গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের বিরোধিতা গণশুনানিতে

ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম ৬৩ শতাংশ বাড়াতে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিইআরসির কাছে রাষ্ট্রায়ত্ত তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশন পেট্রোবাংলা যে প্রস্তাব দিয়েছে, তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে গণশুনানিতে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2022, 07:00 PM
Updated : 21 March 2022, 07:00 PM

ইউক্রেইনের যুদ্ধ ঘিরে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামবৃদ্ধির মধ্যে বাংলাদেশেও ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব নিয়ে সোমবার থেকে শুনানি শুরু করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন- বিইআরসি।

প্রথমদিনে পেট্রোবাংলা ছাড়াও সঞ্চালন কোম্পানি গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির সঞ্চালন চার্জ ৭০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাবের উপর শুনানি হয়েছে।

মূল্যবৃদ্ধির এ আয়োজনের সমালোচনা করে জ্বালানির দাম না বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম।

পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে ৯ টাকা ৩৬ পয়সা থেকে ১৫ টাকা ৩০ পয়সা করতে বলা হয়। বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন টিমের প্রাক্কলন হচ্ছে এটা ৩৩ শতাংশ বাড়িয়ে ১২ টাকা ৪৭ পয়সা করা যেতে পারে।

তবে দাম বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে নানা বিষয়ে প্রশ্ন তুলে এম শামসুল আলম বলেন, “দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে ভোক্তাদের আপত্তি রয়েছে।”

দাম বাড়ানোর প্রস্তাবের পক্ষে পেট্রোবাংলা যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে, সেসবের মধ্যে রয়েছে- দেশীয় ও বিদেশি কোম্পানিগুলোর গ্যাস উৎপাদনের ব্যয় বেড়েছে, খরচ বেড়েছে এলএনজি আমদানির। আমদানি ও ভোক্তা উভয় পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর উৎসে আয়কর পরিশোধেও ব্যয় বেড়েছে এবং এরসঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে পরিচালন খরচ। এছাড়া চলতি অর্থবছরে ৮৫০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানি করতে হলে ভোক্তা পর্যায়ে প্রতি ঘনমিটার বিক্রিমূল্য দাঁড়াবে ২০ টাকা ৩৫ পয়সা।

এসব কারণেই গ্যাসের দাম ৬৩ শতাংশ বাড়িয়ে প্রতি ঘনমিটার ১৫ টাকা ৩০ পয়সা করার প্রস্তাব বলে শুনানিতে পেট্রোবাংলার পক্ষ থেকে জানানো হয়।

কারিগরি টিমের মূল্যায় প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আগে গ্যাসে দাম বাড়ানোর সময় দিনে গড়ে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির হিসাব করা হলেও পেট্রোবাংলা দিনে ২৯ কোটি ঘনফুট গ্যাস কম আমদানি করেছে। এতে আড়াই হাজার কোটি টাকা বাড়তি আয় করেছে পেট্রোবাংলা।

শুনানিতে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা শামসুল আলম বলেন, পেট্রোবাংলার কাছে আড়াই হাজার কোটি টাকা উদ্বৃত্ত রয়েছে। আর যে পরিমাণ এলএনজি আমদানি করার প্রাক্কলন করা হয়েছে, সেই পরিমাণ আমদানি না হলে প্রতি ঘনমিটার ১২ টাকা ৪৭ পয়সারও নিচে চলে আসবে।

তিনি অভিযোগ করেন, দেশের গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনের ওপর গুরুত্বারোপ না করে চড়া দামে এলএনজি বিশেষ করে স্পট মার্কেট থেকে কিনে আমদানি করা হচ্ছে।

বিইআরসির মূল্যায়ন টিমের হিসাবে দেখা গেছে, প্রতি হাজার ঘনফুট রি-গ্যাসিফাইড এলএনজির আমদানি মূল্য পড়ছে ১২ দশমিক ২৫ মার্কিন ডলার। সেখানে স্পট মার্কেট থেকে কিনলে এই দাম দ্বিগুণ হয়ে হচ্ছে ২৪ দশমিক ১৯ ডলার।

স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি কেনাটা ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ বলে মন্তব্য করে ক্যাবের উপদেষ্টা।

দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা নেই বলে ক্যাবের পক্ষ থেকে যেসব যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে তার মধ্যে বলা হয়েছে, সর্বশেষ প্রতি ইউনিটে ১২ টাকা ৬০ পয়সা খরচ ধরে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। গ্রাহকের কাছ থেকে গড়ে ৯ টাকা ৩৬ পয়সা নেওয়া হলেও বাকিটা জ্বালানি সুরক্ষা তহবিল ও সরকারি কোষাগার থেকে ভর্তুকি হিসেবে পেট্রোবাংলাকে দেওয়া হয়।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ নুরুল ইসলাম বলেন, ২ শতাংশ যে সিস্টেম লসের হিসাব করা হচ্ছে তা টাকার অংকে বিরাট। এত সিস্টেম লস কোথায় তা পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা প্রয়োজন।

গ্যাস আমদানির সমালোচনা করে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দাবি জানান ভূতত্ত্ববিদ বদরুল ইমাম।

তিনি বলেন, স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদে দেশে গ্যাসের উৎপাদন বাড়ানোর অনেক সুযোগ আছে। অনুসন্ধান না করে দেশীয় গ্যাস শেষ বলে আমদানি করা হচ্ছে। অথচ দেশে অনুসন্ধান করা হলে মূল্যবৃদ্ধির জন্য এমন শুনানির কোনো প্রয়োজন হবে না। 

এদিকে জিপিসিএল সঞ্চালন চার্জ ৭৩ শতাংমের বেশি বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে।

জিটিসিএল বর্তমানে প্রতি ঘনমিটার গ্যাস সঞ্চালন চার্জ নিচ্ছে শূন্য দশমিক ৪২৩৫ পয়সা করে। সেখান থেকে ৭৩ শতাংশ বাড়িয়ে শূন্য দশমিক ৭৩১৮ পয়সা করার প্রস্তাব করেছে কোম্পানিটি।

বিইআরসির কারিগরি মূল্যায়ন টিমের প্রাক্কলন হচ্ছে, দশমিক ৪২৩৫ পয়সা থেকে ১৫ শতাংশ বাড়িয়ে দশমিক ৪৮৯০ পয়সা করা।

বিইআরসির চেয়ারম্যান আবদুল জলিলসহ শুনানিতে আরও উপস্থিত ছিলেন বিইআরসির সদস্য মকবুল ই ইলাহি চৌধুরী, মোহাম্মদ আবু ফারুক, মোহাম্মদ বজলুর রহমান, মো. কামরুজ্জামান। এ ছাড়া বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ শুনানিতে অংশ নিয়ে মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন।