কয়লার বিকল্প এলএনজি নয়: সরকারকে সিপিডি

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কয়লার বিকল্প হিসেবে এলএনজি ব্যবহারে জোর না দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ-সিপিডি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 Sept 2020, 03:08 PM
Updated : 14 Sept 2020, 03:08 PM

বেসরকারি এ গবেষণা প্রতিষ্ঠান বলছে, সরকার যেসব পরিকল্পনা গ্রহণ করেছ, তাতে ‘হিসাবের নানা গরমিল’ দেখতে পাচ্ছে তারা।

সোমবার ‘বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা বর্জন: সরকারি উদ্যোগ ও কতিপয় সুপারিশ’ শীর্ষক এক ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ে এ বিষয়ে সিপিডির পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন সংস্থার গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম।

মূল প্রবন্ধে তিনি বলেন, “কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হওয়ায় সরকার বিভিন্ন সময়ে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি হিসেবে এলএনজি ব্যবহার করবে বলে বিবৃতি দিয়েছে। আমরা মনে করি এটি একটি রাজনৈতিকভাবে জোরালো বিবৃতি। এটিকে এখন নীতিগত বিবৃতিতে রূপান্তর করে নীতিগত সিদ্ধান্তের দিকে যাচ্ছে সরকার।”

এ বিষয়টিকে সিপিডি ‘ইতিবাচকভাবে’ দেখছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এটাকে আমরা সাধুবাদ জানাতে পারতাম যদি সরকার কয়লার পরিবর্তে এলএনজি ব্যবহার না করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে এগোনোর নীতি গ্রহণ করত।”

সরকার এক ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে আরেক ধরনের জীবাশ্ম জ্বালানিতে যেতে চাইছে- এই জায়গাতেই সিপিডির আপত্তি বলে মন্তব্য করেন গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, “আমরা মনে করি, সরকারের এখনই উপযুক্ত সময় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে আসার।”

বাংলাদেশ সম্প্রতি ‘ক্লাইমেট ভার্নারেবল ফোরাম’ এর প্রসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ায় এখন পরিবেশ দূষণকারী জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসার ‘নৈতিক চাপও বৃদ্ধি পেয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক।

তিনি বলেন, “সরকারও চাইছে পরিবেশ দূষণকারী জ্বালানি থেকে বেরিয়ে আসতে। তাই যদি চায়, তাহলে কয়লা থেকে বের হয়ে এলএনজিতে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাদ দিলে দেশের খরচ বাঁচবে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা। সেই সাথে পরিবেশের ঝুঁকি কমবে।

“সারা বিশ্ব যখন কার্বন নিঃসরণের বিরুদ্ধে সোচ্চার এবং অনেক দেশই যখন কয়লাভিত্তিক প্রকল্প থেকে সরে আসছে, সেখানে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য বৈদেশিক ঋণে অধিক সংখ্যক কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়ে রীতিমত পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।”

সরকারের বিদ্যুৎ খাতের মহা পরিকল্পনায় ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে। এর মধ্যে গ্যাস বা এলএনজি থেকে ৩৫ শতাংশ, কয়লা থেকে ৩৫ শতাংশ, আমদানি এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে ১৫ শতাংশ, পারমাণবিক শক্তি থেকে ১০ শতাংশ এবং তেল থেকে ৫ শতাংশ আসবে বলে ধরা হয়েছে।

সরকারের এই পরিকল্পনায় পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারে গুরুত্ব দিয়ে এলএনজিকে ‘কম দূষণের জ্বালানি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা নিয়ে সিপিডির আপত্তি।

গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “কয়লা থেকে সরে আসার ব্যাপারটিকে আমরা যৌক্তিক মনে করছি। কিন্তু এলএনজিতে যাওয়ার বিষয়ে যুক্তি একপাক্ষিক মনে হচ্ছে।”

তিনি বলেন, এই পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য আলাদা কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি।

“অর্থাৎ কোন জ্বালানির ক্ষেত্রে কী পরিমাণ পরিবেশের ক্ষতি হবে- এ ধরনের কোনো বিশ্লেষণ করা হয়নি। এটা আমাদের কাছে খুব বিস্ময়কর মনে হয়েছে।”

এ বিষয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদকারী, সরবরাহকারী ও মন্ত্রণালয়ের যেসব তথ্য রয়েছে, তাতে ‘অসামঞ্জস্যতা রয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক।

“মন্ত্রণালয়ের তথ্যের মধ্যে বলা হয়েছে, ২২টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২৩ হাজার ২৩৬ মেগাওয়াট উৎপাদন হবে। কিন্তু আবার ভেতরের হিসাবে যখন যোগ করছি সেখানে ২২ হাজার ৯৭২ মেগাওয়াটের হিসাব পাচ্ছি।

“আবার বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবের সঙ্গে মেলালে দেখতে পাই, সেখান মাত্র ১৮টি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের হিসাব পাওয়া যায়। তাদের হিসাব অনুযায়ী কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে ২১ হাজার ২৪১ মেগাওয়াট আসবে। এই হিসাবগুলোর সমন্বয় করা প্রয়োজন।”

তিনি বলেন, সরকারের এই পরিকল্পনায় আমদানি করা এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির হিসাব একসঙ্গে মোট উৎপাদনের ১৫ শতাংশ দেখানো হয়েছে, যা আগে আলাদা করা ছিল।

“সেখানে বলা হয়েছে, আমদানি করা হবে সাড়ে ৪ শতাংশ। তাহলে বাকি সাড়ে ১০ শতাংশ বা ৬ হাজার ৩৬০ মেগাওয়াটের মত বিদ্যুৎ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদন করা হবে। কিন্তু এখন ২০৩৭ সাল পর্যন্ত যে পরিকল্পনা রয়েছে, সেখানে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে এক হাজার ৫২০ মেগাওয়াটের তথ্য পাওয়া যায়, অর্থাৎ দুই তথ্যের মধ্যে মিল পাওয়া যায় না।

“আবার সরকার গ্যাস, কয়লা এবং এলএনজি মিলে ৩৫ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার কথা বলছে। অথচ বর্তমান হিসাব অনুযায়ী বর্তমানে যেসব কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণাধীন রয়েছে, সেগুলো উৎপাদনে গেলে মোট উৎপাদনের প্রায় সাড়ে ৪২ শতাংশ শুধু কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে।”

এসব হিসাব সমন্বয় করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির মাধ্যমে কত বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে- তা স্পষ্ট করার দাবি জানান গোলাম মোয়াজ্জেম।

তিনি বলেন, “এসব মিলে হিসাবের গরমিল ঠিক করে একটি সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে।... তারচেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে যদি এলএনজি করা হয়, তাহলে এলএনজি উৎপাদন হয়ে যাবে ৭০ শতাংশ।

“যদি তাই হয়, তাহলে বর্তমানে বহুমুখী জ্বালানি দিয়ে উৎপাদনের যে সুযোগ ও সামর্থ্য তৈরি হয়েছে, তা নষ্ট হয়ে বরং এককেন্দ্রিক জ্বালানি কাঠামোতে চলে যাবে।”

বাংলাদেশের জন্য তা ‘মোটেই উচিত হবে না’ মন্তব্য করে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, “এটি বিদ্যুতের জ্বালানি কাঠামো হিসেবে মোটেই ভাল দিক নয়।”

মূল প্রবন্ধে বলা হয়, কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে এখন এলএনজির দাম কিছুটা কম থাকলেও আগামীতে এর দাম বাড়বে না- তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এলএনজিতে একদিকে পরিবেশের ‘ক্ষতি’ হবে, অন্যদিকে দাম বাড়লে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ব্যয়ও অনেক বেড়ে যাবে। তখন বিদ্যুৎ উৎপাদন খাত ‘চতুর্মুখী সমস্যায়’ পড়তে পারে।

তাই এককেন্দ্রীক জ্বালানি নীতি না নিয়ে পরিবেশবান্ধব নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি এখন থেকেই নেওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক।

সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “নবায়নযোগ্য সৌর বিদ্যুৎ কাঠামোর আওতায় যে ৩৬টি প্রকল্প হাতে নিয়েছিল সরকার, তার মাত্র ৮টি প্রকল্পের বাস্তাবয়ন হয়েছে। অন্য প্রকল্পগুলো কেন চালু করা সম্ভব হচ্ছে না?”

সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “দেশের স্বার্থে সরকারের এখন উচিত নীতি-কাঠামো পরিবর্তন করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার নিশ্চিত করার ওপর জোর দেওয়া।”