বৈষম্য ‘বাড়ছে’, পেছনে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দেখছেন আকবর আলি খান

তিন দশক ধরে বাংলাদেশে আয় বৈষম্য বেড়েছে, যার পেছনে দুর্নীতি ও কালো টাকার প্রবাহ ছাড়াও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ আকবর আলি খান। 

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Dec 2021, 10:57 AM
Updated : 20 Dec 2021, 11:08 AM

বাংলাদেশের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে রাজধানীর একটি হোটেলে বেসরকারি সংস্থা সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন।

আকবর আলি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় যে সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন রয়েছে তাতে মানুষে মানুষে বিভেদ কমার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে বিভেদ বেড়েই চলেছে।

“এই বৈষম্য বেড়েছে গত ২৫ থেকে ৩০ বছরে। এর একটি কারণ হচ্ছে, দেশে প্রচণ্ড দুর্নীতি চলছে, এই দুর্নীতির ফলে কালো টাকা এবং সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আমাদের এখানে বৈষম্য বেড়েই চলেছে।”

বিশ্বের ৬৫ শতাংশ দেশে বাংলাদেশের চেয়ে আয় বৈষম্য কম এবং ৩৩ শতাংশ দেশে একই পর্যায়ের বৈষম্য রয়েছে বলে তথ্য তুলে ধরেন সাবেক এই আমলা।

বৈষম্য কমাতে বিশেষ দৃষ্টি দিতে নীতি নির্ধারকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, তা নাহলে আবার দেখা যাবে ‘বিভিন্ন ধরনের গণ্ডগোল’। দেশের ‘শান্তি, অব্যাহত অগ্রগতি’ চাইলে এই সমস্যার প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠার চার মূলনীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদ ‘চূড়ান্তভাবে’ অর্জিত হয়েছে মন্তব্য করে আকবর আলি খান বলেন, এটা নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।

“কিন্তু চিন্তার কারণ হল গণতন্ত্র নিয়ে, ধর্ম নিরপেক্ষতা নিয়ে। কারণ যে দেশে গণতন্ত্র নেই, সেদেশে ধর্ম নিরপেক্ষতা টেকসই ভিত্তিতে করা সম্ভব না।”

‘উদারনৈতিক গণতন্ত্র’ মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনা হলেও বাংলাদেশে তা ‘দুর্বল’ অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক এই উপদেষ্টা।

তিনি বলেন, “উদারনৈতিক গণতন্ত্রে কেবল নির্বাচন হলেই চলবে না। একে অন্যের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ থাকতে হবে। সেখানে সিভিল সোসাইটির ভূমিকা থাকতে হবে, সেখানে আইনের শাসন থাকতে হবে। এই ধরনের বিষয়গুলো বাংলাদেশ এখনও দুর্বল।”

আর গণতন্ত্র সুসংহত না হলে সুশাসন, মানুষের অধিকার, বৈদেশিক বিনিয়োগ, অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চনা তৈরি হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

দারিদ্র্য হ্রাসে অর্জন ‘অকল্পনীয়’

দারিদ্র্যসীমার নিজে থাকা মানুষের সংখ্যা ৭০ শতাংশ থেকে ২০ শতাংশে নামিয়ে আনাকে ৫০ বছরে বাংলাদেশের ‘অকল্পনীয়’ অর্জন হিসেবে বর্ণনা করেন আকবর আলি খান।

তিনি বলেন, “আমরা যদি সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকসমূহ দেখি, তাহলে অবশ্যই আমাদের গর্ব করার কারণ রয়েছে। তবে দারিদ্র্য শুধু বাংলাদেশেই কমেনি, পৃথিবীর সব দেশেই কমেছে।”

আন্তর্জাতিক সূচকের ভিত্তিতে বাংলাদেশের ‘৪০ থেকে ৫০ শতাংশ’ মানুষ এখনও দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করছে বলে মন্তব্ করেন এই অর্থনীতিবিদ।

দেশের উন্নতি হলেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে তা সমানভাবে ও সমানতালে হয়নি এবং ওঠা-নামার মধ্যে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন আকবর আলি খান।

স্বাধীনতার পর থেকে দেশে খাদ্য সরবরাহ বাড়লেও সুপেয় পানির অভাব রয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সরকার এক সময় ঢাকঢোল পিটিয়ে বলেছিল, দেশের ৯৭ ভাগ মানুষ নাকি সুপেয় পানি পাচ্ছে, আমি তো দেখতে পাচ্ছি না।

“আর্সেনিক-পয়জনিং এবং উপকূলীয় অঞ্চলের পানির যে অভাব!... এগুলো যদি বিবেচনায় নেন, তাহলে বাংলাদেশে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশের বেশি লোক পানি পাচ্ছে না। এটা তো দারিদ্র্য দূর করার পরিস্থিতি না।”

ভারতের কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকা উচিত না’

মুক্তিযুদ্ধে প্রতিবেশী ভারতের অবদান থাকলেও রাষ্ট্র হিসেবে তার প্রতি বাংলাদেশ ‘চিরকৃতজ্ঞ’ থাকতে পারে না বলে মন্তব্য করেন আকবর আলি খান।

তিনি বলেন, ‘চিরকৃতজ্ঞ’ থাকার কথাটি কিন্তু ১৯৭১ সালে শোনা না, এ কথাটা সম্প্রতি উঠেছে। এরকম চিরন্তন কৃতজ্ঞতাবোধ পৃথিবীর কোথাও নেই।

“এটা ব্যক্তিগত বন্ধুত্ব না। এটা জাতির সাথে জাতির বন্ধুত্ব। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব। রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের বন্ধুত্ব তখনই হবে যখন আমাদের স্বার্থ অভিন্ন হবে। আর যদি আমাদের স্বার্থের ক্ষেত্রে সংঘাত থাকে, তাহলে চিরন্তন কৃতজ্ঞতা বোধ কোনো দিনই হবে না।”

সিজিএসের চেয়ারম্যান মনজুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বীর মুক্তিযোদ্ধা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল জাফর ইমাম, অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল হেলাল মোর্শেদ ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ ইব্রাহিম বক্তব্য দেন।

অনুষ্ঠানে সিজিএসের আয়োজনে বাংলাদেশের ৫০ বছর শীর্ষক রচনা প্রতিযোগীতায় বিজয়ীদের মধ্যে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।