রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও ‘অবাস্তব’ ঠেকছে অর্থনীতিবিদদের কাছে

মহামারীর মধ্যে বড় বাজেটে রাজস্ব আয়ের যে বিশাল অঙ্ক ঠিক করেছেন অর্থমন্ত্রী, তা ‘অবাস্তব’ ঠেকেছে অর্থনীতি বিশ্লেষকদের কাছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকও নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 June 2020, 06:13 PM
Updated : 11 June 2020, 06:23 PM

এছাড়া ঘাটতি মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে যে বড় অঙ্কের ঋণ নেবে সরকার, তা দেশে বেসরকারি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত করবে বলেও আশঙ্কা তাদের।

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে বৃহস্পতিবার অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য ৫ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকার বাজেট সংসদে উপস্থাপন করেন।

গত অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ১৩ শতাংশ বড় এই বাজেটে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৮ দশমিক ২ শতাংশ ধরেছেন অর্থমন্ত্রী, যেটাও ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে প্রতিক্রিয়া এসেছে।

মহামারীর মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য স্থবির হয়ে পড়ায়  রাজস্ব আহরণে লক্ষ্যের চেয়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে এনবিআর। তারপরও কামাল আশা করছেন, নতুন অর্থবছরের সম্ভাব্য ব্যয়ের ৬৬ শতাংশ তিনি রাজস্ব খাত থেকে পাবেন।

তার প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা। এই অংক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ৮.৫ শতাংশ বেশি।

এই অঙ্ক বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জিডিপি প্রবৃদ্ধিতে ৮ দশমিক ২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি এবং ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকার যে (এনবিআরের মাধ্যমে রাজস্ব আদায়) লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, তা বাস্তবভিত্তিক নয়।”

এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম

একই কথা বলেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।

“রাজস্ব আদায়ের যে টার্গেট নেওয়া হয়েছে, এটা বাস্তবসম্মত নয়। এটা অর্জন করা সম্ভব নয়।”

পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বলেন, “বিদায়ী ২০১৯-২০ অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ের অবস্থা খুবই খারাপ।

“বছর শেষে খুব বেশি হলে ২ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকা আদায় হবে। এর চেয়ে ৫০/৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ৩ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা এই মহামারীর সময় কীভাবে আদায় হবে?”

“এমন উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনার কোনো মানে নেই বলে আমি মনে করি,” বলেন তিনি।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হানেরও একই মত।

“রাজস্ব আদায়ের যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, আমি মনে করি সেটা খুব বাস্তবসম্মত নয়। যে সঙ্কটটা দেখছি, তাতে এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব নয়।”

তবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ মনে করেন, অর্থনীতি ‘সোজা’ থাকলে এই রাজস্ব আদায় কঠিন হবে না।

তবে মহামারীকালে অর্থনীতি যে ‘সোজা’ নয়, তা আবার তার কথায়ই ফুটে উঠেছে।

“গত তিন মাস করোনাভাইরাস মহামারী দেশের অর্থনীতি অচল করে দিয়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য কিছু ছিল না। মানুষের আয় কমে গেছে। সুতরাং ভ্যাটও কমে যাবে। আমদানিও কমে যাওয়ায় আমদানি শুল্কও কমে যাবে। এটা হচ্ছে বাস্তবতা।”

সেলিম রায়হান বলেন, যদি লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী রাজস্ব আদায় না হয় এবং খরচ যদি আরও বাড়ার একটা চাপ থাকে, তাহলে বাজেট ঘাটতি আরও বাড়তে পারে।

“কিন্তু, আমি এটাকে বড় ধরনের সমস্যা মনে করি না। আমি মনে করি, বাজেট ঘাটতি যদি ৬-৭ শতাংশ বা তার থেকেও বেশি হয়, সামনের দুটো অর্থবছর আমাদের সেটি মেনে নিতে হতে পারে।”

চাপে পড়বে ব্যাংকগুলো

বাজেটের ব্যয় সংস্থানে সরকার দেশের ব্যাংকগুলো থেকে যে ৮৪ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য ঠিক করেছে, তাতে ব্যাংকগুলো চাপে পড়ার পাশাপাশি বেসরকারি বিনিয়োগ ব্যাহত হবে বলে মনে করেন অর্থনীতি বিশ্লেষকরা।

মির্জ্জা আজিজ বলেন, “এই বিপুল অর্থ ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া হলে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা ঋণ পাবেন না। এতে দেশের বিনিয়োগ পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যেতে পারে।”

আহসান মনসুর

আহসান মনসুর বলেন, “ব্যাংকগুলো সরকারের কোভিড-১৯ মহামারী মেকাবেলার জন্য বিশাল অংকের ঋণ দিচ্ছে। আবার সরকারও বড় অংকের ঋণ নেবে ব্যাংক থেকে। তাহলে ব্যাংকগুলো টাকা পাবে কোথা থেকে?”

সাবেক গভর্নর সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, “ব্যাংকিং সেক্টর থেকে এতগুলো টাকা নেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে বলে আমি মনে করি না।

“প্রণোদনা প্যাকেজ যেটা দিয়েছে, এটা পুরোটাই ব্যাংকনির্ভর। ব্যাংক থেকে এতগুলো টাকা নেওয়া মনে হয় সম্ভব হবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক পুনঃঅর্থায়ন করছে। তার মানে, ইনফ্যাক্টস সেন্ট্রাল ব্যাংক রিজার্ভ মানি থেকে এই অর্থ দেবে।”

“আয়-ব্যয়ের হিসাব একটু বাস্তবভিত্তিক হওয়া উচিৎ,” বলেন তিনি।

ব্যাংক খাত সংস্কারের কোনও ঘোষাণা না থাকাকে এই বাজেটের ‘দুর্বল’ দিক হিসেবে চিহ্নিত করেন সাবেক এই গভর্নর।

সালেহ উদ্দিন আহমেদ

“আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যাংক এমনিতেই দুর্বল অবস্থায় ছিল। তারপর করোনা আসার পর এটি আরও দুর্বল হয়েছে। সেখানে অন্তত সুশাসন, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতির ব্যাপারে অ্যাকশন নেওয়ার কথা বাজেটে বলা উচিৎ ছিল।”

একইভাবে পুঁজিবাজার নিয়েও কোনো সংস্কারের প্রস্তাব না থাকায় হতাশা প্রকাশ করেন সালেহ উদ্দিন।

সঙ্কটে থাকা ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজ বাস্তবায়নের সফলতা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন সেলিম রায়হান।

“ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সমস্যা আছে। ব্যবস্থাপনার সংকট আছে, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা আছে, খেলাপি ঋণের বড় ধরনের সংকট আছে। এরকম একটা সংকটগ্রস্ত ব্যাংকিং খাতের মাধ্যমে প্রণোদনা প্যাকেজ কীভাবে বাস্তবায়ন করা যাবে, সেটিরও একটা পথনির্দেশিকা বাজেটে থাকা দরকার।”

চাকরিহারাদের জন্য কিছু কই?

এই মহামারীতে যারা কর্ম হারিয়েছেন, তাদের জন্য কোনো বরাদ্দ না দেখে হতাশা প্রকাশ করেন আহসান মনসুর।

তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি অর্থমন্ত্রী।

সামাজিক নিরাপত্তা খাতে ৯৫ হাজার ৫৭৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে বাজেটে, যা মোট বাজেটের ১৬ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আর মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমিক ০১ শতাংশ।

আহসান মনসুর বলেন, “বিশাল অংকের এই টাকা সেই আগের মতোই খরচ করার কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। এই যে মহামারীতে কাজ না থাকায় বিপুল অংকের লোক চাকরি হারিয়েছেন এবং হারাবেন, তাদের জন্য কিছুই বলা হয়নি বা রাখা হয়নি।”

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের (এসএমই) ক্ষতি পুষিয়ে দিতে কোনো দিকনির্দেশনাও বাজেটে না থাকার দিকটি তুলে ধরেন তিনি।

সেলিম রায়হান বলেন, “আমি মনে করি, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ আরও বাড়ানোর প্রয়োজন ছিলো, যেভাবে স্বাস্থ্যখাতেও আমি মনে করছি বরাদ্দ আরো বেশি বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল।”

জায়েদ বখত

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির প্রাদুর্ভাবটা কতদিন থাকে, তার উপরে ২০২০-২১ সালের বাজেটের সফলতা অনেকাংশে নির্ভরশীল।

“এদিক থেকে একটা অনিশ্চয়তার ব্যাপার তো থেকেই যায়,”, তিনি।

ফরাসউদ্দিন বলেন, চীন থেকে ব্যাপকভাবে অন্য দেশে যে বিনিয়োগ স্থানান্তর হচ্ছে, তা বাংলাদেশে টেনে আনার কৌশল নিতে হবে।

“কোরিয়া ইপিজেডে বিনিয়োগকারীর সঙ্গে একটা সমস্যা আছে। এটা বাইরে খারাপ সংবাদ যাচ্ছে। এই সমস্যা মিটিয়ে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগবান্ধব কৌশল নিতে হবে।”