আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ: ভ্যাকসিনের ‘ভুল’ শোধরাতে নতুন প্রকল্প

প্রাণী থেকে মানুষে এবং আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ প্রতিরোধের জন্য বছর বছর বিপুল অর্থ ব্যয়ে ভ্যাকসিন আমদানি করা হলেও দেশে মান যাচাইয়ের সুযোগ না থাকায় নানা রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে বলে উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) এক প্রতিবেদনে।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 Feb 2021, 07:51 PM
Updated : 23 Feb 2021, 08:02 PM

ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও দেশের নানা প্রান্তে গবাদি পশুর মধ্যে ক্ষুরারোগ (এফএমডি), পেস্টিডেস পেটিস রুমিন্যাট (পিপিআর), লাম্পি স্কিন ডিজিজ (এলএসডি), বোভাইন টিউবারকোলসিস, সোয়াইন ইনফ্লুয়েঞ্জা, ক্লাসিকাল সোয়াইন ফিভার, গোটপক্স এবং পোল্ট্রিতে রাণীক্ষেত রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দিচ্ছে।

বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক নাথুরাম সরকার বলছেন, জুনোসিস (প্রাণী থেকে মানুষে ছড়ায়- এমন রোগ) ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়ে আসা ভ্যাকসিনের গুণগত মান ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য বায়োসেইফটি লেভেল-থ্রি ল্যাব থাকা দরকার। কিন্তু বাংলাদেশে তা নেই।

ইনস্টিটিউটের প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল ২০২০ সালেই প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর প্রায় ১ হাজার ৫০০ কোটি ডোজ বিভিন্ন ভ্যাকসিন আমদানির অনুমতি দিয়েছে। এসব ভ্যাকসিনের মোট আমদানি মূল্য দাঁড়ায় ৭৫০ কোটি টাকা।

“কিন্তু এসব ভ্যাকসিনের কার্যকারিতা যাচাই না করে আমদানি করা হয়। ফলে ভ্যাকসিন দেওয়ার পরও রোগের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় এবং খামারিরা আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েন। তাতে দেশে প্রাণিসম্পদের উৎপাদন ব্যাহত হয়।”

এ পরিস্থিতিতে জুনোসিস ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগের সমস্যা চিহ্নিত করা, প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও কার্যকর প্রযুক্তি উদ্ভাবনে একটি নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিএলআরআই।

‘জুনোসিস এবং আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ গবেষণা’ শীর্ষক এ প্রকল্পের আওতায় ল্যাব তৈরিসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, রাসায়নিক আমদানি এবং গবেষণার মিলিয়ে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫০ কোটি ৪২ লাখ টাকা।

২০১৯ সালের জুলাই মাস থেকে পরীক্ষামূলকভাবে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের উদ্বোধনী কর্মশালা হয় সোমবার। মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এর উদ্বোধন করেন।

ভ্যাকসিনের মান ও কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য বায়োসেইফটি লেভেল-৩ ল্যাব স্থাপন করা এ প্রকল্পের প্রধান উদ্দেশ্য বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান বিএলআরআইয়ের মহাপরিচালক নাথুরাম সরকার।

ইনস্টিটিউট বলছে, বিশ্ব প্রাণিস্বাস্থ্য সংস্থা ২৫টি প্রাণিরোগকে আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ হিসেবে বিবেচনা করে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেশে এসব রোগের প্রকোপ বাড়ছে। দেশের মোট প্রাণিসম্পদের একটি ক্ষুদ্র অংশকে হাসপাতালে চিকিৎসা করানো হয়। আসলে হাসপাতালে আনা প্রাণীর সংখ্যার চেয়ে আক্রান্ত প্রাণীর সংখ্যা বহুগুণ বেশি।

বাংলাদেশে ২০০৭ সালে প্রথম উচ্চমাত্রার এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ওই বছর পোল্ট্রি শিল্পে ৫ কোটি ১৭২ লাখ ডলারের ক্ষতি হয় বলে হিসাব দিয়েছে বিএলআরআই।

তবে আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগের কারণে সাম্প্রতিক সময়ে ঠিক কত টাকার ক্ষতি হয়েছে তার সুনির্দিষ্ট কোনো জরিপ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বা বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান করেনি।

এ অবস্থায় নতুন প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ প্রাণিজাত খাদ্যের (দুধ, ডিম ও মাংস) উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য এগ্রো-ইকোলজিক্যাল জোনভিত্তিক প্রাণিরোগ নিয়ন্ত্রণ মডেল উদ্ভাবনের মাধ্যমে জুনোসিস ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ থেকে মুক্ত অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

এ প্রকল্পের প্রধান কাজগুলো হবে-

# সীমান্ত এলাকাসহ দেশব্যাপী নিয়মিত জুনোসিস ও আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগের অবস্থা জরিপ ও সমস্যা চিহ্নিত করা

# অঞ্চলভিত্তিক প্রাণিরোগ নিয়ন্ত্রণ মডেল উদ্ভাবন ও রোগের প্রাদুর্ভাব কমানো

# প্রাণিরোগের বিবর্তনের ভিত্তিতে আধুনিক ও নতুন প্রজন্মের লাগসই টিকাবীজ উদ্ভাবন এবং আমদানি করা টিকার মান নিরূপণ

# প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ২৪টি কোয়ারেন্টিন স্টেশনে নির্ভুল ও দ্রুত রোগ নির্ণয়ে কারিগরি সহায়তা দেওয়া।

জুনোসিস এবং আন্তঃসীমান্তীয় প্রাণিরোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণ গবেষণা প্রকল্পের পরিচালক আবদুস সামাদ বলেন, এ প্রকল্পের মাধ্যমে বিশেষ বিশেষ রোগের কারণে বার্ষিক আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণে পূর্ণাঙ্গ অর্থনৈতিক সমীক্ষা করা হবে। দ্রুত ও স্বল্প খরচে রোগ শনাক্তের প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য বিশ্ব প্রাণী স্বাস্থ্য সংস্থার মানদণ্ড অনুযায়ী ল্যাব স্থাপন করা হবে।

তাছাড়া নতুন প্রযুক্তি, উন্নত রোগ নিয়ন্ত্রণ কৌশল ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি পৌঁছে দেওয়া হবে খামারিদের হাতে। নিরাপদ দুধ, ডিম ও মাংস উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদিত পণ্যের মূল্য সংযোজন ও খামারিদের আয় বৃদ্ধিরও সুযোগৈ তৈরি হবে বলে জানান তিনি।

অবশ্য বিএলআরআই যেসব লক্ষ্যের কথা বলছে, সেগুলো পূরণ করতে হলে আরও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও অ্যানিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নীতিশ চন্দ্র দেবনাথ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “যখন জনগণকে পুষ্টিসম্মত খাদ্য দেওয়ার কথা বলা হচ্ছে, তখন এই ৩-৪ বছরের প্রকল্পে থমকে থাকলে হবে না। এটা একটা কন্টিনিউয়াস প্রসেস হতে হবে। আমার মতে, এই প্রকল্পের একটা ইনস্টিটিউশনাল অ্যারেজমেন্ট দরকার। তার চেয়েও বড় কথা, আমাদের একদিন ‘ওয়ান হেলথ’ কনসেপ্টের দিকে যেতেই হবে।”

বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক মকবুল হোসেন বলেন, “৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ জোনোটিক ডিজিজের কারণ হল অ্যানিমেল। এই প্রেক্ষাপটে প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ করতে গেলে আমাদের এই প্রকল্পের সাসটেইনেলিবিলিটি নিশ্চিৎ করতে হবে।”

মান পরীক্ষার ব্যবস্থা না থাকার পরও বিপুল অর্থ ব্যয়ে ভ্যাকসিন আনার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবদুল জব্বার শিকদার কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

আর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি এ বিষয়ে কথা বলার মত টেকনিক্যাল লোক নই। তবে এ বিষয়টি নিয়ে ভাবার রয়েছে।”

সোমবারের অনুষ্ঠানে শ ম রেজাউল করিম বলেন, “দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রাণিসম্পদ খাত ব্যাপক ভূমিকা রাখতে পারে। এ খাতে কাজের ক্ষেত্র অনেক বেশি সম্প্রসারিত। এর মাধ্যমে দারিদ্র্য দূরীকরণ, উদ্যোক্তা তৈরি, বেকারত্ব দূর করা, গ্রামীণ অর্থনীতিকে সচল করা এবং মানুষের পুষ্টি ও আমিষের চাহিদার যোগান দেওয়া সম্ভব।

“পাশাপাশি মাংস, ডিমসহ দুধ থেকে উৎপাদিত পণ্য রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের ক্ষেত্রে এ খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে।”