লগ্না বলেন, “জানি না ঠিক কোন কারণে মাসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে সমর্থন করেছিলাম।“
Published : 07 Apr 2024, 11:49 AM
সত্তরের দশকের শেষ থেকে পরবর্তী তিন যুগ ঠিক কি কারণে নিজেকে অন্তরালে রেখেছিলেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, তা নিয়ে কৌতুহলের শেষ নেই। বয়স বাড়লে নায়িকার চেহারা কেমন দাঁড়িয়েছিল, তা জানতেও আগ্রহী ভক্তরা।
ভারতীয় বাংলা সিনেমার কিংবদন্তী এই নায়িকার চলচ্চিত্র ছাড়ার পরের জীবন আর স্বেচ্ছা গৃহবাসের সময়টার কিছু কথা জানিয়েছেন সুচিত্রার বোনের মেয়ে লগ্না ধর।
হিন্দুস্তান টাইমস লিখেছে, এক সাক্ষাৎকারে লগ্না বলেন, “কেউ যদি বলে থাকেন যে মাসির চেহারা শেষ বয়সে খারাপ হয়েছিল। তাহলে খুব ভুল বলেছেন। সাদা চুলেও মাসি ছিলেন সুন্দরী। এছাড়া সেই গ্রেসটা তো ছিলই।“
লগ্নার কথায় জানা গেল, বাড়িতে হেঁশেলের কাজ করার প্রয়োজন না হলেও বোনঝিকে একবার শখ করে ডিমের ডালনা রেঁধে খাইয়েছিলেন সুচিত্রা।
সুচিত্রার অন্তরালে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে লগ্না বলেন, “জানি না ঠিক কোন কারণে মাসি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। কিন্তু পরিবারের মানুষ হিসেবে আমরা প্রত্যেকে সমর্থন করেছিলাম। সব তারকা মধ্যগগনে থাকার পর এমন সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। কিন্তু মাসি পেরেছেন। দর্শকরাও তাকে সেই জায়গাতেই রেখেছে চিরটাকাল।“
১৯৩১ সালের ৬ এপ্রিল পাবনা শহরে সুচিত্রার জন্ম। ভারত ভাগের সময় পাবনা থেকে কলকাতায় থিতু হওয়া সুচিত্রার অভিনয়ের শুরুটা নাটকীয়।
‘নটীর পূজা’ নাটকে অভিনয় করে মুগ্ধতা ছড়িয়েছিলেন তিনি। পরে স্বামী-শ্বশুরের উৎসাহে সিনেমায় আসা। কিন্তু তার অভিনীত প্রথম ছবি ‘শেষ কোথায়’ মুক্তি পায়নি।
এরপর ‘সাত নম্বর কয়েদি’ সিনেমায় তার জীবনের মোড় ঘুরে যায়, সেই সঙ্গে ‘রমা দাশগুপ্ত’ তিনি হয়ে যান ‘সুচিত্রা সেন’।
এরপর আরেক কিংবদন্তি উত্তম কুমারের সঙ্গে ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ সিনেমা ‘সুপারহিট’। উত্তম-সুচিত্রার অনবদ্য জুটি দিনে দিনে আলো ছড়াতে থাকে।
ক্যারিয়ারের বড় সময়টায় সুচিত্রার সহঅভিনেতা ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের মহানায়ক উত্তম কুমার। উত্তম-সুচিত্রা জুটি ছাড়া কোনো ছবি ‘হিট’ হবে, এটা ভাবা নির্মাতাদের জন্য কঠিন হত। তারা ৩১টি সিনেমায় জুটি বাঁধেন।
কথা বলার ঢং, বাঁকা চোখের চাহনি, হাসির বিদ্যুৎ, চুলের স্টাইল, শাড়ি পরার ধরন, চলাফেরায় সেকালের নারীদের কাছে সুচিত্রা ক্রমশ অনুকরণীয় হয়ে ওঠেন। বলা হয়, আভিজাত্য ও ফ্যাশনে কয়েক প্রজন্মের প্রতীক হয়ে ওঠেন তিনি।
১৯৬৩ সালে ‘মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভালে’ সেরা অভিনেত্রীর সম্মান পান সুচিত্রা। ভারতীয় কোনো অভিনেত্রীর জন্য সেটাই ছিল বড় মাপের প্রথম আন্তর্জাতিক পুরস্কার। এছাড়া তিনি ভারত সরকারের পদ্মশ্রী খেতাব পান ১৯৭২ সালে; ২০১২ সালে পান পশ্চিমবঙ্গের সর্বোচ্চ পুরস্কার বঙ্গবিভূষণ।১৯৭৮ সালে ‘প্রণয় পাশা’ সিনেমায় অভিনয়ের পর আকস্মিকভাবেই সুচিত্রা চলে যান লোকচক্ষুর অন্তরালে। প্রথম সেই আড়াল ছেড়ে বাইরে আসেন মহানায়ক উত্তমকুমারের মৃত্যুর পর। আর শেষ জনসম্মুখে আসেন ১৯৮৯ সালে, তার গুরু ভরত মহারাজের মৃত্যুর পর।
২০০৫ সালে সুচিত্রাকে দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কারের জন্য মনোনীত করা হলেও ভারতের রাষ্ট্রপতির হাত থেকে পুরস্কার নিতে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে দিল্লি যেতে রাজি হননি তিনি।
তার মেয়ে চিত্রনায়িকা মুনমুন সেন, নায়িকা দুই নাতনি রিয়া ও রাইমা সেনও কখনও মুখ খোলেননি সুচিত্রার জীবনযাপন নিয়ে।
একান্ত ব্যক্তিগত চিকিৎসক, হাসপাতালের নার্স, পত্রিকার সাংবাদিক কেউ তার অন্তরালে থাকা নিয়ে বাড়াবাড়ি করেননি কখনও। স্বেচ্ছা নির্বাসনের বেশিরভাগ সময় তার কাটতো রামকৃষ্ণ মিশনের সেবায়। একবার জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরির সময় ছবি তোলার জন্য কেন্দ্রে যান সুচিত্রা সেন। কিন্তু সে কাজটিও খুব গোপনে সেরে চলে যান।
দুই যুগের অভিনয় জীবনে বাংলা ও হিন্দি মিলিয়ে ৬০টির বেশি সিনেমায় অভিনয় করা এই নায়িকা মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার অন্তরালের জীবন টিকিয়ে রাখতে পেরেছিলেন।
তার ইচ্ছা অনুযায়ী বেলভিউ হাসপাতালে তার কক্ষটিও ছিল কঠোর গোপনীয়তার ঘেরাটোপের মধ্যে। ২০১৪ সালের ১৭ জানুয়ারি মৃত্যু হয় মহানায়িকার।