এবার ‘রবীন্দ্রপদকে’ ভূষিত করা হয় প্রয়াত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে।
Published : 25 Jan 2025, 11:02 PM
‘মানবতার শক্তির অভয় বাণীতে’ এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে শেষ হলো তিন দিনব্যাপি জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের ৪৩তম বার্ষিক সম্মেলন।
শনিবার বিকালে সমাপনী আলোচনা পর্বের পর সান্ধ্যকালীন সাংস্কৃতিক পরিবেশনার মধ্যদিয়ে পর্দা নামে এবারের আয়োজনের। প্রয়াত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে এবার ‘রবীন্দ্রপদকে’ ভূষিত করা হয়।
জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদের সহসভাপতি মফিদুল হক বলেন, “দেশ আজ সম্ভাবনা ও সংকটের দোলাচলে রয়েছে। মানুষের মাঝে মুক্তির যে আকাঙ্ক্ষা, তা বাস্তবায়নের বহু ধারা রয়েছে। রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ সেই ধারাকে এগিয়ে নিতে কাজ করছে।”
দেশের পাঁচ শতাধিক শিল্পী, সংস্কৃতিকর্মী ও সংগঠকের অংশগ্রহণে জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মেলন শুরু হয় গত বৃহস্পতিবার। ঢাকার ধানমন্ডির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবন মিলনায়তনে সম্মেলন উদ্বোধন করেন শিল্পী ফাহমিদা খাতুন।
‘এই কথাটা ধরে রাখিস মুক্তি তোরে পেতেই হবে’প্রতিপাদ্যে তিন দিনের সান্ধ্য-অধিবেশন সাজানো হয় গুণীজনের সুবচন রবিরশ্মি, গীতিআলেখ্য, আবৃত্তি, পাঠ, নৃত্য ও গান দিয়ে।
বার্ষিক অধিবেশন উপলক্ষে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির নানা দিক নিয়ে বিশিষ্টজনদের প্রবন্ধের সংকলন ‘সঙ্গীত সংস্কৃতি’ প্রকাশ করা হয় এবারও।
দ্বিতীয় দিন শুক্রবার বিকাল ৪টায় অনুষ্ঠিত হয় সেমিনার। বিষয় ছিল ‘বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথের বাংলাদেশ’।
শনিবার সমাপনী দিনের আয়োজন শুরু হয় সকাল ৯টায় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মধ্য দিয়ে। বুলবুল ইসলামের নেতৃত্বে সারাদেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা শহীদ মিনারে পুস্পার্ঘ্য অর্পণ করেন।
পরে সকাল ১০টায় ছায়ানট সংস্কৃতি-ভবন মিলনায়তনে হয় প্রতিনিধি সম্মেলন। মফিদুল হকের সভাপতিত্বে প্রতিনিধি সম্মেলনে আর্থিক প্রতিবেদন তুলে ধরেন কোষাধ্যক্ষ নাসেহুন আমীন।
প্রশিক্ষণ এবং প্রতিযোগিতা বিষয়ে বক্তব্য রাখেন বুলবুল ইসলাম ও লাইসা আহমদ লিসা। সারাদেশ থেকে আসা প্রতিনিধিরা নিজেদের শাখার বার্ষিক প্রতিবেদন পেশ করেন।
বিকালে সমাপনী অধিবেশনে শোক প্রস্তাব পাঠ করেন জহিরুল হক খান।
চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী বলেন, “আমি ছবি আঁকি। কিন্তু দেশের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের সব ঘটনা নিয়েই ভাবি।
“শুধু সংগীত নয়, দেশের চিত্রকলাসহ সব জায়গায় কিন্তু আমরা রবীন্দ্রনাথকে স্মরণ করি, ধারণ করি। আমি রবীন্দ্রনাথের গানের বড় একজন শ্রোতা। আমি ছবি আঁকার সময় রবীন্দ্রনাথের গান বাজিয়ে রাখি।”
সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লিলি ইসলাম বলেন, "এবার সম্মেলন শেষ হচ্ছে, কিন্তু আমাদের কাজ এখানেই শেষ নয়। সামনে আরও কাজের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই সম্মেলন ঘিরে যে মিলনমেলা, তার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানাই।”
মফিদুল হক বলেন, “বাঙালির এবং বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতির যে শক্তি, তার অন্যতম অবলম্বন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার সঙ্গে আমরা নজরুল, লালনকেও পাই। আরও অনেক মনীষী আছেন। তারা আমাদের এগিয়ে চলার প্রেরণা।”
গান বাঙালির জীবনে নানাভাবে জড়িয়ে আছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “গানের মাধ্যমে আমরা শক্তি পাই, সাহস পাই। সমাজের মাঝে জাগরণের প্রত্যয় নিয়ে কাজ করবে সম্মিলন পরিষদ। এই সম্মেলন থেকে আমরা একটা শক্তি পেলাম। মানবতার শক্তির অভয় বাণীতে এগিয়ে যেতে হবে।”
সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন খন্দকার খায়রুজ্জামান কাইয়ুম, মনসুরা বেগম, মেজবাহুল আলম, সুমা রায়, প্রকৃতি রায় সাঁঝ, ফাহিম হোসেন চৌধুরী, তাজমিনুর রহমান, রানা সিনহা, আব্দুলাহ আল মামুন, সিরাজুল সালেকীন, শম্পা আচার্য, বুলবুল ইসলাম, এ টি এম জাহাঙ্গীর, লাইসা আহমদ লিসা, তানিয়া মান্নান, বিথী পাণ্ডে, ঝুমা খন্দকার, পূরবী দে সেমন্তী, মৃদুল চক্রবর্তী, নুরজাহান বেগম শ্যামলীনা, মহাদেব ঘোষ, দিবাকর বিশ্বাস, শিমু দে, ইলোরা আহমেদ শুক্লা, আজিজুর রহমান তুহিন ও শামা জয়নাব।
লোকসংগীত পরিবেশন করেন চন্দনা মজুমদার, শ্রীকৃষ্ণ গোপাল এবং সাগর বাউল। দলীয় নৃত্য পরিবেশন করে নৃত্যশৈলী (সিলেট)। এছাড়া একক নৃত্য পরিবেশন করেন অমিত চৌধুরী, সুইটি দাশ ও তাথৈ।
পাপিয়া সারোয়ারকে ‘রবীন্দ্রপদক’
সমাপনী আয়োজনে রবীন্দ্রপদক ও গুণী সম্মাননা দেওয়া হয় রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ারকে। প্রয়াত শিল্পীর পক্ষে সম্মাননা নেন সারোয়ার ই আলম।
সারোয়ার ই আলম বলেন, “আজ একদিকে কষ্ট, আরেক দিকে প্রচুর আনন্দ হচ্ছে। পাপিয়া আছে আপনাদের মাঝে; তাকে যে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হল, তা সে হয়তো দেখছে। আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞতা।”
দীর্ঘদিন ক্যান্সারের সঙ্গে লড়াই করে গত বছরের ১২ ডিসেম্বর মারা যান একুশে পদকজয়ী রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী পাপিয়া সারোয়ার। বয়স হয়েছি ৭১ বছর।
অনুষ্ঠানে পাপিয়া সারোয়ারের পরিবারের পক্ষ থেকে ‘পাপিয়া সারোয়ার ট্রাস্ট’গঠনের প্রস্তাব দেয়া হয় সম্মিলন পরিষদের কাছে। এজন্য তার পরিবারের পক্ষ থেকে অর্থমূল্য দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
সম্মিলন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক লিলি ইসলাম বলেন, “আমরা পাপিয়া সারোয়ারের পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি।”
ঘোষণা
সমাপনী অধিবেশনে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন লাইসা আহমদ লিসা। গত বছরের আলোড়নময় ঘটনাবলীর পটভূমিতে বর্তমান সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে জানিয়ে ঘোষণায় বলা হয়, “আমরা জুলাই অগাস্টের উত্তাল সময়ে বিপুল প্রাণহানির জন্য গভীর শোক ও ক্ষোভ প্রকাশ করে সকল হত্যার নিরপেক্ষ সুষ্ঠু বিচার দাবি করছি।
“আমরা জাতীয় রবীন্দ্রসংগীত সম্মিলন পরিষদ আগের তিনটি ঘোষণায় সর্বগ্রাসী লোভের বিস্তারের ফলে সামাজিক অবক্ষয় এবং ধর্মের উগ্রবাদী ব্যাখ্যার সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলাম।
“বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতির সামাজিক-সাংস্কৃতিক অভিঘাত সম্পূর্ণ স্পষ্ট নয়। তবে উল্লিখিত নেতিবাচক প্রবণতাসমূহ প্রভাবশালী মহলের দ্বারা পরিপুষ্ট হওয়ার বিভিন্ন ইঙ্গিত লক্ষ্য করে আমরা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।”
ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের পর লালন, রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল এবং মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভাঙচুর অশনি সংকেত বহন করে বলেও ঘোষণাপত্রে তুলে ধরা হয়।
“এই শঙ্কায় যুক্ত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত জাতীয় সঙ্গীত পরিবর্তন, জাতিসত্তা ও ধর্মনিরপেক্ষতা বিষয়ে অনভিপ্রেত কৌশলী প্রস্তাবনা। আমাদের প্রত্যাশা, মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত আবহমান বাঙালি সংস্কৃতি ও মুক্তচিন্তার নির্বিঘ্ন পথযাত্রা নিশ্চিত হবে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায়।”
পুরনো খবর