অর্থনীতি সচল হবে কীভাবে, আঁক কষছেন জার্মান বিশেষজ্ঞরা

নভেল করোনাভাইরাসের মহামারী নিয়ন্ত্রণে মানুষকে ঘরে রাখতে ও নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে কল-কারখানা, অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ বন্ধসহ বিশ্বজুড়েই সার্বিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রায় অচল থাকায় ক্ষতির বোঝা প্রতিদিনই বাড়ছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 April 2020, 09:40 AM
Updated : 9 April 2020, 05:15 PM

অভূতপূর্ব এই মহামারী কবে নাগাদ সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণে আসবে সে বিষয়ে এখনই কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দীর্ঘমেয়াদে কর্মকাণ্ডে কড়া বিধি-নিষেধ চালু থাকলে খাদ্য ও স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

সে কারণে মহামারী ছড়িয়ে পড়া অব্যাহত থাকার মধ্যেই কীভাবে প্রাদুর্ভাব কমানোর সুযোগ নিয়ে কল-কারখানা, অফিস-আদালত ও স্কুল আস্তে আস্তে খোলা যায় তা নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে অনেক দেশ।

ইউরোপের প্রথম দেশ হিসেবে এরই মধ্যে অস্ট্রিয়া ইস্টার উৎসবের পর দোকানপাট চালু করার ঘোষণা দিয়েছে বলে সিএনএন জানিয়েছে।

নভেল করোনাভাইরাসে জার্মানিতে এখন এক লাখের বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে দুই হাজার জনের বেশির মৃত্যু হয়েছে।

এই মহামারী ছড়ানো ঠেকিয়ে কীভাবে সুনির্দিষ্ট কারখানা ও কর্মীদের কর্মকাণ্ড শুরু করা যায় সে বিষয়ে একটি সুপারিশ তৈরি করছেন ইউরোপের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশটির অর্থনীতিবিদ, আইনজীবী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি দল।

সিএনএন বলছে, গত সপ্তাহে আইএফও ইনস্টিটিউট ফর ইকনোমিক রিসার্চে প্রকাশিত বিশেষজ্ঞ দলটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের কোনো কার্যকর চিকিৎসা বা ভ্যাকসিন ২০২১ সালের আগে আবিষ্কার করা সম্ভব বলে তারা মনে করেন না। তাই এই রোগের বিরুদ্ধে জার্মানিকে ‘স্প্রিন্টের বদলে ম্যারাথন’গতিতে লড়ার সুপারিশ করেছেন তারা।

তারা লিখেছেন, “এমনভাবে পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে সেগুলো সুস্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় মেয়াদের সময়কালের জন্য টেকসই হয়। রাজনীতি, প্রশাসন, কোম্পানি ও অন্য সব সংস্থার ক্ষেত্রেই এ রকমের রূপান্তর প্রক্রিয়া অনুসরণ করা উচিত।”

অর্থনৈতিক মন্দার দোরগোড়ায় থাকায় জার্মানি মহামারী ঠেকাতে অন্তত ২০ এপ্রিল পর্যন্ত স্কুল রেস্তোরাঁ খেলার মাঠ ক্রীড়াঙ্গন এবং অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ রেখেছে। এই বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেওয়ার কোনো সময়সূচি এখনও বলে সরকারের মুখপাত্র স্টিফেন সিবার্ট বলেছেন।

আইএফও-এর পূর্বাভাস বলছে, লকডাউন পরিস্থিতি আরো তিন মাস অব্যাহত তাহলে জার্মানি অন্তত ২০ শতাংশ জিডিপি হারাবে।

কীভাবে ফের স্বাভাবিক হবে অর্থনীতি

অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দেওয়া, কোম্পানির কিছু অংশ অধিগ্রহণ করা এবং শ্রমিকদের ছুটিতে ভর্তুকির মতো পদক্ষেপসহ প্রায় ৮২৫ বিলিয়ন ডলারের তহবিল এরই মধ্যে ঘোষণা করেছে জার্মান সরকার।

অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ও জনজীবনে আরোপিত বিধি নিষেধ কবে নাগাদ সহজ করা যায় এবং কারখানাগুলোতে কখন উৎপাদন শুরু করা যায় সে বিষয়ে সুপারিশমালা তৈরি জন্য বিশেষজ্ঞ ও জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় টাস্কফোর্স গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে জার্মানির বিশেষজ্ঞদের প্রতিবেদনে।

এতে বলা হয়েছে, অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রাখা টেলিযোগাযোগ ও অটোমোবাইল উৎপাদনের মত কারখানাগুলো প্রথমে চালু করা যায়। অন্যদিকে বাড়িতে থেকে যে সমস্ত কাজ করা যায় সেগুলো দূরে থেকেই সারা উচিত। শিশুদের মধ্যে তেমন মারাত্মক উপসর্গ এখনো পর্যন্ত দেখা না দেওয়ায় নার্সারি ও স্কুলগুলো দ্রুত খুলে দেওয়া যায়। কিন্তু শিশু সেবা কেন্দ্র এবং স্কুল চালু না হলে পিতামাতাদের কর্মস্থলে যাওয়া বন্ধ রাখা উচিত।

ক্লাব ও বড় অনুষ্ঠান বন্ধই থাকবে

স্বাস্থ্যসেবা পণ্য ও উপাদান প্রস্তুতকারী কোম্পানিগুলো দ্রুত চালু করার পক্ষে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। অন্যদিকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা খুব কঠিন বলে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে নিয়ন্ত্রিত পরিচালনা নিশ্চিত করে হোটেল ও রেস্তোরাঁ স্থাপনাগুলো খোলার অনুমতি দেওয়ার পক্ষে তারা।

সেসঙ্গে ডিস্কো ক্লাব বন্ধ রাখা ও ব্যাপক সংখ্যক দর্শক নিয়ে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন না করার সুপারিশ রয়েছে প্রতিবেদনে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন ধরনের মানদণ্ড নির্ধারণ করা যায়। গ্রামীণ এলাকাসহ সেসব অঞ্চলে নিম্ন পর্যায়ে সংক্রমণের হার ও ঝুঁকি কম রয়েছে, সেগুলোতে প্রথমে বিধি-নিষেধ শিথিল করা যায়। এরপর যেসব এলাকায় মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়েছে সেগুলোতে বিধি-নিষেধ কমিয়ে দেওয়া যায়।

তবে এর জন্য অবশ্যই সমন্বিত ও বৃহদাকারের করোনাভাইরাস পরীক্ষা ব্যবস্থা নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বলে সুপারিশ করা হয়েছে। পাশাপাশি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে সমন্বিত প্রশিক্ষণ এবং ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবহার বাধ্যতামূলক করার বিষয়ে নতুন নীতিমালা গ্রহণও জরুরি।

ব্যক্তিগত সুরক্ষা পোশাক ও মাস্কের উৎপাদন ব্যাপক বাড়ানো ওষুধ ও ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষমতা বাড়ানো এবং কৌশলগত পরিকল্পনার জন্য একটি তথ্যপ্রযুক্তি প্ল্যাটফর্ম প্রতিষ্ঠিত করার ওপর জোর দিয়েছেন জার্মানির বিশেষজ্ঞরা।

তারা বলছেন, অর্থনীতি পুনরায় চালু করার বিষয়ে জাতীয় টাস্কফোর্স সুপারিশ দিলেও কখন বিধিনিষেধ তুলে নেওয়া হবে সেই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেবেন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী নেতারা।

"তবুও উৎপাদন ও কাজ শুরুর বিষয়টি এখনই কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। প্রথমত প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিগুলো নিজেরাই করবে।”

নজর দিতে হবে চীনের দিকে

দ্বিতীয় দফায় করোনাভাইরাসের সংক্রমণের মুখে যেসব দেশ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে তারা এক্ষেত্রে চীনের দিকে নজর দিতে পারেন বলে সিএনএনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

মহামারী ছড়ানো নিয়ন্ত্রণে বেইজিংয়ের কড়া পদক্ষেপ নেওয়ার পর কয়েক দশকের মধ্যে এবারই প্রথম প্রান্তিকে চীনে অর্থনৈতিক সংকোচন দেখা দিয়েছে।

অর্থনীতি রক্ষায় আগ্রাসী পরিকল্পনা নিয়েছে চীন; মানুষকে কাজে ফেরানোর পরিকল্পনা নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছে, ব্যবসায় আস্থা বাড়াতে অনুপ্রেরণা দিচ্ছে এবং যথাসম্ভব কোম্পানিগুলোর পতন ঠেকাতে কাজ করছে।

স্বাস্থ্যসেবা উপকরণ ও চিকিৎসার জন্য শত শত কোটি ডলার খরচ করছে বেইজিং, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে অবকাঠামো প্রকল্পে সরাসরি অর্থও ঢালছে।

যেসব এলাকায় ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শেষ হয়েছে বলে মনে হচ্ছে, সেগুলোতে মানুষের অবাধে চলাফেরা নিশ্চিত করতে অবরোধ তুলে নিচ্ছ চীন।

তবে সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে গেছে এখনই এমন মনে করাটা বাড়াবাড়ি। সংক্রমণের বিষয়ে বেইজিং এখন সে তথ্য দিচ্ছে তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে।

চীনে ব্যাপক সংখ্যক মানুষকে সপ্তাহান্তে একসঙ্গে পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে ঘুরতে দেখা যাচ্ছে। পুনরুদ্ধার প্রচেষ্টাকে জটিলতার মধ্যে ফেলেও কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুব দ্রুত কাজে ফিরেছে। গত ফেব্রুয়ারিতে টাইটেনিয়াম উৎপাদনের একটি কারখানা ফের কাজ শুরু করেছিল, কিন্তু শ্রমিকরা ফের সংক্রমিত হওয়ার পর তা বন্ধ করা হয়।

ভারসাম্য চাই

সংক্রামক ব্যাধি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বিশেষজ্ঞ ডক্টর অ্যান্থনি ফাউচি বলেন, এখন জনস্বাস্থ্য সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পেলেও সমাজ ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে দীর্ঘকাল ধরে সম্পূর্ণ বন্ধ রাখলে তার বহু অনাকাঙ্ক্ষিত নেতিবাচক পরিণতি রযেছে।

বৃটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার বিবিসিকে বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে যে অর্থ ক্ষতি হচ্ছে তাতে তিনি ‘আতঙ্কিত’।

“এটা দীর্ঘ সময় চলতে থাকলে এক পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থাও ঠিকমতো পরিচালনায় বিঘ্ন ঘটাবে।”

সেন্টার ফর ইকোনমিকস অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের হিসেবে, এই মহামারীর কারণে প্রতিদিন বৃটেনের প্রায় ২ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে।

ফাউচি বলেন, বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়ানো অব্যাহত রাখার মধ্যে কর্মকাণ্ডে কীভাবে যথোপযুক্ত একটা ভারসাম্য তৈরি করা যায় তা নিয়ে সবাই ভাবছে।

নিউ ইয়র্ক টাইমসকে তিনি বলেন, পুষ্টি ও খাদ্যের জন্য মানুষ সরবরাহ ব্যবস্থার উপর নির্ভরশীল।

“আপনি যদি হঠাৎ করেই এই ব্যবস্থায় এমনভাবে হস্তক্ষেপ করেন যে এটার কোনো অস্তিত্বই আর না থাকে, তাহলে সেটা সমাজে মহাবিপর্যয় ডেকে আনবে। কাজেই আমাদেরকে একটা ভারসাম্য নিশ্চিত রাখার বিষয়ে নজর দিত হবে।”