উপকূলে নারিকেল-সুপারি কি টিকে থাকবে?

“এখন সেসব স্মৃতি, হাট এখনও আছে ঠিকই, কিন্তু সেই জৌলুস আর নেই,” আক্ষেপ নিয়ে বললেন আল আমিন শেখ।

অলীপ ঘটক বাগেরহাট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2021, 07:01 PM
Updated : 2 Nov 2021, 07:03 PM

বাগেরহাট সদর উপজেলার খানপুর ইউনিয়নের পোলেরহাট এবং রামপাল উপজেলার বাইনতলা ইউনিয়নের চাকশ্রিরহাটে নারিকেল-সুপারির এক সময়ের জমজমাট হাট এখন আর না দেখে তার এই আক্ষেপ।

নারিকেল ও সুপারি বিক্রির টাকা দিয়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কেনার অর্থের জোগান ঠিক রাখত সাগর উপকূলের এই এলাকার মধ্য ও নিম্নবিত্তরা।

চাকশ্রি গ্রামের চল্লিশোর্ধ আল আমিন বলেন, বাড়ির বাগানের নারকেল, সুপারি নিয়ে হাটে বিক্রি করে সপ্তাহের বাজার খরচ মিটাত। জেলার বাইরে থেকে হাটে পাইকাররা আসত বড় বড় নৌকা নিয়ে। তারা হাটে নারকেল-সুপারি কিনে নৌকা ভরে চলে যেত।

দুই-তিন দশক আগের কথা স্মরণ করে বাগেরহাট সদর উপজেলার ষাটগম্বুজ ইউনিয়নের পশ্চিম সায়েড়া গ্রামের পঞ্চাশোর্ধ্ব বর্গাচাষি নিরাপদ পাল বলেন, “ধান ও মাছ চাষ করতাম। বাড়িতে নারিকেল ও সুপারির বাগান ছিল। হাটে নিয়ে বিক্রি করতাম। তা দিয়ে যে টাকা পেতাম, তা দিয়ে তেল, লবণ, মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রীর খরচ উঠে যেত।”

নব্বইয়ের দশকে আল আমিনের বাড়ির বাগানে দুই সহস্রাধিক নারিকেল ও পাঁচ সহস্রাধিক সুপারি গাছ ছিল। এখন সব মিলিয়ে আছে মাত্র একশ’র মতো নারকেল গাছ।

“বাড়ির নারিকেল ও সুপারি বাগান এখন মরুভূমি হয়ে গেছে,” বলেন তিনি।

পাশের এক্কোবরিয়া, বারইপাড়া, বাইনতলা, শরাফপুর, আলীপুর ও কাশিপুর গ্রামেও একই অবস্থা বলে তিনি জানান।

পশ্চিম সায়েড়া গ্রামের জিতেন পাল বলেন, “২০০৭ সালের সিডরের পর থেকে বেশিরভাগ নারকেল ও সুপারি গাছ মরে গেছে। নতুন করে গাছ লাগালেও তা বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়েছে। আর বাঁচলেও আগের মতো আর ফলন হয় না।”

নারিকেল-সুপারির ফলন কমে গেল কেন- প্রশ্নে আল আমিনের উত্তর আসে, “অতিরিক্ত লবণে।”

কী দেখছেন কৃষি কর্মকর্তারা

বাগেরহাট জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বাগেরহাট জেলায় ৩ হাজার ৬৫৩ হেক্টর জমিতে নারিকেলের আবাদ এবং ৪ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে সুপারির আবাদ হয়েছিল।

২০২০-২১ অর্থ বছরে আবাদ কমে নারিকেল ৩ হাজার ৬১৯ হেক্টরে এবং সুপারি ৩ হাজার ৮৯৭ হেক্টরে নেমে আসে। নারিকেলের উৎপাদন হয় ৩০ হাজার ৯৩৬ মেট্রিক টন এবং সুপারি ২৪ হাজার ৯০৮ মেট্রিক টন।

বাগেরহাট জেলার নয়টি উপজেলার সবকটিতেই কম-বেশি নারিকেল ও সুপারি গাছ ছিল। এখন অধিকাংশ উপজেলায়ই তা কমে গেছে।

বাগেরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের জেলা প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ মোতাহার হোসেন বলেন, ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডরের জলোচ্ছ্বাসে বিস্তৃর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়। এরপর থেকে এই এলাকার পানিতে লবণাক্ততা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যায়। নারিকেলের উৎপাদন কমে যাওয়ার এটি বড় একটি কারণ।

তিনি জানান, প্রতি বছরই উপকূলের এই এলাকা জোয়ারের পানিতে তলিয়ে যায়। নিয়মিত জোয়ারের পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা হয়ে মাটি অতি লবণাক্ত হয়ে পড়েছে।

“নারিকেল ও সুপারি গাছের জন্য লবণাক্ততা প্রয়োজন, তবে তা মাত্রারিক্ত হলে ওই গাছ মারা যাবে,” বলেন তিনি।

বাগেরহাট জেলার অধিকাংশ নদী খালে অবৈধ বাঁধ দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে মাছ চাষের কারণে নদী-খাল মরে গেছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। সেটাও নারিকেল ও সুপারি গাছ মরে যাওয়ার কারণ দেখাচ্ছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

অবশ্য বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান বলেন, সরকারি নথিভুক্ত নদী ও খালগুলোর অবৈধ বাঁধ বিভিন্ন সময়ে অপসারণ করছেন তারা।

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব?

গ্লাসগো সম্মেলন ঘিরে জলবায়ু পরিবর্তনের নিয়ে বিশ্বজুড়ে উদ্বেগের মধ্যে বাগেরহাটের নারিকেল ও সুপারি নিয়ে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদের গবেষণা ও পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিষয়টি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক রেজাউল ইসলাম বলেন, লবণাক্ততা উপকূলের কাছাকাছি ছিল, এখন বাড়তে বাড়তে উপকূলের ভেতরে চলে আসছে।

নারিকেল-সুপারির ফলন কমে যাওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এটা বেশি দেখা যাচ্ছে।

“আমরা নারিকেলে ‘মাইট’ পর্যবেক্ষণ করেছি- এটা খালি চোখে দেখা যায় না, অনুবীক্ষণ যন্ত্রে পর্যবেক্ষণ করতে হয়। ক্ষুদ্র মাকড় থেকে হয় এটা। এটা আসার পরে নারিকেলে প্রডাকশনে প্রভাব পড়েছে। ১০-১২ বছরে এসেছে, আগে ছিল না। সুপারি গাছের চেয়ে নারিকেলে এ সমস্যাটা বেশি।”

অধ্যাপক রেজাউল বলেন, “এখানে যে সমস্যা হচ্ছে, তার একটি হচ্ছে স্যালাইনিটি বেড়ে যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে সঠিক সময়ে বৃষ্টির ডিফারেন্স হচ্ছে। সব ঠিকঠাক মতো হচ্ছে না; কখনও বৃষ্টি বেশি হচ্ছে, কখনও কম হচ্ছে; কখনও শীতের সময় শীত কম হচ্ছে। এসব কারণে ডিসটার্বেন্স দেখা দিচ্ছে।”

বিষয়টির ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, “প্রতিকূল পরিবেশে রোগে সহজে আক্রমণ করে। নারিকেল গাছে অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে আর্দ্রতা বেড়ে যাচ্ছে, রোগের আক্রমণও বেশি হচ্ছে।”

নারিকেলে পোকার আক্রমণের যে বিষয়টি আগে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে বলে এই গবেষক জানান। 

“যেসব রোগ ও পোকা ছিল, যেগুলোকে ‘মাইনর’ বিবেচনায় নেওয়া হত, সেগুলো এখন ‘মেজর’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে, মাইট পোকার আক্রমণ বেড়ে গেছে, পাতা ভরে যাচ্ছে, ছত্রাক জন্মে কালো হয়ে যাচ্ছে। সব কিছু মিলিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে আবহাওয়ার পাল্টে যাওয়া প্যাটার্নে নারিকেল ও সুপারির ফলনে সমস্যা হচ্ছে।”

তার মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশে ঋতু বৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে যেভাবে অসময়ে বৃষ্টি হচ্ছে, উষ্ণতা বেড়ে যাচ্ছে, তাতে সার্বিকভাবেই কৃষির উপরেই বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

তবে বাগেরহাটে নারিকেল ও সুপারি গাছের ফলন কমে যাওয়া নিয়ে আরও সুনির্দিষ্ট গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপার্টমেন্ট অব প্লান্ট প্যাথলজির প্রধান ড. মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন।

তিনি বলেন, “তাপমাত্রা বাড়া এবং লবণাক্ততার বিস্তারে ফসলের ফলনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, সেটা স্বাভাবিক। তবে নারিকেল ও সুপারি গাছের ফলন কমে যাওয়া নিয়ে আরও সুনির্দিষ্ট গবেষণা প্রয়োজন।”

অবশ্য তিনিও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে যেসব রোগ ও পোকা ‘মাইনর’ হিসেবে রয়েছে, তা ভবিষ্যতে ‘মেজর’ রূপ নিতে পারে।

প্রতিকার কী?

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলেন, যেসব জমিতে নারকেল ও সুপারির গাছ রয়েছে, তার পরিচর্যা করতে হবে। প্রতি বছর নারকেল গাছ ঝুড়তে হয় এবং সুপারি গাছের গোড়ার মাটি কুপিয়ে উর্বর করে দিতে হবে।

কৃষিবিদ মোতাহার হোসেন বলেন, চারা লাগানো বাড়াতে হবে ও সঠিক পরিচর্যা করার পাশাপাশি কৃষকদের আরও সচেতন হতে হবে।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মো. রেজাউল ইসলাম বলেন, “আমরা কৃষকদের বিষয়টি এড্রেস করছি; কীভাবে তাদের এ পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারি, বিকল্প কী সাহায্য করতে পারি, এ নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং করেছি, অন্যদের সহযোগিতা নেওয়া হয়।”

“কৃষিকে বাঁচাতে উপকূলীয় এলাকায় বেশি নজর দেওয়া দরকার,” বলেন তিনি।