ্ব নাট্যদিবসে জাতীয় বাণী পাঠ, বিশ্ব নাট্য দিবস সম্মাননা প্রদান এবং বিশ্ব নাট্য দিবসের বক্তৃতা পর্ব অনুষ্ঠিত হয়।
আলোচনা পর্বে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতি লিয়াকত আলী লাকী। মঞ্চে উপস্থিত ছিলেন নাট্যজন আতাউর রহমান, ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুস সেলিম, বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক চন্দন রেজা এবং বাংলাদেশ পথনাটক পরিষদের সভাপতি মিজানুর রহমান।
এবারে বিশ্বনাট্য দিবসের আন্তর্জাতিক বাণী প্রদান করেছেন মিশরের অভিনেত্রী ও সাংস্কৃতিক সংগঠক সামিহা আইয়ুব। অনুষ্ঠানে তার বাণী পাঠ করেন বাংলাদেশ গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতিমণ্ডলির সদস্য লাকী ইনাম। লিয়াকত আলী লাকী অনুষ্ঠানে জাতীয় বাণী পাঠ করেন।
বিশ্বনাট্যদিবসের স্মারক বক্তৃতা দেন অভিনয়শিল্পী মাসুদ আলী খান। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি উপস্থিত হননি, তবে ভিডিও বক্তব্য দিয়েছেন।
মাসুদ আলী খান বলেন, “নতুন প্রজন্মের উদ্দেশে বলব, তারা যেন নামের জন্য, খ্যাতির জন্য নাটক করতে না আসেন। নিবেদিত থেকে নাটক করেন। এখন যারা নাটক করতে আসেন, তাদের বেশিরভাগেরই উদ্দেশ্য থাকে কীভাবে টেলিভিশনে চান্স পাওয়া যায়। আমরা যখন নাটকে এসেছি, তখন টেলিভিশনের মোহ ছিল না।”
মঞ্চনাটকের জন্য আধুনিক মঞ্চ নির্মাণের দাবিও জানান তিনি।
সম্মাননা পেলেন যারা
আলোচনা পর্বের পর দেওয়া হয় বিশ্ব নাট্যদিবসের সম্মাননা। করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে গত তিন বছরে কোনো অনুষ্ঠান না হওয়ায় এবার বিগত বছরের সম্মননাও তুলে দেওয়া হয়। দেশের নাটকের অঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখায় বিশ্ব নাট্য দিবসে সম্মাননা তুলে দেওয়া হয় তাদের।
২০২০ সালের বিশ্ব নাট্যদিবসের সম্মাননাপ্রাপ্তরা হলেন নাট্যকার ও নির্দেশক মিলন চৌধুরী এবং অভিনেতা ও সংগঠক পরেশ আচার্য্য। ২০২১ সালে সম্মাননা পান অভিনয়শিল্পী প্রয়াত লিলি চৌধুরী। অনুষ্ঠানে লিলি চৌধুরীর পক্ষে সম্মাননা গ্রহণ করেন তার ছেলে আসিফ মুনীর। সম্মাননা তুলে দেন ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট বাংলাদেশ কেন্দ্রের সভাপতি অধ্যাপক আবদুস সেলিম।
২০২২ সালে মরণোত্তর সম্মাননা দেওয়া হয় অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার ও নির্দেশক মান্নান হীরাকে। মান্নান হীরার পক্ষে সম্মাননা স্মারক গ্রহণ করেন তার স্ত্রী সৈয়দা নাদিরা মান্নান।
২০২৩ সালের সম্মাননা গ্রহণ করেন অভিনয়শিল্পী, নাট্যকার ও নির্দেশক মামুনুর রশীদ। তাকে সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক ও গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনের চেয়ারম্যান লিয়াকত আলী লাকী।