বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যের অর্ধেক

কোভিড-১৯ মহামারীর ধাক্কা বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহেও পড়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 June 2020, 03:09 PM
Updated : 5 June 2020, 03:09 PM

এমনিতেই এক বছরেরও বেশি সময় ধরে টানা নামছিল বিনিয়োগ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান নিয়ামক বেসরকারি খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি, এপ্রিলে তা ৯ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে।

এই প্রবৃদ্ধি গত দশ বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম।

বাংলাদেশ ব্যাংক বৃহস্পতিবার সর্বশেষ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, এপ্রিল মাসে এই প্রবৃদ্ধি ৮ দশমিক ৮২ শতাংশে নেমে এসেছে। অর্থাৎ গত এপ্রিল শেষে বেসরকারি খাতে এক বছর আগের চেয়ে ঋণ বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৮২ শতাংশ।

আগামী ৩০ জুন শেষ হতে যাওয়া ২০১৯-২০ অর্থবছরের মুদ্রানীতিতে এই ঋণের প্রবৃদ্ধির প্রাক্কলন করা হয় ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ।

সেখানে প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধি নিয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এমনিতেই বেশ কিছু দিন ধরে দেশে বিনিয়োগ পরিস্থিতি স্থবির হয়ে আছে। সরকারি বিনিয়োগ কিছুটা বাড়লেও বেসরকারি খাতে বাড়েনি। কোভিড-১৯ এর ধাক্কায় এখন সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতেই বিনিয়োগ কমছে।”

তার প্রভাব বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবাহে পড়েছে বলে মনে করেন তিনি।

ব্যবসায়ী শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই সভাপতি শেখ ফজলে ফাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “করোনাভাইরাসের কারণে আমরা গভীর সংকটের মধ্যে আছি। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহ বাড়িয়ে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমেই এ সংকট মোকাবেলা করতে হবে।”

আর সেজন্য সরকার ১৯টি প্রণোদনা প্যাকেজের মাধ্যমে এক লাখ পাঁচ হাজার কোটি টাকার যে প্যাকেজ ঘোষণা করেছে, তা দ্রুত সফলভাবে বাস্তবায়নের অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৩২ শতাংশ। আর সরকারের ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ দশমিক ৩৭ শতাংশ।

ওই মন্থর গতির কারণে গত বছরের ৩১ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক ২০১৯-২০ অর্থবছরের যে মুদ্রানীতি ঘোষণা করে, তাতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবাহের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য আগের চেয়ে কমিয়ে ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ ধরা হয়।

মুদ্রানীতি ঘোষণার সময় গভর্নর ফজলে কবির বলেছিলেন, “আগের মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ১৬ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হলেও অর্জিত হয় ১১ দশমিক ৩ শতাংশ। তা থেকে বাড়িয়ে এবার ১৪ দশমিক ৮০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি আশা করা হচ্ছে।”

তবে উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুদ্রানীতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ বাড়ার যে লক্ষ্য ধরেছে, বর্তমান অঙ্ক তার থেকে ৬ দশমিক শতাংশ পয়েন্ট কম। অর্থাৎ লক্ষ্যের প্রায় অর্ধেক।

অন্যদিকে মুদ্রানীতিতে সরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ধরা হয় ২৪ দশমিক ৩ শতাংশ। জানুয়ারিতে অবশ্য তা বাড়িয়ে ৫৬ শতাংশ করা হয়। কিন্তু এপ্রিল শেষে সেটাও ছাড়িয়ে ৭৪ দশমিক ৫৫ শতাংশে উঠেছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ। আগের মাস নভেম্বরে প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশ।

অক্টোবরে ছিল ১০ দশমিক ০৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। আগস্টে ছিল ১০ দশমিক ৬৮ শতাংশ। তার আগের মাস জুলাইয়ে ছিল ১১ দশমিক ২৬ শতাংশ।

তার আগে জুনে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ২৯ শতাংশ, মে মাসে ১২ দশমিক ১৬ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ১২ দশমিক শূন্য ৭ শতাংশ, মার্চে ১২ দশমিক ৪২ শতাংশ।

জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারিতে ছিল যথাক্রমে ১৩ দশমিক ২০ শতাংশ ও ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ।

লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম রাজস্ব আদায় এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমে যাওয়ায় প্রয়োজনীয় খরচ মেটাতে বাধ্য হয়েই সরকারকে ব্যাংক থেকে প্রচুর ঋণ নিতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যান আহসান মনসুর বলেন, “আমাদের জিডিপিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব রয়েছে বেসরকারি খাতের। এখানে ঋণ প্রবৃদ্ধি ধারবাহিকভাবে কমে যাওয়ার মানে কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে। এটা প্রবৃদ্ধি, উৎপাদন ও সেবা খাতের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।

“করোনাভাইরাসের কারণে সামনে পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।”

ফজলে ফাহিম বলেন, “দুই মাসের বেশি সময় দেশে ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধই ছিল। এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি কম হওয়াটাই স্বাভাবিক। এখন সব কিছু খুলে দেওয়া হলেও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কিন্তু পুরোপুরি সচল হয়নি। সবার মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বিরাজ করছে। পরিস্থিতি কবে স্বাভাবিক হবে, তা অনিশ্চিত।

“এমনও হতে পারে এই কোভিড-১৯ এর সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের আরও কিছু দিন চলতে হবে। সে অবস্থায় বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে গতি আনতে হবে।”

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, “সরকার যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে তার যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য আমরা বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে এফবিসিসিআইয়ে একটি ‘হেল্পডেস্ক’ খুলেছি। ছোট-বড় সব উদ্যোক্তাদের এই ‘হেল্পডেস্ক’ থেকে প্রয়োজনী সহায়তা নিতে অনুরোধ করছি।”

একইসঙ্গে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বাড়াতে নতুন বাজেটে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য সরকারকে অনুরোধ জানান তিনি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য ঘেটে দেখা যায়, ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৬ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ। এরপর থেকে গত বছরের অক্টোবর পর্যন্ত টানা ৯ বছর প্রতি মাসে ঋণ প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ শতাংশের উপরে।

গত নভেম্বরে এই প্রবৃদ্ধি এক অংকে (সিঙ্গেল ডিজিট) ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে নেমে আসে। ডিসেম্বরে তা আরও কমে ৯ দশমিক ৮৩ শতাংশ হয়। এভাবে প্রতি মাসেই নামছে।