প্রযুক্তির সহজ হস্তান্তর ছাড়া বৈষম্য থেকে যাবে: প্রধানমন্ত্রী

প্রযুক্তি সহজলভ্য, সহজে হস্তান্তরযোগ্য হলে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে; নইলে বৈষম্য থেকে যাবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, প্রযুক্তি যেন সবাই সমানভাবে ব্যবহার করতে পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Dec 2021, 04:18 PM
Updated : 11 Dec 2021, 05:36 PM

তিনি শিল্প খাতে প্রতি শত বছর পরপর দেখা দেওয়া বিবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে প্রস্তুতি নেওয়ারও আহ্বান জানান।

শনিবার সন্ধ্যায় ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব আন্তর্জাতিক সম্মেলন-২০২১’ এর সমাপনী অনুষ্ঠানে যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে দুদিনের এ সম্মেলন আয়োজন করেছে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো যার যার গতিতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলবে। যদি প্রযুক্তি সহজলভ্য, সহজে হস্তান্তরযোগ্য হয় তাহলে সেটা সম্ভব হবে। আর যদি সেটা না হয় তাহলে বৈষম্য থেকে যাবে।

তিনি বলেন, “শিল্পায়ন আমাদের প্রয়োজন।আমাদের দেশের অর্থনীতি কৃষিভিত্তিক কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে শিল্পায়নও আমাদের প্রয়োজন।কাজেই কৃষি ও শিল্প দুটোই প্রয়োজন।সেদিকে লক্ষ্য রেখেই বিভিন্ন পদক্ষেপ আমাদের নিতে হচ্ছে।“

বিশ্বে প্রতি শত বছর পরপর শিল্প ক্ষেত্রে বিভিন্ন বিবর্তন দেখা দেয় উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, এ বিবর্তনের সঙ্গে আমাদের তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় পর্যায় ইতিমধ্যে অতিক্রম হয়েছে। এখন চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত। সেটা লক্ষ্য রেখে আমাদেরকে প্রস্তুতি নিতে হবে।

“এ পর্যায়ে সাশ্রয়ী ও সবুজ ভ্যালু চেইন সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পৃথিবী আজকে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে আছে। একদিকে নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনকারী এবং সহজে ব্যবহারকারী সম্পদশালী উন্নত দেশগুলো। অন্যদিকে এসব ক্ষেত্রে যারা বিনিয়োগে সক্ষমতা রাখে না, স্বল্পোন্নত বা অন্যান্য দেশগুলো,” বলেন তিনি।

এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে মন্তব্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রযুক্তি যেন সকলে সমানভাবে ব্যবহার করতে পারে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দিতে হবে। বিশেষ করে উন্নত দেশগুলোর একটা দায়িত্ব রয়েছে এ ক্ষেত্রে। কারণ তাদের সরবরাহ বাড়াতে হলে স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশকে তাদের প্রয়োজন আছে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা অদূর ভবিষ্যতে মানুষকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের সঙ্গে সহাবস্থান করতে হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিছু নতুন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। যেমন- মেশিন মানুষের কর্মক্ষেত্রকে সংকুচিত করবে; সস্তা শ্রমের চাহিদা কমে যাবে, অসমতা বাড়বে এবং অভিবাসনকে উৎসাহিত করবে।

“উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৈদেশিক বিনিয়োগ কমবে এবং প্রযুক্তি জ্ঞানের ক্ষেত্রে বৈষম্য বাড়বে।“

সম্মেলনের সমাপনী বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী দেশের শিল্পায়নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেওয়া বিভিন্ন উদ্যোগের কথা জানানোর পাশাপাশি দেশের উন্নয়নে আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।

১৯৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে তখন দেশে কম্পিউটার ব্যবহারকারী ছিল না জানিয়ে তিনি বলেন, আমরাই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করি। অবকাঠমো গড়ে তোলা, বিধিমালা প্রণয়ন এবং প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন দক্ষ নাগরিক সৃষ্টিতে মনোনিবেশ করি। এক্ষেত্রে আমাকে সব সময় পরামর্শ দেয়, সহযোগিতা করে আমার ছেলে সজীব ওয়াজেদ।

বিএনপি জামায়াত জোট সরকারের সময়ে সম্ভবনা থাকার পরও বাংলাদেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে পিছিয়ে গিয়েছিল বলেও আক্ষেপ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, ১৯৯১-৯৫ সময়ে যখন বিএনপি ক্ষমতায় তখন এই অঞ্চলে ফাইবার অপটিক আসে। বাংলাদেশ তখন বিনামূল্যে ফাইবার অপটিকের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করার একটা সুযোগ পায়।

“দুর্ভাগ্য হলো যে তখনকার প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিল যে এর সঙ্গে সংযুক্ত হওয়া যাবে না। কারণ আমাদের সব তথ্য না কি বের হয়ে যাবে। এজন্য সেই ফাইবার অপটিকসের সঙ্গে বাংলাদেশ যুক্ত হয়নি। এটা হচ্ছে দুর্ভাগ্য। যে কারণে আমরা ব্রডব্যান্ডের সঙ্গেও সংযোগ স্থাপন করতে পারিনি।”

পরে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর সেই উদ্যোগ নেয় জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমাদেরকে বেশি পয়সা দিয়েই তখন এ ফাইবার অপটিকস আনতে হয়। যেটা বেশি খরচ করতে হয়। যদি ওই সময় আমরা পেতাম তাহলে এটা লাগত না।

বাংলাদেশের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে অত্যাধুনিক প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন জনশক্তিতে রূপান্তর করতে আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ জানিয়ে তিনি বলেন, কারণ এই নতুন কর্মসংস্থান যেটা হবে- তার সঙ্গে আমাদের দেশের মানুষ যেন তাল মিলিয়ে চলতে পারে, আমাদের যেই যুব সমাজ তাদেরকে আমরা সেইভাবেই একেবারে ছোট থেকেই আমরা সেই শিক্ষা দিতে চাই।

“বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমরাও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), রোবোটিক্স, ইন্টারনেট অব থিংস সফলভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম হব বলে আমি বিশ্বাস করি। কারণ আমাদের ছেলে মেয়েরা অত্যন্ত মেধাবী,” যোগ করেন তিনি।

জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সৃষ্টি করার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানান।

শেখ হাসিনা বলেন, “কারণ তার কাছ থেকে আমি নিজেও কম্পিউটার চালানো শিখেছি।তারই পরামর্শে সে যখন একদম স্কুলের ছাত্র, তখন থেকেই আমাকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিত যে ট্যাক্স না কমালে কম্পিউটার কেউ কিনতে পারবে না। আর ব্যবহারও করবে না।“

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে সব ধরনের শুল্ক তুলে দেয় বলেও জানান তিনি।

আজকের বাংলাদেশ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের পর এখন বাংলাদেশ ‘উদ্ভাবনী বাংলাদেশ’ এর দিকে এগিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ২০৪১ সালের মধ্যে দেশ এগিয়ে যাবে এবং উন্নত, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ হবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

“পাশাপাশি ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত, সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ ইনশাল্লাহ আমরা গড়ে তুলব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে বাংলাদেশ পিছিয়ে থাকবে না। বাংলাদেশ হবে একটা নেতৃত্বদানকারী দেশ, যা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবে,” যোগ করেন তিনি।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র প্রান্তে এসময় শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি, শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক কাজী শহীদুল্লাহ, সদস্য মো.সাজ্জাদ হোসেনসহ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

সম্মেলনে দেশ-বিদেশের বিপুল সংখ্যক বিজ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, শিক্ষার্থী, শিল্পোদ্যোক্তারা অংশ নেন।

তিন জন নোবেল বিজয়ী এবং ছয় জন খ্যাতিমান বিজ্ঞানী মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।

সম্মেলনে ১৭টি দেশ থেকে মোট ৫২৫টি গবেষণাপত্র জমা হয়েছে এবং এগুলোর মধ্য থেকে ১০০টি গবেষণা প্রবন্ধ উপস্থাপনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে।

এছাড়া সহস্রাধিক ধারণা (আইডিয়া) থেকে ১০টিকে সেরা হিসেবে বাছাই করা হয়েছে, যারা প্রত্যেকে ১০ লাখ টাকা পুরষ্কার পাবেন।

সম্মেলনে ‘মুজিব-১০০ আইডিয়া কনটেস্ট’ এবং ‘মুজিব-১০০ ইন্ডাস্ট্রিয়াল এক্সিবিট’ অনুষ্ঠিত হয়।