নয় মাসে ৬৮ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি

চলতি অর্থবছরের নয় মাসে ৬৮ হাজার কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এই অংক গত বছরের একই সময়ের চেয়ে সাড়ে ১৩ শতাংশ বেশি।

আবদুর রহিম হারমাছি প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2019, 05:57 PM
Updated : 20 May 2019, 06:04 PM

এই সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকার মতো; প্রবৃদ্ধির পরিমাণ ৮ দশমিক ২৩ শতাংশ।

আর এর ফলে বাজেট ঘাটতি মেটাতে সরকার চলতি অর্থবছরে সঞ্চয়পত্র থেকে যে পরিমাণ অর্থ ধার করার লক্ষ্য ধরেছিল, তার চেয়েও ৫২ শতাংশ বেশি নিয়ে ফেলেছে নয় মাসেই।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, চলতি ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে সবমিলিয়ে ৬৮ হাজার ২৫৮ কোটি টাকার বিভিন্ন ধরনের সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে।গত অর্থবছরের একই সময়ে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬০ হাজার ১২৫ কোটি টাকা।

এ হিসাবে জুলাই-মার্চ সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রি বেড়েছে ১৩ দশমিক ৫২ শতাংশ।

৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ

জুলাই-মার্চ সময়ে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি ২১ লাখ টাকা। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চ সময়ে নিট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩৬ হাজার ৭০৯ কোটি টাকা।

আগে বিক্রি হওয়া সঞ্চয়পত্রের সুদ-আসল পরিশোধের পর যা অবশিষ্ট থাকে, তাকে বলা হয় নিট বিক্রি। ওই অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা থাকে এবং সরকার তা রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে কাজে লাগায়।

বিনিময়ে সঞ্চয়পত্রের গ্রাহকদের প্রতি মাসে সুদ দিতে হয়। এ কারণে অর্থনীতির পরিভাষায় সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিকে সরকারের ‘ঋণ’ বা ‘ধার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।

সে হিসাবে জুলাই-মার্চ সময়ে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ৩৯ হাজার ৭৩৩ কোটি ২১ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছে।

ফাইল ছবি

অথচ এবারের বাজেটে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ২৬ হাজার ১৯৭ কোটি টাকা ঋণ বা ধার করার লক্ষ্য ঠিক করেছিল।

এ হিসাবেই অর্থবছরের নয় মাসেই সঞ্চয়পত্র থেকে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও প্রায় ৫২ শতাংশ বেশি অর্থ ধার করে ফেলেছে সরকার।

নিরাপদ বিনিয়োগ’ বলেই এতো বিক্রি

পুঁজিবাজারের অস্থিরতা আর ব্যাংকে আমানতের সুদের হার কম থাকায় গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র সাধারণের কাছে ‘বিনিয়োগের নিরাপদ ক্ষেত্র’ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কিছুটা বাড়ানোর পরও সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমেনি; উল্টো বেড়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) গবেষক জায়েদ বখত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকগুলো আমানতের সুদহার কিছুটা বাড়িয়েছে…। কিন্তু মানুষ ব্যাংকের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না। নিরাপদ বিনিয়োগ ভেবে সঞ্চয়পত্রই কিনছে।

পুঁজিবাজারে দীর্ঘদিনের মন্দার কারণেও সঞ্চয়পত্র বিক্রি বেড়েছে বলে মনে করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত।

বিক্রির লাগাম টেনে ধরতে ২০১৫ সালের ১০ মে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ হার গড়ে ২ শতাংশ কমানো হয়েছিল। কিন্তু বিক্রি কমেনি।

এর পরেও দুই দফা সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু শেষ পর‌্যন্ত কমানো হয়নি।

জায়েদ বখত বলেন, “এভাবে সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়তে থাকলে সরকারের ভবিষ্যৎ ঋণের বোঝা বেড়ে যাবে। সেই বোঝা কমাতেই এর সুদের হার কমানো উচিৎ বলে আমি মনে করি।”

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য ‘পেনশনার সঞ্চয়পত্র’ এবং মহিলাদের জন্য ‘পরিবার সঞ্চয়পত্র’ ছাড়া অন্য সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কমানোর পরামর্শ দেন এই অর্থনীতিবিদ।

জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের তথ্য পর‌্যালোচনায় দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই সঞ্চয়পত্র বিক্রি বাড়ছে। ২০১১-১২ অর্থবছরে মোট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ১৮ হাজার ৯৫৫ কোটি ৩৫ লাখ টাকা। ২০১২-১৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৩ হাজার ৩২৭ কোটি টাকা।

২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫ এবং ২০১৫-১৬ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ২৪ হাজার ৩১০ কোটি, ৪২ হাজার ৬৬০ কোটি এবং ৫৩ হাজার ৭১২ কোটি টাকা।

২০১৬-১৭ অর্থবছরে বিক্রির পরিমাণ ছিল ৭৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা। গত ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিক্রি হয় ৭৮ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র।

মার্চে বিক্রি ৭২৪৬ কোটি টাকা

সর্বশেষ মার্চ মাসে ৭ হাজার ২৪৬ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। নিট বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ১৩১ কোটি টাকা।

গত বছরের মার্চে সঞ্চয়পত্রের মোট বিক্রির পরিমাণ ছিল ৬ হাজার ২৯৩ কোটি টাকা।নিট বিক্রির ছিল ৩ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা।

জুলাই থেকে সঞ্চয়পত্র কেনাবেচা অনলাইনে

এদিকে আগামী অর্থবছর অর্থাৎ ১ জুলাই থেকে সারা দেশের সঞ্চয়পত্র কেনাবেচা কার্যক্রমকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার (অনলাইন) মধ্যে নিয়ে আসার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

ইতোমধ্যে রাজধানী ঢাকা এবং বিভাগীয় শহরে অনলাইন ব্যবস্থায় সঞ্চয়পত্র কেনাবেচা কার্যক্রম চালু হয়েছে। জুন মাসের মধ্যে দেশের সব স্থানে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু করতে বলা হয়েছে।

১ জুলাই থেকে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূতভাবে কোনো সঞ্চয়পত্র লেনদেন করা যাবে না বলে আগেই জানিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।

গত ২৪ মার্চ এ বিষয়ে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল অর্থমন্ত্রণালয়। সেই প্রজ্ঞাপনের সূত্র ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এক সার্কুলার জারি করে ব্যাংকগুলোকে ঐ নির্দেশ দেয়।

অর্থ বিভাগ ‘সরকারি ব্যয় ব্যবস্থাপনা শক্তিশালীকরণ: অগ্রাধিকার কার্যক্রমগুলোর ধারাবাহিকতা রক্ষা’ শীর্ষক যে কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে, তার আওতায় ‘জাতীয় সঞ্চয় প্রকল্প অনলাইন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি’ নামের একটি কর্মসূচি নেয়া হয়।

এই কর্মসূচি সঞ্চয়পত্রের প্রতি মাসের সুদ বা মুনাফা এবং মেয়াদ শেষে আসলকে বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক ফান্ড ট্রান্সফার নেটওয়ার্কের (বিইএফটিএন) মাধ্যমে সরাসরি গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হয়।