Published : 23 Aug 2023, 08:13 PM
এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে অবাধ যোগাযোগে দেশের দুই অর্থনৈতিক করিডোরের মধ্যে হিমালয়ের মতো বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঢাকা। এ বাধা অতিক্রম করতে ঢাকার চারপাশে বাইপাস সড়ক নির্মাণ করছে সরকার বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।
বুধবার এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট হাইলাইটস’ শীর্ষক একটি প্রকাশনার মোড়ক উম্মোচন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
এডিবির আবাসিক প্রতিনিধি এডিমন গিন্টিংয়ের স্বাগত বক্তব্যে শুরু অনুষ্ঠানে প্রকাশনার ওপর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনা তুলে ধরেন সংস্থাটির সিনিয়র কান্ট্রি স্পেশালিস্ট সুন চেন হং।
অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের সঙ্গে প্রতিবেশী ভারত, নেপাল ও ভুটানসহ পুরো অঞ্চলে অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়।
পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, বাংলাদেশে অর্থনৈতিক করিডোর হতে পারে দুইটা। একটা হতে পারে খুলনা থেকে ঢাকা হয়ে সুনামগঞ্জ। আরেকটা পঞ্চগড় থেকে ঢাকা হয়ে কক্সবাজার টেকনাফ পর্যন্ত। এই দুটি করিডোরই হবে অর্থনীতির মেরুদণ্ড।
তবে করিডোর দুটো ঢাকাকে কেন্দ্র করে হওয়ায় ঢাকার যানজট এটির পথে প্রধান বাধা হয়ে উঠতে পারে বলে তার আশংকা। এ বাধাকে তিনি হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেন।
তিনি বলেন, “আমি মনে করি মাঝখানে ঢাকা একটি হিমালয়ের মতো বাধা হতে পারে। এজন্য ঢাকার চতুর্দিকে বাইপাস করতে হবে। সরকারের কাজ হবে ঢাকার চতুর্দিকে কোথায় কীভাবে বাইপাস করতে হবে তা ঠিক করা।”
তিনি বলেন, “এ দুই করিডোরের দুটি বড় কাজ আমরা ইতোমধ্যেই করে ফেলেছি। একটি হচ্ছে উত্তরের জন্য করেছি বঙ্গবন্ধু সেতু আর সাম্প্রতিককালে আমাদের পদ্মাসেতু।”
তিনি বলেন, দেশে ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য এটা আমাদের সরকারের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত ডায়নামিক মানুষ। তিনি চান যে আরও বেশি করি আরও তাড়াতাড়ি করি।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক করিডোরের কাজ বেশি চলছে উল্লেখ করে পরিকল্পনামন্ত্রী বলেন, “প্রতিবেশীর সঙ্গেই বেশি ভালো সম্পর্ক থাকবে এটা অন্যায় কিছু নয়।”
হাওড় এলাকা সুনামগঞ্জের এই সাংসদ বলেন, দুই করিডোরের একটির উন্নয়নে চার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে হাওড়ের ওপর দিয়ে সুনামগঞ্জ থেকে নেত্রকোনা পর্যন্ত ফ্লাইওভার হচ্ছে। এছাড়া খুলনাকে কেন্দ্র করে কলকাতাসহ পশ্চিমবাংলা আবার পঞ্চগড়ের পশ্চিমে ভারত, নেপাল, ভুটানের সঙ্গে অর্থনৈতিক করিডোর হতে পারে।
তিনি বলেন, আবার সিলেট দিয়ে ভারতের সেভেন সিস্টারে বিশাল অর্থনৈতিক এলাকা আছে। সুতরাং সীমান্তে গিয়ে দাঁড়াবো কেন। কানেক্টিভিটি শুধু আমাদের ভেতরে নয়, বাইরেও আমাদের নিয়ে যাবে।
“রাজনীতিবিদরা সীমা-টিমা নির্ধারণ করেন নানা কারণে। ব্যবসা-বাণিজ্য সীমা মানে না।”
নিরাপত্তাজনিত কারণ ছাড়া আরও বেশি উদারতা নিয়ে সীমান্ত খুলে অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি করতে পারলে মানুষের আরও আয়ের পথ তৈরি হবে বলে মনে করেন এম এ মান্নান। এতে চোরাচালানও কমে আসবে বলে তার আশা।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শেখ ইউসুফ হারুন অর্থনৈতিক করিডোর শুধু দেশের সীমান্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ না হয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলেন। তা বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করবে বলে তিনি মনে করেন।
কৃষিভিত্তিক শিল্প, পর্যটন শিল্প গড়ে ওঠার পাশাপাশি পুরো অঞ্চলটি উন্নত বাজার হিসেবেও তৈরি হবে বলেও তার মত।
অনুষ্ঠানে এডিবির প্রকাশনা ‘বাংলাদেশ ইকোনমিক করিডোর ডেভেলপমেন্ট হাইলাইটস’ এর সংক্ষিপ্ত উপস্থাপনায় সংস্থার সিনিয়র কান্ট্রি স্পেশালিস্ট সুন চেন হং বলেন, ২০২০ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে পুরো করিডোর অঞ্চলের মধ্যে ৩ হাজার ২০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। যদি প্রতিযোগিতা সক্ষম অর্থনৈতিক করিডোর তৈরি করা যায় তাহলে ২০৫০ সালের মধ্যে তা ২৮ হাজার ৬০০ কোটি ডলারে উন্নীত করা যাবে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ করোনাভাইরাস মহামারীর প্রভাবের পরও গত ১০ বছরে গড়ে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি ধরে রেখেছে। এসময়ের মধ্যে বাংলাদেশ একটি স্বল্পোন্নত দেশ থেকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হয়েছে।
এর পেছনের দুটি কারণের একটি হিসেবে কম উৎপাদন খরচের কথা তুলে ধরেন তিনি। অপরটি হচ্ছে স্বল্পোন্নত দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশেষাধিকার পাওয়া।
স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উত্তরণ বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জের উল্লেখ করে সুন চেন বলেন, এরপর থেকে বাংলাদেশের শ্রম সুবিধা ক্রমান্বয়ে কমে আসবে। পণ্যের অগ্রাধিকারমূলক বাজার সুবিধাও কমে যাবে। একইসময়ে তথ্যপ্রযুক্তির পরবর্তী প্রজন্মের আবির্ভাব ২০৩০ সালের মধ্যে তিন কোটি মানুষের কর্মসংস্থান বাংলাদেশের জন্য বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে এসময়ের মধ্যে তৈরি পোশাক, চামড়ার মতো শ্রমঘন শিল্পে রোবোটিক্স ও অটোমেশন চলে আসবে।
এসব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার ক্ষেত্রে অবস্থানগত সুবিধা নিয়ে বাংলাদেশের আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডোর গড়ে তোলার বিষয়টি ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন তিনি।
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে অন্যান্য বিভাগে পর্যাপ্ত ভৌত ও সামাজিক অবকাঠামো গড়ে তোলার পরামর্শ দেন তিনি।
তিনি বলেন, বর্তমানে উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলাদেশের প্রধান পিছিয়ে থাকা অঞ্চল। এক্ষেত্রে খুলনা থেকে ঢাকা হয়ে সুনামগঞ্জ পর্যন্ত করিডোরটি দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল খুলনা থেকে উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সিলেট এবং ময়মনসিংহ বিভাগকে যুক্ত করবে। এ অঞ্চলের স্থলবন্দরগুলো ভারতের সঙ্গে প্রধান বাণিজ্য প্রবেশদ্বার হিসেবে কাজ করে, যা ভারত-বাংলাদেশ বাণিজ্যের ৩৬ শতাংশ অবদান রাখে।
একইভাবে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলো বাংলাদেশে রাবার, চুনাপাথর ও অন্যান্য খনিজ সম্পদ রপ্তানি করতে পারে। আর নেপাল ও ভুটানকে এ করিডোরে যুক্ত করে বাংলাদেশ লাভবান হতে পারে।