বাণিজ্য ঘাটতি ‘পৌঁছাতে পারে’ ২০ বিলিয়ন ডলারে

বিদায়ী অর্থবছরের শেষ মাসের বৈদেশিক বাণিজ্যের তথ্য প্রকাশ না হলেও ১১ মাসেই বাণিজ্য ঘাটতি আগের অর্থবছরের প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।

আবদুর রহিম হারমাছিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2018, 02:20 PM
Updated : 10 July 2018, 02:20 PM

৩০ জুন শেষ হওয়া ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১১ মাসেই পণ্য বাণিজ্যে ঘাটতি ১৭ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে, যেখানে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে এই ঘাটতি ছিল ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলার।

গেল অর্থবছরের শেষ মাসের (জুন) তথ্য পাওয়া গেলে সামগ্রিক এই ঘাটতি ২০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছাবে বলে মনে করছেন অর্থনীতির গবেষক আহসান এইচ মনসুর।

এর আগে বাংলাদেশে সর্বোচ্চ বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ৯ দশমিক ৯৩ বিলিয়ন ডলার, ২০১০-১১ অর্থবছরে।

২০১৭-১৮ অর্থবছরে বিপুল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধির পেছনে বিভিন্ন বড় প্রকল্পের সরঞ্জাম আমদানির কথা বলেছেন আহসান মনসুর।

বাংলাদেশ ব্যাংক মঙ্গলবার ব্যালেন্স অব পেমেন্টের হালনাগাদ যে তথ্য প্রকাশ করেছে তাতে দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) পণ্য বাণিজ্যে সামগ্রিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭২২ কোটি ৮০ লাখ (১৭.২৩ বিলিয়ন) ডলার।

এই অংক আগের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় দ্বিগুণ। আর পুরো অর্থবছরের (জুলাই-জুন) ঘাটতির চেয়ে ৮২ শতাংশ বেশি।

গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৯৩৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। আর অর্থবছর শেষ হয়েছিল ৯৪৭ কোটি ২০ লাখ ডলারের ঘাটতি নিয়ে।

>> ২০১৭-১৮ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ৫ হাজার ৫২ কোটি ৪০ লাখ (৫০.৫২ বিলিয়ন) ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। একই সময়ে রপ্তানি থেকে আয় হয়েছে ৩ হাজার ৩২৯ কোটি ৬০ লাখ (৩৩.২৯ বিলিয়ন) ডলার।

>> এ হিসাবে পণ্য বাণিজ্যে সার্বিক ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে এক হাজার ৭২২ কোটি ৮০ লাখ ডলার।

>>  ঘাটতি বেড়েছে সেবা বাণিজ্যেও। জুলাই-মে সময়ে সেবা বাণিজ্যে মোট ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৪০৮ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ে ৩০০ কোটি ডলার ছিল।

[সেবা খাতের বাণিজ্যে মূলত বিমা, ভ্রমণ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকে।]

গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে সামগ্রিক লেনদেনে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৭ কোটি ডলার। তার আগের অর্থবছরের একই সময়ে এই হিসাবে ২৬৮ কোটি ২০ লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল।

তবে বিদেশি বিনিয়োগ ও বিদেশি সহায়তা ছাড়ের পরিমাণ বাড়ায় অর্থবছরের প্রথম দশ মাসে সরকারের আর্থিক হিসাবে ভালো উদ্বৃত্ত তৈরি হয়েছে।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে যেখানে ৪২১ কোটি ৭০  লাখ ডলার উদ্বৃত্ত ছিল, এবার একই সময়ে সেই উদ্বৃত্ত ৮০৩ কোটি ৫০ লাখ ডলারে দাঁড়িয়েছে।

গত অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে ২৬০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (এফডিআই) বাংলাদেশে এসেছে। আগের অর্থবছরের একই সময়ে এসেছিল ২৮১ কোটি ৪০ লাখ ডলার।এ হিসাবে এই দশ মাসে এফডিআই কমেছে ৭ দশমিক ৩৬ শতাংশ।

এই সময়ে মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বাবদ দেশে এসেছে ৪৩৮ কোটি ২০ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় সাড়ে ৮২ দশমিক ৬৬ শতাংশ বেশি।

লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি ৯.৩৮ বিলিয়ন ডলার

আমদানি বাড়ায় বৈদেশিক লেনদেনের চলতি হিসাব ভারসাম্যেও বড় ধরনের ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ।

২০১৭-১৮ অর্থবছরের ১১ মাসে এই ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৯৩৭ কোটি ৯০ লাখ (৯.৩৮ বিলিয়ন) ডলারে।এই ঘাটতি আগের অর্থবছরের একই সময়ের প্রায় সাড়ে চার গুণ বেশি।

২০১৬-১৭ অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে লেনদেন ভারসাম্যে ২২১ কোটি ৬০ লাখ ডলার ঘাটতি ছিল। জুনে অর্থবছর শেষে তা ১৪৮ কোটি ডলারে দাঁড়ায়।

সাধারণভাবে কোনো দেশের নিয়মিত বৈদেশিক লেনদেন পরিস্থিতি বোঝা যায় চলতি হিসাবের মাধ্যমে। আমদানি-রপ্তানিসহ অন্যান্য নিয়মিত আয়-ব্যয় এতে অন্তর্ভুক্ত হয়। এখানে উদ্বৃত্ত হলে চলতি লেনদেনের জন্য দেশকে কোনো ঋণ করতে হয় না। আর ঘাটতি থাকলে তা পূরণ করতে ঋণ নিতে হয়।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, গত অর্থবছরজুড়েই আমদানি বাড়ছিল। শেষ দিকে এসে আরও বেড়েছে।

“আমি হিসাব করে দেখেছি, সব মিলিয়ে এবার আমদানি ব্যয় ৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো হবে। আর বাণিজ্য ঘাটতি ২০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক ছুঁতে পারে।”

কেন আমদানি বাড়ছে- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “আমদানির যে উল্লম্ফন যেটা মূলত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পসহ বড় বড় কয়েকটি প্রকল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম আমদানির কারণে।”

এছাড়া চাল, জ্বালানি তেল, ক্যাপিটাল মেশিনারি এবং শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়ার কারণেও আমদানি ব্যয় বাড়ছে বলে মনে করেন তিনি।

আমদানি বাড়ায় অর্থনীতিতে কী ধরনের প্রভাব পড়বে- এ প্রশ্নের জবাবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক কর্মকর্তা আহসান মনসুর বলেন, “স্বাভাবিকভাবে আমদানি বাড়াকে অর্থনীতিতে ইতিবাচক হিসেবেই দেখা হয়ে থাকে। ক্যাপিটাল মেশিনারি, শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বাড়া মানে বিনিয়োগ বাড়া।

“কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অনেক সময়ই আমরা শুনি যে, এক পণ্য আমদানির নামে অন্য পণ্য আমদানি হচ্ছে। অনেক সময় শূন্য কন্টেইনারও আসছে…। আবার ওভার ইনভয়েসের (আমদানি করা পণ্যের বেশি মূল্য দেখিয়ে) মাধ্যমে অর্থ পাচার করছেন অনেকে।

“সে কারণেই এই আমদানি বাড়াকে আমি শুধু ইতিবাচক দিক হিসেবে দেখছি না, উদ্বিগ্নও খানিকটা।”