ক্যামেরা ধরলে সব ভুলে যাই: মাহফুজুর রহমান খান

সোমবার সন্ধ্যায় গ্লিটজের মুখোমুখি হলেন দশবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রাপ্ত সিনেমাটোগ্রাফার মাহফুজুর রহমান খান। বললেন নিজের ক্যারিয়ারের গল্প,বাংলা চলচ্চিত্রের উত্থানের গল্প।

সাইমুম সাদবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 April 2018, 07:31 AM
Updated : 3 April 2018, 07:48 PM

গ্লিটজ: সিনেমাটোগ্রাফির সঙ্গে যুক্ত হলেন কীভাবে?

মাহফুজুর রহমান খান: ১৯৬৩ সালের দিকে বাবা আমাকে একটি বক্স ক্যামেরা কিনে দিয়েছিলেন। ক্যামেরাটি দিয়ে শুরুতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের ছবি তুলতাম।ফটোগ্রাফিটা অনেকটা শখের বশেই ছিল।

পড়াশোনা শেষ করে আমার বন্ধুবান্ধব দেশের বাইরে চলে গেলেন তখন চিন্তা করলাম দেশের বাইরে চলে যাবো।

পরিচালক ইহতেশাম আমার আত্মীয়। উনারা বললেন, আমি বাইরে কেন যাবো? আমি ভাবলাম,যদি বলি সিনেমার পড়াশোনার জন্য দেশের বাইরে যাবো। তাহলেতারা আব্বাকে বুঝিয়ে বলবে।

আমার কথা শুনে উনারা বললেন, খুবই ভালো চিন্তা। তবে তার আগে আমার সঙ্গে কাজ করো কিছুদিন।তাহলে ক্যামেরার শট থেকে শুরু করে অন্যান্যকাজগুলো ভালো করে বুঝতে পারবে।তারপর দেশের বাইরে গিয়ে পড়াশোনা করলে ভালো ধারণা পাবে।

ওনাদের কথা মতো বিদেশে না গিয়ে কক্সবাজারে শুটিংয়ে গেলাম। হঠাৎ এক রাতে সিদ্ধান্ত নিলাম থাকব না।সে রাতে সিনিয়র ক্যামেরাম্যান আমাকে ম্যাগাজিনলোড করা শিখালো।

ডার্করুমে অন্ধকারের ইশারার উপর ম্যাগাজিন লোড করাটা আমাকে সিনেমাটোগ্রাফির প্রতি আগ্রহী করে তোলে।

সেদিনই আমি ম্যাগজিন লোড করা শিখলাম। পরদিন আমার লোড করা ম্যাগাজিনে শুটিং হলো। তখন আরও  বেশি ভালো লাগা শুরু হলো।

আমি সারাক্ষণই চিন্তা করতাম, কখন আরেকটা ম্যাগাজিন লোড করবো? ম্যাগাজিন লোড করার পর ক্লিক করে একটা শব্দ হয়।শব্দটি আমার খুব খুব ভালোলেগে গেল।

গ্লিটজ: কর্মজীবনে প্রখ্যাত চিত্রগ্রাহক আব্দুল লতিফ বাচ্চুকে গুরু মানেন আপনি। তার সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?

মাহফুজুর রহমান খান: তখন তো উনি খুব ব্যস্ত সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন। দেখা গেল একদিনেই এফডিসিতে একাধিক ফ্লোরে শুটিং চলে ওনার।

কোনো এক ফ্লোরে সবকিছু রেডি করে আমাকে দিয়ে চলে যেতেন। আমি কাজ করতাম। এভাবেই আমার কাজ শেখা।সবসময় উনি সহযোগিতা করেছেন, নানাপরামর্শ দিয়েছেন।

যেমন,কোন নায়ককে কোন লেন্সে ভালো লাগবে, কী ধরনের লাইট ব্যবহার করতে হবে, এগুলো বুঝিয়ে দিতেন।

 

গ্লিটজ: একজন  গুরুর হাত ধরে আপনার ক্যারিয়ারের যাত্রা শুরু।সিনেমাটোগ্রাফিকে গুরুমুখী বিদ্যা বলবেন? অথবা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখার গুরুত্ব কেমন বলেমনে হয় আপনার?

মাহফুজুর রহমান খান: এখন তো সিনেমাটোগ্রাফি নিয়ে অনেক ক্লাস হয়। আমি বলব, যারা বাইরে থেকে শিখে এসেছে তারা কিন্তু খুব ভালো করছে। আমি যখনসুযোগ পেলাম তখনই তো ক্যামেরাম্যান হয়ে গেলাম।

সিনেমাটোগ্রাফি শেখার জন্য প্রতিষ্ঠান কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমাদের সামাদ ভাই দেশের বাইরে পড়াশোনা করেছেন।উনি খুব ভালো কাজ করেছেন।

যারা পড়াশোনা করে তারা জানে, কোন লাইটটার কাজ কেমন, লেন্সের কাজের ব্যাপারেও স্পষ্ট ধারণা থাকে। আমার মনে হয়,আমি যদি পড়াশোনা করতেপারতাম তাহলে খুব ভালো হতো।

তবে আমার গুরুর প্রতি ধন্যবাদ। তার কারণেই আজ  আমি এতদূর অবধি এসেছি।

গ্লিটজ: শুরুতে আব্দুল লতিফ বাচ্চুর অধীনে সহকারি চিত্রগ্রাহকের কাজ করলেও আব্দুল বাশার চুন্নু পরিচালিত ‘কাঁচের স্বর্গ’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে প্রধান চিত্রগ্রাহকহিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। তখনকার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মাহফুজুর রহমান খান: সিনিয়ররা তখন খুব অনুপ্রাণিত করেছেন। আর আব্দুল বাশার চুন্নু ভাই একজন মুক্তিযোদ্ধা। খুবই ভালো মানুষ।

প্রথম কাজটা করলাম বিএল ক্যামেরায়। আশির দশকের পর থেকে একটু পরিবর্তন এলো ক্যামেরার কাজে।নব্বইয়ের পর ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ক্যামেরা এলো।মাঝখানে সিনেমাস্কোপেও কিছুদিন কাজ করেছি। শেষে তো ডিজিটাল ক্যামেরা এলো।

গ্লিটজ: ডিজিটাল ক্যামেরায় নিজেকে মানিয়ে নেওয়াটা চ্যালেঞ্জিং মনে করছেন?

মাহফুজুর রহমান খান: সময়ের সঙ্গে মানিয়ে নিতে হবে। যখন কেউ পেন্সিলে লেখা শিখে তখন কিন্তু সে কলমেও লিখতে পারে।শেখাটা খুব দরকার।

আমি কাজটা শিখেছি। সেকারণে আমি ব্ল্যাক অ্যান্ড হোয়াইট ও ডিজিটাল চলচ্চিত্রেই অভ্যস্ত।ডিজিটাল ক্যামেরায় যে কোনো দৃশ্য খুব সহজভাবে উপস্থাপন করাযায়।

গ্লিটজ: স্বাধীনতার পর থেকে বাংলা চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত আছেন। ঢালিউডের সামগ্রিক অবস্থা কেমন দেখছেন?

মাহফুজুর রহমান খান: বঙ্গবন্ধু আমাদের বলেছিলেন, বাইরের ছবি দেশে আসবে না। তখন ১২ শ’ সিনেমাহল ছিল। উনি একদিন বললেন,এতগুলো হলে ছবিসাপ্লাই দিতে পারবে? আমরা বলেছিলাম, পারব।

তখন এফডিসিতে চারঘণ্টা করে এক শিফটে কাজ করতেন আনোয়ার, রাজ্জাকরা। তাদের পরিশ্রমেই চলচ্চিত্র এমন জায়গায় এসেছে।

নব্বইয়ের আগ অবধি দেশের চলচ্চিত্রের অবস্থা ভালোই ছিল। দারুণ ব্যবসা করেছে তখনকার ছবিগুলো।

১৯৯৩ সালের পর চলচ্চিত্রে মন্দাবস্থা শুরু হয়। তখন বাইরের কিছু লোক এফডিসিতে ঢুকে পড়ে। লোকগুলো ব্যবসা করতে এসেছিল,তবে খুবই সস্তা ব্যবসা।সেটাই ছিল সংকটের কারণ।

এখন তো বাইরের ছবি এসেও খুব ভালো ব্যবসা করছে তাও না। এখন খুব দ্রুত ছবি নির্মাণ করছে। ছবি তাড়াতাড়ি নির্মাণ করা হয়,তাড়াতাড়ি ছবি হলে যায়,তাড়াতাড়ি নেমেও যায়।

ছবি তো দুই প্রকার। ফর দ্য মাস আর ফর দ্য ক্লাস। আমরা মাসের জন্য সিনেমা করেছি। তখন দেড় কোটি টাকার সিনেমা হয়েছে।

এখন তো দশ কোটি টাকার ছবি হওয়া উচিত। গতকাল ও আজকের চলচ্চিত্রের মধ্যে তাহলে পার্থক্য কী তাহলে?

পার্থক্যটা হলো ডিটেইলিংয়ে। তখনকার ছবিতে ডিটেইলিং ছিল। চরিত্রগুলো কেন কাঁদছে কিংবা চরিত্রগুলো কেন হাসছে-সেটার ডিটেইলিং ছিল তখনকারচলচ্চিত্রে।

হঠাৎ করে একটা ঘটনা চলে আসতেছে। ফিল্ম ইজ বিগার দ্যান লাইফ। আপনাকে ভালো চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে হবে।তবে অবশ্যই দর্শকদের টার্গেট করে।

গ্লিটজ: তখনকার নির্মাতা এখন নিয়মিত নয় কেন বলে আপনি মনে করছেন?

মাহফুজুর রহমান খান: এটা বলা খুব মুশকিল। হয়তো তারা সুযোগ পাচ্ছে না।

শুধু ছবি বানালে হবে না । আপনি ভালো ছবি বানিয়ে কোথায় দেখাবেন। দুটো তিনটা হলে ছবি চললে তো হবে না। কোথায় ১২’শ হল আর কোথায় দুই শ হল।

আগে একটা ছবি মানে ‘উই’। এখন হয়ে গেছে সবাই ‘আই’। সিম্পলি ‘আই’।

গ্লিটজ: এই অবস্থা থেকে উত্তরণের বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

মাহফুজুর রহমান খান: হলগুলোকে সবার আগে ঠিক করতে হবে।

গ্লিটজ: আপনি তো দেশের বাইরেও কাজ করেছেন?

মাহফুজুর রহমান খান: তামিলে কাজ করেছি। কাজ করেছি থাইল্যান্ডেও। ওখানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ ছিল।

আপনি হিরো হন কিংবা সুপাস্টার হন ডিরেক্টরই হলেন সবার উর্ধ্বে।সেটে আপনি ক্যামেরাম্যান হন কিংবা টেকনিশিয়ান হন সবারই খোঁজ রাখেন ডিরেক্টররা।

আমাদের এখানে ক্রুদের লেবার বলা হয়। যে চা দিচ্ছে সেও কিন্তু লেবার না।

গ্লিটজ: দশবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন আপনি। অনেকে বলছেন, সমসাময়িকদের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছেন...

মাহফুজুর রহমান খান: ফটোগ্রাফিটা আসলে অসীম। এখানে ডিরেক্টররা, আর্টিস্টরা ও সহযোগীরা সহায়তা করেছে বলেই এটা হয়েছে।

গ্লিটজ:আপনি সিনেমায় অভিনয়ও করেছেন। নিয়মিত হলেন না কেন?

মাহফুজুর রহমান খান:  আমার খুব দুর্বলতা ছিল সিনেমাটোগ্রাফিতে। জীবনের প্রথম উপার্জনটা ফটোগ্রাফি থেকে।

ক্যামেরা ধরলে সব ভুলে যাই। কাজ না থাকলেও মাঝে মাঝে সেটে যাই। এর চেয়ে আপন জিনিস পৃথিবীতে নাই।