দিনের বেশিরভাগ সময়ে আইয়ুব বাচ্চু তার স্টুডিও এবি কিচেনে কাটাতেন। এটিই ছিল তার অসংখ্য জনপ্রিয় গানের আঁতুড়ঘর।
Published : 18 Oct 2024, 09:14 AM
গানের শিল্পী, ছবি আঁকিয়ে বা লেখকরা নাওয়া খাওয়া জগত-সংসার ভুলে কাজে ডুবে যান, এটাই স্বাভাবিকভাবে ঘটে থাকে; তেমন ঘটনা ঘটেছিল প্রয়াত ব্যান্ডশিল্পী আইয়ুব বাচ্চুর জীবনেও। একটি গানের অ্যালবামের কাজ শেষ করার জন্য বাড়িমুখো না হয়ে, আলো-হাওয়া গায়ে না লাগিয়ে ছোট্ট স্টুডিওতে টানা ১৮ দিন কাটিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।
১৯৯৮ সালে প্রকাশ হওয়া ‘বারো মাস’ নামের ওই অ্যালবামের কাজ শেষ করে বাচ্চু তবেই স্টুডিও ছেড়েছিলেন।
ঢাকার মগবাজারের এলআরবির বহু গানের আঁতুরঘর ‘এবি কিচেন’ নামের স্টুডিওতে বাচ্চু গান না গেয়েও কেবল বিরতিহীনভাবে গিটারও বাজিয়ে কাটিয়ে দিতেন কোনো কোনো দিনের অর্ধেকটা সময়।
বাচ্চুকে নিয়ে গ্লিটজের কাছে এই গল্প বলেছেন এবি কিচেনে কাজ করা কর্মী মো. কুদ্দুস হাওলাদার; যিনি এই গায়কের সঙ্গে দীর্ঘ ২২ বছর কাজ করেছেন, থেকেছেন জীবনের শেষ পর্যন্ত।
বাচ্চু নেই ছয় বছর, তবে কুদ্দুস এখনো মগবাজার কাজী অফিসের গলিতেই থাকেন। সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা কুদ্দুস চালান একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর।
বাচ্চুকে ‘বস’ সম্বোধন করে ৫৪ বছর বয়সী কুদ্দুস গ্লিটজকে বলেন, "বাসা থেকে বেশি সময় স্টুডিওতে কাটাতেন তিনি। একবার অ্যালবাম বের হবে, কিন্তু হাতে সময় কম, কাজের চাপ ছিল, তাই ১৮ দিন স্টুডিওতে কাটিয়ে দিয়েছেন। খাওয়া-দাওয়া, গোসল ঘুমানো সব স্টুডিওতেই। ১৮ দিন পর বিকেলে আমাদের বলেন, আর পারছি না রে। তোরা অনেক কষ্ট করেছিস, কাজ শেষ, এবার বাসায় গেলাম।”
তখন কনসার্ট আর অ্যালবামের বাইরেও প্লে-ব্যাক এবং বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেল নিয়েও বাচ্চুর দারুণ ব্যস্ততা ছিল বলে কুদ্দুস জানিয়েছেন।
কুদ্দুস যে সময়ের কথা বলছেন তারও সাত বছর আগে ১৯৯১ সালের ৫ এপ্রিল আইয়ুব বাচ্চুর হাত ধরে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘এলআরবি’। যে দলটি কয়েক দশক করে দেশের ব্যান্ড সংগীতকে করেছে ‘সমৃদ্ধ’। একাধারে গায়ক, গিটারিস্ট, গীতিকার, সুরকার ও সংগীত পরিচালক বাচ্চু ভক্তদের কাছে পরিচিত ছিলেন ‘এবি’ নামে।
আড়াই দশকের বেশি সময়ে ‘আমি কষ্ট পেতে ভালোবাসি’, ‘একদিন ঘুমভাঙা শহরে’, ‘চল বদলে যাই’, ‘এখন অনেক রাত’, ‘বারো মাস’, ‘হাসতে দেখ গাইতে দেখ’র মত বহু গান শ্রোতাদের উপহার দিয়েছেন বাচ্চু। ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর বাচ্চুর মৃত্যুর পর থেকে খেই হারিয়েছে দেশে-বিদেশে সাড়া তোলা তার দলটি।
কনসার্টের মঞ্চে গিটারে ঝড় তোলা বাচ্চু এবি কিচেনে ঠিক কেমন ছিলেন তার কিছুটা জানা গেল কুদ্দুসের কাছে।
কুদ্দুসের ভাষ্য, গিটারে নতুন গানের সুর তোলা, অ্যালবাম বা কনসার্টের আগের প্রস্তুতি, গানের কারো সঙ্গে আড্ডা সবই চলত বাচ্চুর এই এবি কিচেন।
কুদ্দুস বলেছেন, ১৯৯২ সালের দিকে তিনি বাচ্চুর সঙ্গে কাজ করেন। তখন 'সুখ' শিরোনামের গায়কের ডাবল অ্যালবাম বের হয়েছিল। তবে সেই সময়ে ‘এবি কিচেন’ ছিল না। তাই সারগাম, সাসটেইন, ঝংকার, সিম্ফনি, অডিও আর্ট, সাউন্ড গার্ডেন নামের বিভিন্ন স্টুডিও ঘুরে ঘুরে কাজ করতেন বাচ্চু, সঙ্গে থাকতেন কুদ্দুস।
কুদ্দুসের কথায় জানা গেল প্রথম দিকে স্টুডিও পেতে বেগ পেতে হয়েছিল বাচ্চুর। কারণ তখন ব্যান্ড সংগীতকে পশ্চিমা সংস্কৃতি ভেবে অনেকে ‘ভ্রুকুটি করতেন’।
কুদ্দুস বলেন, "বস (বাচ্চু) তখন পশ্চিম মালিবাগে থাকতেন। উনার প্র্যাকটিসের ছোট একটা রুম ছিল। ওই রুমে জোরে সাউন্ড সিস্টেম চালিয়ে প্র্যাকটিস করতে পারতেন না। তখন বাসা ভাড়া পাওয়া যাইত না। ব্যান্ড সংগীতের শিল্পী শুনলেই অন্যরকম তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করত। এখন যে রকম চাহিদা আছে তখন এরকম ছিল না। ব্যান্ডের কথা শুনলেই মনে করতেন গানের উঁচু শব্দ হবে।
“এরপর যখন জনপ্রিয়তা ছড়াতে থাকে তখন স্টুডিওর জন্য রুম পাইতে আর সমস্যা হয়নি৷ স্টুডিও নেওয়ার পর আমরা গোছায় নিলাম।”
এবি কিচেনে বাচ্চুর দিনের শুরুটা কীভাবে হত জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঘুম থেকে জেগেই চলে আসতেন ‘কিচেনে’। প্রথমে অফিসে ঢুকেই ক্লিন হয়ে উনার চেয়ারে বসতেন। তারপর আমাদের কাজ ছিল চা আর এক গ্লাস পানি নিয়ে তার সামনে দেওয়া। কোনো কাজ থাকলে সেটা আমাদের দিয়ে করাতেন, আর যদি আমাদের কোনো কাজ না থাকত তাহলে নিজের প্যাডে বসে প্র্যাকটিস শুরু করে দিতেন।
“এক নাগাড়ে গিটার বাজাতেন, সুর তুলতেন। সব বাদ্যযন্ত্রের প্র্যাকটিস করতেন, তবে গিটার বাজাতেই বেশি পছন্দ করতেন৷ যখন বস কোনো গানের সুর তুলতেন আমরা দাঁড়িয়ে শোনার চেষ্টা করতাম। তখন তিনি জিজ্ঞেস করতেন আমাদের ভালো লাগছে কিনা।”
কাজের সময় স্টুডিওতে আসা কোনো দর্শনার্থীর সঙ্গে বাচ্চু কথা বলতেন না বলেও জানিয়েছেন কুদ্দুস।
“যদি কোনো গান তুলতে হত, তখন গান শেষ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আদেশ দিতেন কেউ আসলে যেন বলে দেই, উনি স্টুডিওতে নেই।”
স্টুডিওর কর্মীদের প্রতি বাচ্চুর ব্যবহার কেমন ছিল প্রশ্নে কুদ্দুস বলেন, “আমার জীবনে যদি বাপের পরে কারো জায়গা থাকে তিনি বস। এক সাথে খাওয়া, বিপদে আপদেতো ছিলেনই, অ্যালবামেও অনেক সময় এখানকার লোকের নাম থাকত।
“যারা উনার কাছে ছিল তারা জানত তার মন কত উদার ছিল। নিজে খাওয়ার আগে আমাদের খাওয়ার চিন্তা করতেন। বাইরে থেকে ওনারে বাঘের মত দেখাইলেও ভেতরটা নরম ছিল। মানুষের প্রতি মায়া ছিল।”
কখনো কর্মীদের সঙ্গে রাগারাগি করেননি? উত্তরে কুদ্দুস বলেন, “রাগ হলেও পরে আবার গায়ে হাত দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন। বলতেন রাগ করিস না, একটু অন্য টেনশনে ছিলাম। রাগ করিস না, মাফ করে দিস। এটা প্রত্যেকটা মানুষের ক্ষেত্রেই উনি করতেন।"