জীবন-জীবিকা রক্ষার ‘স্বচ্ছ্ব রূপরেখা’ বাজেটে নেই: সিপিডি

নতুন অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দেশীয় শিল্প ও গতানুগতিক অর্থনীতির জন্য বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ থাকলেও মূল প্রতিপাদ্য ‘জীবন-জীবিকা’ রক্ষার ‘স্বচ্ছ্ব রূপরেখা’ দেখছেন না সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 June 2021, 11:27 AM
Updated : 4 June 2021, 11:28 AM

জাতীয় সংসদে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের বাজেট উত্থাপনের পরদিন শুক্রবার ঢাকার লেকশোর হোটেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বাজেট নিয়ে সিপিডির বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়।

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এবার অর্থনীতির প্রায় সকল জায়গায় স্বস্তির একটি জায়গা’ থেকে বাজেট দেওয়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু দুর্বল অনুমিতির ওপর প্রাক্কলন বাজেটকে কাঠামোগত দুর্বল করে দিয়েছে।”

তিনি বলেন, এ বাজেটকে কোভিডকালীন  বাজেট বলা হলেও স্বাস্থ্য বা শিক্ষা খাতে তার প্রতিফলন তারা দেখছেন না। কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বা মহামারীতে যারা নতুন করে দারিদ্র্যে পড়েছে,তাদের বিষয়েও বাজেটে ‘তেমন কিছু নেই’।

মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, বাজেটে ব্যবসাবান্ধব পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা আছে, তাতে কর্মসংস্থান তৈরি করার পরোক্ষ একটি চেষ্টা হয়ত আছে, কিন্তু পরোক্ষ চেষ্টায় অর্থনীতিতে ‘বড় ধরনের চাঞ্চল্য’ সৃষ্টি করা যায় না।

তার ভাষায় এ বাজেটে প্রয়োজনীয় কিছু উদ্যোগ থাকলেও তা ‘যথেষ্ট নয়’।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকার বাজেটের ৬৪ শতাংশ রাজস্ব খাত থেকে আয় করার লক্ষ্য ধরেছেন। ৩ লাখ ৮৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্বের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৩ লাখ ৩০ হাজার ৭৮ কোটি টাকা আদায়ের আশা করছেন।

এই লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করার পাশাপাশি এ ক্ষেত্রে এনবিআরের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন রেখেছেন মোস্তাফিজুর রহমান।

বাজেটে স্থানীয় শিল্পের বিকাশে কিছু কর ও শুল্ক ছাড়ের ঘোষণা এলেও তার মতে, শুধুমাত্র কর কমিয়ে বিনিয়োগ বাড়ানো যাবে না। বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অন্যান্য বিষয়গুলোও সহজ করতে হবে।

স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ কম মন্তব্য করে তিনি বলেন, “যে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে তাও সক্ষমতার অভাবে ব্যয় করা যাচ্ছে না। অথচ সারা দেশের ১৬ হাজার কম্যুনিটি ক্লিনিকের অবকাঠামো দিয়েও আমরা অর্থ ব্যয় করতে পারি। সরকার সেটাও করছে না।”

সামাজিক নিরাপত্তা খাতের বাজেটে সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন যুক্ত করে বড় দেখানোর প্রবণতার সমালোচনা করে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো বলেন, পেনশন বাদ দিলে এ খাতে থাকে মাত্র বাজেটের ২ দশমিক ৪ শতাংশ।

“এই বরাদ্দ কোভিড-১৯ অতিমারীর এই সময়ে সাধারণ মানুষের জীবন জীবিকার সমাধান করতে পারবে বলে আমি মনে করি না।”

তিনি বলেন, “আয় বৈষম্য, ভোগ বৈষম্য এবং সম্পদ বৈষম্য দূর করাই বাজেটের দর্শন। সেটাই প্রস্তাবিত বাজেটে অনুপস্থিত।”

সিপিডের গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটে যাদের জন্য বরাদ্দ প্রয়োজন তাদের ‘দেওয়া হয়নি’। আবার যার দরকার নেই, তাকেও দেওয়া হয়েছে।

“ঘর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত কয়রার হাজার হাজার মানুষ বাঁধের জন্য আন্দোলন করলেও তাদের বাঁধের জন্য বরাদ্দ না দিয়ে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য ১৮ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হল। এই প্রকল্প বাস্তবায়ন কয়েকবছর দেরি করলেও কোনো সমস্যা ছিল না।”

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ‘জীবন ও জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে’ শিরোনামে যে বাজেট উত্থাপন করেছেন, তাতে শিল্প ও বিনিয়োগকে প্রাধান্য দিয়ে কর আদায় ও রাজস্ব খাতে বেশ কিছু সংস্কারের কথা রয়েছে।

“ইতোমধ্যে বিশ্লেষক মহল থেকে বাজেট নিয়ে যেসব মন্তব্য এসেছে সবাই এই বাজেটের লক্ষ্যের সঙ্গে কর্মসূচির ফারাক নিয়ে সন্দেহের কথা তুলে ধরেছেন।”

ফাহমিদা খাতুন সামগ্রিক বাজেটের সারসংক্ষেপ নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “জীবন জীবিকার কথা বলা হলেও কৃষি, কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে বরাদ্দে দেখছিনা। সামষ্টিক অর্থনীতির কাঠামো বাস্তবতার সঙ্গে মিল নেই।

“কোভিডে অর্থনীতির যে ক্ষতিটা হল, পিছিয়ে গেলাম- সেটা ‍পুষিয়ে আনার জন্য কী কাজ করব আগামী ৩/৪ বছরে, তার কোনো নির্দেশনা নেই। এখানে মধ্য মেয়াদী পরিকল্পনা দরকার ছিল। বাস্তবায়নের সঠিক ও স্বচ্ছ রূপরেখা দেখতে পাচ্ছি না।“

ফাহমিদা খাতুন বলেন, মহামারীর ক্ষতি পোষাতে সরকার যে ২৩টি প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়ন করছে, তার ৮০ শতাংশ ঋণ নির্ভর, বাকিটা রাজস্ব সহায়তা। এখন মানুষের হাতে আয় নেই। তাই রাজস্ব থেকে বেশি দেওয়া প্রয়োজন ছিল।

প্রস্তাবিত বাজেটে তৃতীয় লিঙ্গের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রশংসা করলেও সামগ্রিকভাবে সাধারণ করদাতাদের জন্য করে ছাড় দেওয়ার ওপর জোর দেন সিপিডির নির্বাহী পরিচালক।

তিনি বলেন, “নিম্ন আয়ের মানুষের করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর প্রস্তাব করেছিলাম আমরা। সেটা একই রাখা হয়েছে। এটা বাড়ালে ভালো হতো। ব্যক্তির খরচ না বাড়ালে অর্থনীতির গতি বাড়বে না।”

সিপিডির গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানও সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।