মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ-বিডা আয়োজিত ‘ন্যাশনাল স্টিয়ারিং কমিটি অন ইজি অব ডুইং বিজনেস’ কমিটির সভায় একথা বলেন তিনি।
আলোচনায় বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ ব্যবসায়ী উদ্যোগে জমি ও অন্যান্য বিষয়ে ছাড়পত্রে জটিলতা এবং সে সব ছাড়াতে কারও কারও জন্য তার হস্তক্ষেপের কথা তুলে ধরেন।
এ ধরনের কাজে নিজেরও ফোন দিতে হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “টেলিফোনের ব্যবহার করা অন্যায় কিছু নয়, কাজ করার জন্য টেলিফোন করলাম এটা ডুইং মাই জব। এটা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে, তদ্বির জিনিসটা খুব খারাপ না।”
এই অবস্থানের পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতে এ ধরনের চর্চা থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেন মুহিত।
তিনি বলেন, “নিউই য়র্কে সিটি সার্ভিসটা পেতে হলে সিটি অফিসে যেতে হয়, সেখানে একটা সার্ভিস আছে তদ্বিরকারক দালাল সার্ভিস, সেখানে পে করতে হয়। রাস্তা দেখালো এজন্য পেইড অফ ইট। দিল্লিতে অ্যাপোলো হাসপাতালে গেলাম, একটা লোক হাজির হল সে হল দালাল, সে বলল, আমি অফিসটাকে ভালো চিনি আপনি আমার সাথে আসেন। সে সব চিনে কাজ শেষে আপনাকে ছেড়ে দেবে, সব রিপোর্ট সংগ্রহ করে আপনাকে দিয়ে যাবে। এভাবে সেবা দেওয়া হয়।
“আমরা বিভিন্ন সার্ভিস দেই বিভিন্ন খানে, এটার কোনো হিসাব হয় না, সেটাকে সিস্টেমে ঢুকিয়ে ফেললেন, সিস্টেমে ঢুকিয়ে ফেললে এটা হয়ে যাবে লিগ্যাল, অ্যান্ড অলসো সার্ভিসটা সহজ হবে।”
এটাকে লবিস্ট না দালাল বলা হবে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “অর্থমন্ত্রী এটা কথার কথা বলেছে। এটাকে অন্যভাবে নিয়ে ভেজাল লাগাবেন না।”
তখন অর্থমন্ত্রী বলেন, “এই সার্ভিসগুলো আছে এবং যেগুলোকে সার্ভিস হিসেবে ট্রিট করে। ঘুষ অনেক কমে যাবে। এখানে অনৈতিক কোনো কাজকে নৈতিক করার বিষয় নেই।
“আমার যখন সেবা দেই, সরকারি যারা কাজ করি সেবাটা দেওয়ার সময় মনে করি, এটি আমার কর্তব্য এবং এটির জন্য আই অ্যাম পেইড। সিমিলারলি যারা অন্য লোকের জন্য তদ্বির করে, দায়িত্বটা নিচ্ছে, অন্য লোকের কাজ করছি পয়সা হোক না হোক, যথাযথভাবে কাজ করি, কাজ না না করে যেন চিট করা যেন না হয়। আমরা অনেক বিষয়ে একটু স্বচ্ছ ও সচেতন হই, অনেককে অন্যায় বলে বিবেচনা করা হয় সেটাকে অন্যায় না রেখে ন্যায়িক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারি।”
ছয় দশকের বেশি কর্মজীবনে সরকারি কর্মকর্তার পাশাপাশি মন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা মুহিত বিশ্বের বিভিন্ন উন্নত দেশ ঘুরেছেন, সেখানকার ব্যবস্থা সম্পর্কে অনেকটাই অবগত তিনি। তবে ইউরোপ-আমেরিকায় বাংলাদেশের মতো এত ঘনবসতি নেই, সেবাগ্রহীতাদের চাপও সেখানে এতটা নয়।
আলোচনায় তিনি জানতে চান: “বছরখানেক আগে আমরা এক বৈঠকে ঠিক করেছিলাম, কেউ দরখাস্ত করলে বিনিয়োগের জন্য সাত মাসের মধ্যে রিপ্লাই পাবে, এ সময়ে অন্য কোনো দুয়ারে যেতে হবে না। এ ধরনের কতটি অ্যাপ্লিকেশন পেয়েছেন, কতটি ডিসপাস করেছেন?”
এ বিষয়ে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, “এ সিস্টেম রেডি হচ্ছে, এ প্রক্রিয়া জানুয়ারি থেকে শুরু হবে।”
অর্থমন্ত্রী বলেন, “এক সময় দেশে যারা বিনিয়োগ করত তারা ইনভেস্টমেন্টটা করে যে লোনটা পেয়েছে, সেটা আর ফেরত দিতে হবে না ভাবত। মনে করত এত কষ্ট করে টাকাটা পেলাম সেটা আর ফেরত দিতে হবে না। বর্তমান যারা বিনিয়োগ করেন তারা সে রকম চিন্তা করেন না, তারা মনে করেন কীভাবে ফেরত দিতে হবে।
“আমাদের গ্রোথ ৭ পয়েন্ট ৮ হয়ে গেছে। ইকোনমি ফাস্ট মুভ করছে মানে হ্যাসল অনেক কমে যাচ্ছে।”
বাংলাদেশে ব্যবসা করা অনেক সহজ মন্তব্য করে মুহিত বলেন, “একটি ঠেলাগাড়ি নিয়ে গেলে ব্যবসা করতে পারেন, একটা জায়গা দখল আইনি বা বেআইনি দখল করতে পারলেও ব্যবসা করতে পারেন। এমন অবস্থা চিন্তা করা উচিত, একটি লোক ট্রেড লাইসেন্স নিলে আর যেন কোনো লাইসেন্স নিতে না হয়। ট্রেড লাইসেন্স পেলে বোর্ড অব রেভিনিউয়ের আওতায় চলে যায়, ট্রেড লাইসেন্স পেলে যেন আর কিছুর জন্য মাথা ঠুকতে না হয়।
বন্দরগুলোর সুবিধা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “আমদানির বিষয়ে একটাই বিপদ বন্দরে, রিলিজের বিষয়ে আমরা অনেকটা পিছিয়ে আছি। বন্ডেড ওয়্যারহাউজে বিষয়গুলো সহজ হচ্ছে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে উন্নত হয়েছে, বন্দর থেকে মাল খালাস করায় দুর্বলতা আছে। এটার প্রতি নজর দিতে হবে, রোর্ড অব রেভিনিউ ইনভল্ব, নৌমন্ত্রী তাদের চাপে রাখবেন। আভ্যন্তরীণ বিষয়ে মন্ত্রণালয়গুলোতে আরো প্রযোজনীয় চাপ প্রয়োগ করতে পারি।”
বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেন, “ব্যবসা বাণিজ্যকে সহজীকরণের কথা বলা হচ্ছে, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিবেদনে ১৯০টি দেশের মধ্যে আমাদের হচ্ছে ১৭৬। আমরা যদি মূল্যায়ন করি দেখব, একটা ক্ষেত্রে ছাড়া সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে আছি। আমাদের উন্নয়ন মডেল ঈর্ষণীয়। আমার রপ্তানি টার্গেট যা করি, তার বেশি হয়।
“সকল ক্ষেত্রে এগিয়ে গেলেও ইজি অব ডুইং বিজনেসে কেন এগিয়ে যেতে পারছি না? শুরুর দুই বছর পরে এই প্রথম সভা হল স্টিয়ারিং কমিটির, ইজি অব ডুইং বিজনেসে এগিয়ে যাব কীভাবে? এখানে কোনো ব্যবসায়ী প্রতিনিধি নেই, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি থাকলে বলতে পারত কী রকম সমস্যার মধ্যে কাজ করে চলেছেন, আমাদের অর্থনীতির চালিকাশক্তি তারা। এক্সপোর্ট করে ব্যবসায়ীরা, ইজি অব ডুইং বিজনেস সাফার করলে তো তারা করবে, ব্যবসায়ীরা কঠিন অবস্থার মধ্যে ব্যবসা করে।”
এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্প্রতি আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তোফায়েল আহমেদ বলেন, “কেউ কিছু মনে করবেন না, তিনি বলেছেন- ইজি অব ডুইং বিজনেসের জন্য চেষ্টা করে না, চেষ্টা করে সেমিনারের জন্য, দেশে- বিদেশে সেমিনার, গোয়িং টুর আদার কান্ট্রি ফর সেমিনার। সিঙ্গাপুরে সেনিমার করি, অমুক জায়গায় সেমিনার করি, কিন্তু উন্নয়নের ধারে কাছে নেই।”
ব্যবসায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা দূর করতে তার ফোন করতে হয় জানিয়ে তোফায়েল বলেন, “পিএইচপি গ্রুপ প্রোটন কার অ্যাসেম্বল করার কথা বলেছে, আমরা দিয়ে দিয়েছি। অন্য জায়গায় গেলে আমার জমি আরেকজন ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করব ট্রান্সফার করতে দুই বছর লাগে। একজন জয়েন্ট সেক্রেটারি থেকে আরেকজনের কাছে যায়, পড়ে থাকে। এগুলো খেয়াল করতে হবে।
“ওয়ার্কস মিনিস্ট্রি… ইসলাম গ্রুপের জমি আছে তেজগাঁওয়ে সাড়ে ৫ বিঘা কিনেছে মেঘটান গুপ আড়াইশত কোটি টাকা দিয়ে, সব ঠিক... ঘাটে ঘাটে আটকে থাকে। পরে আমি ফোন করেছি পার্সোনালি পরে সেক্রেটারি সাহেব নিজে রেসপনসিবিলিটি নিয়ে করে দিয়েছেন, কোনো টাকা পায়সার লেনদেন নাই।
“ফোন করতে হবে কেন, এটি তো আমার দায়িত্ব না। আসে আবার আমার কাছে, একটু বলে দেন একটু বলে দেন। এখানে সাংবাদিক আছে আর কিছু বললাম না।”
উপরের দিকে ঠিক থাকলেও নিচে ফাইল আটকে থাকে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান বলেন, “২০০৯ সালে আমাদের অবস্থান ছিল ৯৮তম, এখন ৭০তম অবস্থানে রয়েছি বন্দরগুলোতে। বন্দরগুলো অটোমেশন করা হয়েছে, কারণ মানুষ আমাদের কাছে সেবা চায়। চট্রগ্রাম বন্দরে কাস্টমসে লোকবল না থাকায় জটিলতার সৃষ্টি হওয়ায় শুল্কায়নে জটিলতায় ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সেবার মান যত বাড়াতে পারব ব্যবসায়ীরা আরও সুযোগ সুবিধা পাবে।”
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু বলেন, “ইজি অব ডুইং বিজনেসে অন্য দেশগুলোর সাথে যদি প্রতিযোগিতা করতে যাই তাহলে দেখা যায়, তারা টেকনোলজিতে চলে গেছে, আমরা পিছিয়ে আছি। বিদ্যুতের ফর্ম অনলাইনে থাকলেও বাকিগুলো ম্যানুয়ালি হচ্ছে, টেকনোলজিতে আপডেট না হলে ইনডেস্ক বেটার হবে না। টেকনোলজি অ্যাডাপ করতে হবে দ্রুত এগিয়ে থাকার জন্য।
“ইজি অব ডুইং বিজনেসে ফর্ম ফিলাপের কথা বাদ দিলাম, মেইল করলেই রিপ্লাই করা হয় না। ইজি অব ডুইং বিজনেস করতে চান, এই সাবজেটগুলো ইজি করতে হবে। কতগুলো ফাইল ছাড়া হয়েছে প্রযুক্তির মাধ্যমে দিতে হবে, মনিটরে উঠবে।”
অনুষ্ঠানের শুরুতে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম বলেন, “বিনিয়োগ পরিবেশ আরো সহজ করতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সংস্কার কার্যক্রম বাস্তবায়নে জানুয়ারি থেকে উদ্যোগ নেওয়া হবে। ওয়ান স্টপ সার্ভিস জানুয়ারি থেকে শুরু হবে, তখন কোনো বিনিয়োগকারীকে কর্মকর্তাদের কাছে যেতে হবে না।”
“আমরা হোম ওয়ার্ক করছি, এতে করে হয়ত বা আগামী মাস নাগাদ বিভিন্ন পেন্ডিং ইস্যুগুলো নিয়ে আসা হবে। জমি সংক্রান্ত, ভবন নির্মাণ ইত্যাদি বিষয়ে ওয়ান স্টপ সার্ভিস শুরু হবে। এ কাজ শুরু করতে পারলে ইজি অব ডুইং বিজনেস স্ট্যাটাসে খুব দ্রুত এগিয়ে যেতে পারব।”