প্রবৃদ্ধির সুফল মানুষ না পেলে উন্নয়ন বলা যায় না: সেলিম জাহান

জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন কার্যালয়ের সাবেক পরিচালক অর্থনীতিবিদ সেলিম জাহান বলেছেন, মাথা পিছু আয় বা জাতীয় আয় বৃদ্ধিই উন্নয়ন নয়, উন্নয়নের আসল  উদ্দেশ্য বা কেন্দ্রবিন্দু হল মানুষ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 August 2019, 07:56 PM
Updated : 31 August 2019, 07:56 PM

“যে উন্নয়ন মানুষের জীবনকে উন্নীত করে না, যে উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় নারীকে পাশ কটিয়ে যাওয়া হয়, যে উন্নয়ন পরিবেশের ক্ষতি করে, যে উন্নয়নে মানুষের কণ্ঠ বা বক্তব্য প্রতিফলিত হয় না সেটা প্রবৃদ্ধি মাত্র, উন্নয়ন নয়,” বলেছেন তিনি।

শনিবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত ‘উন্নয়ন, বঞ্চনা ও অসমতা’ শীর্ষক এক সেমিনারে তিনি একথা বলেন। সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি।

উন্নয়ন ও প্রবৃদ্ধির পার্থক্য তুলে ধরে অধ্যাপক সেলিম জাহান বলেন, “প্রবৃদ্ধি অনেক ক্ষেত্রেই হবে, হয়েছেও। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধির সুফল যদি মানুষের জীবনে প্রতিফলিত না হয় তাকে আর যাই হোক উন্নয়ন বলা যায় না।”

তিনি বলেন, “এই ধারণা থেকেই মানব উন্নয়ন ধারণার সৃষ্টি হয়েছে। মানব উন্নয়নের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে, মানুষের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা। ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিকসহ বিভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত নেওয়ার জায়গাটি আরও বিস্তৃত না করে সীমাবদ্ধ করে দিলে সেটাকে আর মানব উন্নয়ন বলা যাবে না।”

মানব উন্নয়নের ব্যাখ্যায় তিনি আরও বলেন, “চূড়ান্ত অর্থে মানব উন্নয়ন হচ্ছে, মানুষের জন্য উন্নয়ন, মানুষের উন্নয়ন এবং মানুষের দ্বারা উন্নয়ন। মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধি করলেই চলবে না, মানুষের জন্য সুযোগও সৃষ্টি করতে হবে।

“মানুষের উন্নয়ন যখন বলি তখন মানুষের সক্ষমতা বৃদ্ধিকেই আমরা বুঝি। মানুষের জন্য উন্নয়নের কথা যখন বলছি, তখন উন্নয়নের যে সুফল সেটা সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। আর মানুষের দ্বারা উন্নয়ন হলো, উন্নয়নে মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ।”

উন্নয়ন একটি বহুমাত্রিক বিষয় মন্তব্য করে ইউএনডিপির সাবেক এই পরিচালক বলেন, “আমি মনে করি, মানবিকতা, সম্মান, মর্যাদার উৎকর্ষ উন্নয়নের অন্যতম শর্ত। প্রবৃদ্ধির সফলতার সঙ্গে সঙ্গে মানবিকতার যে বিকাশ সেটি যদি না হয় তাহলে চূড়ান্ত বিচারে উন্নয়ন শুধুমাত্র একটি আনুষ্ঠানিক ব্যাপার থেকে যাবে। একটি প্রায়োগিক ব্যাপার থেকে যাবে।

“উন্নয়ন শুধু মানুষকে তার সক্ষমতার কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু মানুষের সাথে যে মানুষের সম্পর্ক সেখানে পৌঁছাতে পারবে না। মানবিকতা, মর্যাদা, সম্মানের ঘটতি থাকবে।”

‘দারিদ্র্য ও ‘বঞ্চনার’ ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, “দারিদ্র্য ও বঞ্চনাকে সমার্থক মনে হলেও দুটি প্রত্যয় সম্পূর্ণ আলাদা। বলা চলে দারিদ্র্য অনেকাংশে ঈশ্বরের সৃষ্টি। আর বঞ্চনা সম্পূর্ণভাবে মানুষের সৃষ্টি। সুশাসন থেকে, অংশগ্রহণ থেকে, অধিকার থেকে মানুষ যখন বঞ্চিত হয় সেটাকে বঞ্চনা বলে। অসমতা বঞ্চনার সৃষ্টি করে।

“মানুষ কখনও নিজেকে নিজে বঞ্চিত করে না। একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে বঞ্চিত করে। যে উন্নয়নে বঞ্চনা, অসমতা, দারিদ্র্য থাকবে সে উন্নয়ন কখনও মানুষের উন্নয়ন হতে পারে না।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক মাহবুবুল মোকাদ্দেম আকাশ (এম এম আকাশ) বলেন, “উন্নয়নের মর্মবস্তু আগে ঠিক করতে হবে। আর যাই হোক, মানুষের উন্নয়ন না হলে উন্নয়ন হয়েছে সে কথা আমরা বলতে পারি না।”

নব্বইয়ের দশক থেকে শিক্ষা, আয়ু ও জীবনমান পরিমাপ করে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ উন্নয়নের যে কাঠামো দাঁড় করিয়েছে তার সমালোচনা করে অর্থনীতির এই অধ্যাপক বলেন, “বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ মাথাপিছু উন্নয়ন মাপার কাজ করে থাকে, যা এখন পর্যন্ত মূল ধারার অর্থনীতিতে বহাল আছে।

“নব্বই দশক থেকে শিক্ষা, আয়ু এবং জীবনমান দিয়ে উন্নয়ন মাপার কাজটি করছে তারা। কিন্তু উন্নয়ন হচ্ছে মানুষকেন্দ্রিক এবং বহুমাত্রিক। অর্থাৎ উন্নয়নের সংজ্ঞায়নে একটি বিতর্ক থেকে যাচ্ছে। কে কোন মাত্রায় কোনটাকে উন্নয়ন বলছেন আর কে কোন মাত্রায় উন্নয়ন বলছেন না, সেই মাত্রাটাকে ঠিক করে নিতে হবে।”

এম এম আকাশ বলেন, “যদি উন্নয়নকে আপেক্ষিক অর্থে দেখি তাহলে দেখতে হবে আমরা যে জায়গায় ছিলাম সে জায়গা থেকে অগ্রসর হচ্ছি কি না। শিক্ষা, আয়ু, জীবনমানের দিক থেকে আমরা এগোচ্ছি কি না।”

গড় উন্নয়ন দিয়ে সার্বজনীন উন্নয়ন পরিমাপ করা যায় না বলে মনে করেন এমএম আকাশ।

তিনি বলেন, “শিক্ষার ক্ষেত্রে যদি বলি তাহলে আমরা দেখব যে, গড় শিক্ষা আমাদের বেড়েছে। আয়ুর ক্ষেত্রেও আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে এবং জীবনমানের ক্ষেত্রে আমাদের গড় জীবনমান বেড়েছে। এজন্যই শাসক দল হয়ত বলে থাকে যে, উন্নয়ন নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।

“কিন্তু এখানে একটি জটিল বিষয় আমাদের ভাবতে হবে। গড়ের বৃদ্ধি আর প্রত্যেকের বৃদ্ধি এক না। কাঠামোগতভাবে চিন্তা করলে ধনীদের গড় আয়ু থেকে দরিদ্রদের গড় আয়ু কম। এর কারণও আমরা জানি। কারণ জন্ম থেকেই তারা পুষ্টি কম পায়, আবার অসুখবিসুখ হলে চিকিৎসা পায় না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই তাদের গড় আয়ু কম হবে ধনীদের চেয়ে। অয়ের ক্ষেত্রে হিসাব করলে তো বিষয়টা আরও স্পষ্ট। গড় দিয়ে সার্বজনীন উন্নয়নের পরিমাপ করা যায় না। গড়ের উন্নয়ন আর সার্বজনীন উন্নয়ন সমার্থকও নয়।”

রাশেদ খান মেনন বলেন, “বাংলাদেশের উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু প্রবৃদ্দি ও জাতীয় আয়ের উন্নয়নের পাশাপাশি শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের পরিমাণগত উন্নয়নের সাথে তাকে মানসম্মত করতে হবে এবং উন্নয়ন হতে হবে মানুষের জন্য।

“তা না হলে সেই উন্নয়ন টেকসই হবে না। অসমতা ও বৈষম্য দূর করতে সরকার ও সংসদে শ্রমজীবী মানুষের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে।”

সভাপতির বক্তব্যে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক মাইনুল ইসলাম বলেন, “৪৮ বছরেও ভূমি ও কৃষি সংস্কার হয়নি। ভূমি ও কৃষি সংস্কার ছাড়া উন্নয়নের সুফল সবার ঘরে পৌঁছুবে না। উন্ননের সমতার জন্য শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থার দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে।”

সেমিনারে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ছাড়াও সাধারণ সম্পাদক কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা বক্তব্য দেন।