‘জেমস’ যেন একটি অনুভূতির নাম

বাংলাদেশ তো বটেই উপমহাদেশের অন্যতম সেরা রকস্টার হিসেবে চলে আসে জেমসের নাম।

গ্লিটজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 Oct 2020, 04:45 PM
Updated : 3 Oct 2020, 04:45 PM

মাহফুজ আনাম জেমস যখন গানে গানে ভক্তদের কাছে ধরা দেন তখন কখনো ‘ক্যামেলিয়া হাতে এই সন্ধায়” স্মৃতিকাতর হয় তার কাছের মানুষ। আবার ’জোসি প্রেম’ মনে করে ভক্তরা হয়ে যায় আকুল!

এভাবেই জেমস যেন কোনও নাম নয়- বছরের পর বছর ধরে গানে- সুরে- ভাবনায় পরিণত হয়েছেন একটি অনুভূতিতে। আর প্রিয় শিল্পীর জন্মদিন উপলক্ষ্যে সেই অনুভূতিই শব্দে তুলে ধরলেন আরেক গীতিকবি শেখ রানা।

(১)

ফিলিংস।

সেলফ টাইটেল্ড অ্যালবাম। তার পর পরেই অনন্যা। জেমস এর প্রথম সলো। প্রচ্ছদে জেমস এর ক্যারিকেচার।

(২)

জেমস এর একদম শুরু থেকে আমার জেমস শোনা শুরু। তখন তো ফিলিংস। পরে যেয়ে ঐ অ্যালবামটাই 'স্টেশন রোড' নাম নিয়ে বের হয়েছিল সম্ভবত। খুব প্রিয় কিছু গান আছে। আমি এখনও শুনি। 'যদি এমন হতো কাশবনে', 'স্টেশন রোডে', 'দুঃখ কেন করো মন' আর 'আগের জনমে'।

আহা! আগের জনমে কী সুন্দর এক গান।

সেই থেকে জেমস এর গায়কীর ভক্ত হলাম। সাল-ক্ষণ ভুলে গেছি। হাইকোর্টে থাকি। বাসার একটা পুরোনো প্যানাসনিক টেপ রেকর্ডার এর দখল নিয়েছি ততদিনে।  সবাই কম বেশী গান শোনে। কিন্তু আমার কাছে খুব একটা পাত্তা পায়না কেউ। ৮৭-৮৮? বোধ করি সেই সময়ের কথাই বলছি।

(৩)

অনন্যা-র গানগুলো সব ইংরেজি গান এর সুরের উপর করা ছিল। ক্রিস ডি বার্গ এর 'সেইলর' হলো 'অনন্যা' আর কুইন এর 'আই ওয়ান্ট টু ব্রেক ফ্রি' - 'ঐ দূর পাহাড়ে'। আমি বাংলা শুরু করে ইংরেজি গান শোনা ধরেছি মাত্র। শুরুতেই অনেকের সাথে ক্রিস ডি বার্গ-ও দারুণ ভালো লেগে গেল। তবু অনন্যা-ই আমার কানে থেকে গেল। গান শুনি আর গলা ছেড়ে গান গাই। ভালোবাসায় যুক্তি বা আসল-নকল নিয়ে ভাববার অবকাশ কই!

(৪)

তারপর এক বইমেলায় জেল থেকে বলছি। নীল আকাশ। ভাবনার ল্যাম্পপোস্ট জ্বলছে। জোসি প্রেম। উড়ে যাওয়া বাকি শুধু...

ফিলিংস এর 'জেল থেকে বলছি' আমার সবসময়ের প্রিয় অ্যালবাম। প্রচ্ছদে শীর্ণ জেমস এর আপাদমস্তক রকস্টার চাহনী আর বড় অবিন্যস্ত চুলের সেই চেহারা। ধীরে ধীরে কয়েকটা নাম এর সাথে পরিচয় হলো। বাবু। ফান্টি। আসাদ। নাহ, আসাদ বোধহয় তার পরের অ্যালবামে এলো। নগর বাউলে?

রাজশাহীতে একবার নগর বাউল (ততদিনে নাম পরিবর্তন হয়ে গেছে) কনসার্ট করতে এলে কী- বোর্ডিস্ট আসাদ ভাই এর সাথে আমার বেশ ভালো পরিচয় হয়ে যায়। সে অনেক পরের কথা। আমি তখন তুখোর বোহেমিয়ান সময় কাটাই রাজশাহীতে।

(৫)

মজার স্মৃতি। ১৯৯৬ এর শেষের দিকে। ধানমন্ডিতে এখন যেখানে যাত্রা দাঁড়িয়ে তার আশেপাশে একটা কমিউনিটি সেন্টার। বড় আপার বিয়ে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ চারজন যুবক। হাসি-খুশী। দেখে মনে হয় জীবনে কোনো জটিলতা নাই, ভাবনা নাই, চিন্তা নাই। একজন এগিয়ে আসে আমার কাছে। আমি চট করে চিনে ফেলি। জেমস।

-'এখানে কোনো বাসা ভাড়া পাওয়া যাবে?'

আমি কোত্থেকে জানবো। আমি তো তখন বিয়ের রোস্ট খেয়ে উদাস। আরও একবার আমার ফেভারিট জর্দা কিভাবে খাওয়া যায় ভাবছি।

(৬)

'জেল থেকে বলছি' শুনে সেই যে মন্ত্রমুগ্ধ হলাম কথা-সুরের মায়াজালে। তা প্রবল গতিতে অব্যাহত থাকলো। কথার বৈচিত্রে, গলার ম্যাচিওরিটিতে আর গিটারের পরিমিত কিন্তু কানে লেগে থাকার বাদনে। এক ঘোর লাগা ব্লুজ বা রক। নাকি বলবো অল্টারনেটিভ রক?

(৭)

'দুঃখিনী দুঃখ করো না' অ্যালবাম বের হবার পর ব্যান্ড ঘরানার বাংলা গানের ইতিহাসে নিশ্চিত একটা পালাবদল হলো। একটা মাইলফলক গাঁথা হয়ে গেল। জিন্স আর পাঞ্জাবী সাথে একহারা চাদর। অভূতপূর্ব হিট অ্যালবাম। 'একজন বিবাগী'-র সেই জমাটি কম্পোজিশন, 'সুলতানা বিবিয়ানা'-র গিটার রিফ নাকি 'লুটপাট'- এর এক অদ্ভুত উদাস লুপ! জেমস এক অনতিক্রম্য উচ্চতায় চলে গেল। পথে-প্রান্তরে অনেক জেমস তখন। সেই জিন্স, বুট, সাদা পাঞ্জাবী আর চাদর। হাতে গিটার।  গান নিয়ে আমার দেখা সবচাইতে দুরন্ত ক্রেজ। ব্যান্ড সঙ্গীতের একজন রকারকে কেন্দ্র করে। সেই রকারের নাম জেমস।

(৮)

তারপর লেইস ফিতা লেইস নিয়ে এল নতুন ঝকমারী। তীব্র ঝাঁকি আর একবার। 'পথের বাপই বাপ রে মনা'-র সেই আকুলতা নাকি 'হাউজি'-র দৃশকল্প! 'সিনায় সিনায় লাগে টান' বলে সেই টান নাকি 'রাখে আল্লাহ মারে কে'-র আধ্যাত্মিকতা ! সাদা কালো প্রচ্ছদে আর একটা মাস্টারপিস।

(৯)

ততদিনে 'মা' গানটা সর্বকালের প্রিয় হয়ে সর্বশ্রেনীর শ্রোতার কানে পৌঁছে গেছে। আর একটু বাদে 'ঠিক আছে বন্ধু' বের হলো। কনসার্টের বিপুল জোয়ার যেন   ডোরস এর সময়কালে ফিরে গেল। লাল লাল চোখে ধোঁয়াশা। আর 'মীরাবাঈ'।

'আমি তোমাদেরই লোক' এর কথা না বললে এই ভালোবাসার অর্ঘ্য অপূর্ণ থেকে যাবে। 'আল্লাহু আকবার', 'যা কিছু বুঝেছ তুমি' আর 'দিল'- আমার প্লে লিস্টে সবসময় থাকে। জেমস এর আর এক তুখোর কম্পোজিশন।

(১০)

মাঝে দিওয়ানা, পাগলা হাওয়ার তরে বা এ রকম কিছু মিক্সড অ্যালবাম এর সময়কালে আমি গান শোনার প্রতি আগ্রহ হারিয়েছিলাম। ভালো করেছিলাম। তাতে কারো কিছু আসে যায় না। আমারও যায়নি। অনেক মিক্সড অ্যালবাম অনেক অর্থ এনে দিয়েছি। কিন্তু আর কিছু দেয়নি। অর্থ সবসময় অনর্থের কারণও না। আমাদের রুগ্ন অডিও ইন্ডাস্ট্রিতে অর্থের দরকার আছে।

(১১)

লন্ডনে কনসার্ট। পার্থ'দা, জেমস ভাই সহ অনেকে হাজির। ২০০৮ এর কোনো এক রাত। পার্থ'দার সাথে ব্যাপক আড্ডা শেষে বন্ধুত্ব হয়ে গেল। আর পরিচয় হলো নগর বাউল এর গিটারিস্ট রানার সাথে। ২০০৯ এ যখন ঢাকায় ফিরে গেলাম রানা একদিন ফোন দিল। বারিধারায় স্টুডিওতে যাওয়ার আমন্ত্রণ, লিরিক নিয়ে। আমি আগ্রহ করে গেলাম। জেমস ভাই খানিক পরে এলেন। বেশ কথা-টথা হলো। লিরিক দেখা হলো। তারপর গাড়িতে করে আমাকে গুলশান-১ গোলচক্করের কাছে নামিয়ে দিলেন। গান আর হলো না। পরে আর গানই হলো না নতুন! কিন্তু জেমস ভাই এর সাথে খুব সহজ আর সুন্দর সময় কাটালাম আমি। আমার মনে থাকলো। অথবা ভুলে গেলাম।

(১২)

আমার খুব মনে হয়, এই যে অন্তর্জালে জেমস ভাই থেকেও নেই, পত্রিকায় কালে-ভদ্রে উপস্থিতি এ সবই জেমস ভাই এর সাথে খুব যায়। কেমন লাগতো যদি জেমস ভাই অনলাইনে এসে তার একসময়ের গীতিকারকে হুমকি ধামকি দিচ্ছে তো নাম না নিয়ে এঁকে ওকে দুষছে অথবা পক্ষ-বিপক্ষে বেঁধে গেছে কলহ!

(১৩)

এক স্বার্থক রকারের ইমেজ নিয়ে লম্বা সময় ধরে  অসংখ্য সুন্দর গান উপহার দিয়ে যে মানুষটি দ্রোহ আর ভালোবাসার দ্বন্দ্ব আর দ্বন্দ্বমুখরতায় ভাবলেশহীন হয়ে আছেন, খুব নিজের মতন করে- সেই হলো আমাদের প্রিয় জেমস।

শুভ জন্মদিন, জেমস ভাই।

বাংলা গানের বেস্ট রকার...

-------------------------------

রকস্টারের জন্মদিনে', দুই।অক্টোবর। ২০, কার্ডিফ, ওয়েলস।