বুনো লতায় সুসজ্জিত ফুল, যেন কেউ মালা গেঁথে রেখেছে।
Published : 14 Oct 2023, 10:21 AM
হৃদয় আকৃতির সবুজ পাতার মাঝে সারি সারি গোলাপী বুনো ফুল। সুদূর মেক্সিকো থেকে বাংলাদেশের বন-পাহাড়ে, এক অন্তহীন যাত্রার নাম অনন্তলতা।
বন্দর শহর চট্টগ্রামের পাঁজর ঘেঁষে উদ্ভিদ, লতাপাতা আর প্রাণ-প্রকৃতির এক আধার যেন পূর্ব রেলের সদর দপ্তর সিআরবি (সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং)। বড় বড় পরিচিত সব বৃক্ষের সাথে সেখানে আছে হারিয়ে যেতে বসা নানা প্রজাতির গাছ। নগরীতে অনন্তলতার খোঁজ মিলল সেখানেই।
সিআরবি পেরিয়ে যে পাহাড়ি পথ চলে গেছে হাতি বাংলোর দিকে, তার দু’পাশ সবুজে ঢাকা। বাঁ পাশে সবুজ ঘাসে ঢাকা পাহাড়ি ঢালে গাছপালা তুলনামূলক কম।
আর ডানের উপত্যকা চলে গেছে টাইগারপাসের দিকে। সেখানে গাছপালা এত ঘন হয়ে আছে, যেন একখণ্ড বন। মূল সড়ক ধরে জিএম বাংলোর দিকে এগোতেই ডানে দুটো রাস্তা উঠে গেছে পাশাপাশি।
পিচঢালা বড় রাস্তা ধরে কয়েক গজ গেলে ডানে দেখা যায় পাহাড়ের খাদ। খাদের কিনার ঘেঁষে একটি বাংলো। আর রাস্তাটা বাঁয়ে ঘুরে ঠিক যেখানটায় বন্ধ গেইটের সামনে থেমে গেছে, সেখানেই দেখা হল অনন্তলতার সাথে।
বন্ধ লোহার গেইটের ভেতরে ঝুলন্ত একাকী লতায় ফুটে থাকা কয়েকটি ফুল প্রথমে নজরে পড়ে। খুঁজতে খুঁজতে দেখা গেল, পাশে পাহাড়ি ঢালের গায়ে বড় একটা গাছের পুরোটাই গ্রাস করে নিয়েছে অনন্তলতা।
অনেক উঁচুতে ফুটেছে গোলাপী-সাদা সারি সারি ফুল। বুনো লতায় সুসজ্জিত ফুল, যেন কেউ মালা গেঁথে রেখেছে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ওমর ফারুক রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনন্তলতার বৈজ্ঞানিক নাম হলো Antigonon leptopus। ইংরেজি বিভিন্ন নামের ভিতর বহুল পরিচিত নামগুলো হল Mexican creeper, Mountain Rose vine, Love vine, Coral vine, Bee bush ইত্যাদি। এটা Polygonaceae পরিবারের বহুবর্ষজীবী লতানো উদ্ভিদ।
আদি নিবাস মেক্সিকোতে বলে এক নাম ‘মেক্সিকান ক্রিপার’। আর বাকি নামগুলোরও কারণ আছে। মূলত পাহাড়ের ধারে জন্মায়, তাই মাউন্টেইন রোজ ভাইন। পান পাতার মত (কিনারায় খাঁজ কাটা) সবুজ পাতার জন্য নাম ‘লাভ ভাইন’, বাংলায় প্রেমলতা। আর প্রবাল প্রাচীরে জন্মায়, তাই আরেক নাম ‘কোরাল ভাইন’।
অনন্তলতা বহুবর্ষজীবী, দ্রুত বর্ধনশীল এবং আরোহনকারী লতা। প্রতিটি লতা প্রায় ২৫ ফুট বা তার চেয়েও বেশি দীর্ঘ হতে পারে।
ভীষণ আগ্রাসী এই লতা অসংখ্য শক্ত আঁকশির মাধ্যমে অন্য গাছ বা মাধ্যমকে আঁকড়ে ধরে বাড়তে থাকে। যে গাছকে আশ্রয় করে বাড়ে, একসময় তার পুরোটাই দখল করে নেয় স্বর্ণলতার মত।
অনেক উঁচুতে ফুল দেখতে দেখতে দেখা মিলল মধুর খোঁজে আসা মৌমাছিরও। বেশ কয়েকটি মৌমাছি ফুলে ফুলে উড়ছিল। বোঝা গেল, ইংরেজিতে কেন এর আরেক না ‘বি বুশ’; আর বাংলায় মধুলতা নামেরও কারণ বোঝা গেল।
সুদূর মেক্সিকো থেকে কেমন করে বাংলায় এল অনন্তলতা? অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল বললেন, “ধারণা করা হয়, পানিতে ভেসে ভেসে এর বীজ আমাদের এই অঞ্চলে এসে বিস্তার করেছে। এর বীজ পানিতে ভেসে অনেক দূরে যেতে পারে।
“মোটামুটি আগ্রাসী ধরনের উদ্ভিদ, প্রতিকূল পরিবেশেও টিকে থাকে। উষ্ণমণ্ডলীয় পরিবেশ এই উদ্ভিদের পছন্দ। শীতকালে এর কাণ্ড মারা যায়, তবে শীতের প্রকোপ কমতে থাকলে মূল থেকে আবার নতুন চারা জন্ম নেয়।”
বলা হয়, গাছ কেটে ফেললে কিংবা পুড়িয়ে দিলেও মূল থেকে আবার নতুন করে যাত্রা শুরু হয় অনন্তলতার। আগ্রাসী চরিত্র আর বিশ্বজোড়া অন্তহীন যাত্রা যার, সেই তো অনন্তলতা।
বসন্তের শুরুতে, সাধারণত ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুর দিকে পুরো গাছ জুড়ে ফুল ফুটতে শুরু করে। তখন থেকে শরৎ, অর্থাৎ অগাস্টের শেষ পর্যন্ত, আবার কখনো কখনো শীতের শুরুতেও থোকা থোকা মাঝারি আকৃতির গোলাপী ফুল ফোটে।
বাংলাদেশে অনন্তলতার সাদা ফুলও ফোটে। তবে সাদা ভ্যারাইটি তুলনামূলক কম চোখে পড়ে।
অনন্তলতা এমন এক লতা, যার প্রায় সবকিছুই খাবার যোগ্য।
অধ্যাপক ওমর ফারুক রাসেল জানান, পৃথিবীর অনেক দেশেই এর কন্দমূল রান্না করে খাওয়া হয়। কন্দের স্বাদ অনেকটা বাদামের মত। অনন্তলতার ফুল ও বীজের চা ঠাণ্ডা-সর্দির দাওয়াই এবং ব্যথানাশক হিসেবে ব্যবহার হয়।
ডায়াবেটিসের জন্য এ গাছের পাতা উপকারী। কোথাও কোথাও এর পাতা রান্না করে খাওয়া হয়।
আরও পড়ুন