বার বার ‘দায়মুক্তির’ আইন কার স্বার্থে, প্রশ্ন ক্যাবের আলোচনায়

‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান)’ আইনের মেয়াদ বাড়ানোর সমালোচনা উঠেছে ভোক্তা অধিকার সংগঠন ক্যাবের আলোচনা সভায়।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 Sept 2021, 03:42 PM
Updated : 21 Sept 2021, 04:23 PM

সভায় বক্তারা এই আইনের কারণে পাওয়া দায়মুক্তির সুযোগে দেশীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠী স্বার্থ সুরক্ষার সমালোচনা করেন।

কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশেন অব বাংলাদেশের (ক্যাব)  আয়োজনে মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এই নাগরিক সভায় ক্যাবের চেয়ারম্যান গোলাম রহমানের সভাপতিত্ব করেন।

আলোচনায় অংশ নেন অধিকারকর্মী সুলতানা কামাল, স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন, অধ্যাপক বদরুল ইমাম, অধ্যাপক ইজাজ হোসেন, প্রকৌশলী সালেক সুফী, অধ্যাপক এম এম আকাশ, অধ্যাপক এম শামসুল আলম, অ্যাডভোকেট রিজওয়ানা হাসান, অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান ও ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ।

২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট মোকাবেলায় দুই বছরের জন্য এই আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। প্রথমে চার বছর, দ্বিতীয়বার তিন বছর এবং এখন আবার পাঁচ বছরের জন্য মেয়াদ বাড়ানো হল।

ক্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, এই আইনের আওতায় বিনা দরপত্রে ভাড়া বিদ্যুৎ ক্রয়, দফায় দফায় অতিরিক্ত মূল্যে চুক্তি নবায়ন, বিদ্যুৎ আমদানি, বিনা দরপত্রে গ্যাস বিদ্যুতের সঞ্চালন ও বিতরণ অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প, গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন প্রকল্প ইত্যাদি কাজ করা হচ্ছে।

এই আইনটির সমালোচনা শুরু থেকেই হচ্ছিল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদন দ্রুত বাড়াতে এর বিকল্প ছিল না।

আইনের মেয়াদ বাড়ানোর পক্ষে যুক্তি দেখানো হয়েছে, বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখায় বিকল্প হিসেবে আরও কিছু সময়ের জন্য ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো রাখতে হচ্ছে।

ক্যাবের আলোচনায় মেলবোর্ন প্রবাসী জ্বালানি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী সালেক সুফী বলেন, দায়মুক্তি আইন করে রেন্টাল ও কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালানো ‘দেশবিরোধী কাজ’।

তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন, বর্ধিত মেয়াদের এই দায়মুক্তির আওতায় বেশ কিছু নতুন ক্রয়চুক্তি করা হবে। পায়রায় গভীর সাগরে একটা এলএনজি টার্মিনাল করে ৭০ কিলোমিটার একটা পাইপলাইন করে করে উচ্চমূল্যে এলএনজি সরবরাহের চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ধরনের আরও কিছু কাজ করা হবে। রেন্টাল পাওয়ার প্ল্যান্টও আরও করা হবে।

সালেক সুফী বলেন, “ট্রান্সপারেন্ট টেন্ডারিং প্রসেস না করে কিছু গোষ্ঠী বেনিফিটেড হয়েছে। কিন্তু গ্রাহকরা এর ফলে সুলভ মূল্যে যে বিদ্যুৎ ও গ্যাস পাওয়ার কথা সেটা পাচ্ছে না।

“রেন্টাল এবং কুইক রেন্টালগুলো ৩ থেকে ৫ বছর ও ক্ষেত্র বিশেষ ১৫ বছর মেয়াদি করা হয়েছিল। আমাদের সর্বোচ্চ চাহিদা কখনই ১৫ হাজারের বেশি উঠেনি, কিন্তু উৎপাদন সক্ষমতা এখন ২৫ হাজার মেগাওয়াট করে রাখা হয়েছে। অধিকাংশগুলোকে চালু না রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া হচ্ছে- এর প্রভাব পড়ছে বিদ্যুতের ট্যারিফের উপর।”

রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বহীন করে ‘দেউলিয়াত্বের’ দিকে নেওয়া হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, “বিভিন্ন দেশে স্বল্প সময়ের জন্য দ্রুত জ্বালানি সরবরাহের জন্য আইন করা হয়। কিন্তু সেটা স্বল্প সময়ের জন্য। আমাদের মতো ১০ বছরের জন্য করা হয়নি। এখন আরও ৫ বছরের জন্য বাড়ানো হয়েছে। এখন বিদ্যুৎকেন্দ্র সারপ্লাস রয়েছে। তারপরেও কুইক রেন্টালকে এলাও করে রেখেছি কেন?

“এসব কার স্বার্থে হচ্ছে, সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। জ্বালানির জন্য গ্যাসই হচ্ছে সহজ পথ। কিন্তু আমি দেখছি গ্যাস নিয়ে একটা গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। গত ১০ বছরে সাগর থেকে গ্যাস উৎপাদনে কোনো তৎপরতা নেই। অথচ মিয়ানমার সাগর থেকে গ্যাস তুলছে। আমরা চড়া দামে এলএনজি আমদানি করছি।”

অধ্যাপক এজাজ হোসেন বলেন, “কখন কী করতে হবে তারা বুঝতে পারছে না। এজন্য নিজেদের সুরক্ষার জন্য আইন করে রেখেছে।”

আইনজীবী রিজওয়ানা হাসান বলেন, “এইটার উদ্দেশ্য হচ্ছে কোনো জবাবদিহিতা ছাড়া কাজ করা। এটা সর্বোচ্চ ৫ বছরের জন্য হতে পারে। কিন্তু এত লম্বা সময় ধরে কীভাবে সম্ভব?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এম এম আকাশ বলেন, “দায়মুক্তির আইনটি ২, ৪, ৩ বছর করে বাড়িয়েছেন। এখন আবার ৫ বছরের জন্য বাড়াচ্ছেন। এটা তো খুবই অন্যায়। এখানে রাজনীতিক ও ব্যবসায়ীদের ইন্টারেস্ট আছে।”

স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, “একটি স্বাধীন দেশে এই ধরনের দায়মুক্তি আইন হতে পারে না।”

ফাইল ছবি। আসিফ মাহমুদ অভি

তুরিন আফরোজ বলেন, “কিছুদিন আগে বিইআরসির গণশুনানিতে গিয়ে যা দেখলাম এবং শুনলাম প্রতিষ্ঠানটি পেপার টাইগারে পরিণত হয়েছে। এনার্জি সেক্টরে অনেকাংশে মিস রেগুলেটেড হয়ে গেছে।”

জ্বালানি খাতের অব্যবস্থাপনাগুলোর বিষয়ে ইঙ্গিত করে সুলতানা কামাল বলেন, “কুইক রেন্টালগুলোকে বসিয়ে বসিয়ে টাকা দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এই টাকাগুলো তারা কোথায় পাচ্ছে? আমাদের ট্যাক্সের টাকাই তো।”

ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, সরকার গ্যাসে ৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। বিদ্যুৎখাতে ১৪ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। এই ব্যয়গুলো কেন বাড়ানো হচ্ছে, যার কারণে এখন ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।

“আমরা আগেই বলেছিলাম এসব অযৌক্তিক ব্যয়ের কথা। এখন বলছি লুণ্ঠনমূলক ব্যয়।”

ক্যাবের প্রস্তাব

>> বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন ২০১০ বাতিলের দাবি করতে হবে। তবে বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে সুইচ চ্যালেঞ্জ মাধ্যমে আনসলিসিটেড কোনো প্রস্তাব বিবেচনা করা যেতে পারে।

>> ভাড়া কিংবা দ্রুত ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির মেয়াদ কোনোভাবেই আর বৃদ্ধি করা যাবে না।

>> এলপিজিসহ পেট্রোলিয়াম পণ্যের মূল্য নির্ধারণের ক্ষমতা বিইআরসির কাছ থেকে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ বন্ধ করতে হবে।

>> সরকারি সেবা সংস্থায় চাকরিতে ছিলেন, এমন কোনো ব্যক্তি চাকরি ছাড়ার ৫ বছরের মধ্যে বিইআরসির সদস্য হতে পারবেন না, এমন বিধান করতে হবে।

>> সরকারি সেবা সংস্থার পরিচালনা পর্ষদ থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সব কর্মকর্তাকে সরিয়ে নিতে হবে।