বিনিয়োগের ওয়ান স্টপ সার্ভিস ‘হোক দক্ষ ও জবাবদিহিমূলক’

দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ সহজ করতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইনের জন্য সরকারের প্রশংসা ঝরলেও ওই সেবা দক্ষ লোকের মাধ্যমে দেওয়ার এবং জবাবদিহিমূলক করার পরামর্শ এসেছে একটি আলোচনা অনুষ্ঠান থেকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 March 2018, 03:38 PM
Updated : 23 March 2018, 01:00 PM

বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট ক্লাইমেট ফান্ডের (বিআইসিএফ) টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি কমিটির ওই সভায় বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার স্বার্থে অবকাঠামোর উন্নয়ন, করপোরেট কর কমানো এবং কানেকটিভিটির উপরও জোর দেন ব্যবসায়ী নেতারা।

‘স্ট্র্যাটেজিক রোডম্যাপ অ্যান্ড করপোরেট প্ল্যান’ চূড়ান্ত করা হয়েছে বলে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক গ্রুপ ও ইউকেএইডের আয়োজনে ওই সভায় জানান বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী এম আমিনুল ইসলাম।

বুধবার গুলশানে আমারি ঢাকা হোটেলের ওই সভার আলোচনায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী ২০১৮ সালের ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন বাস্তবায়নে দক্ষ লোক নিয়োগ এবং সেখানে জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পরামর্শ দেন।

তিনি বলেন, “ভালো কাজ যেটা হয়েছে যে নতুন একটি আইন পাস হয়েছে।... এর ফলে বিডা এবং অন্যান্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, বেপজা ও বেজা- এরা এক ছাতার নিচে, এক ছাদের নিচে ২৭টি সেবা দিতে পারবে।

“যদিও এটা নিয়ে কিছুটা নেতিবাচক কথাবার্তা উঠেছে, একজন সাংসদ বলেছেন যে, একটি জায়গায় আমাদের ঘুষ দিতে হবে কি না, ২৭টি জায়গার পরিবর্তে, ওয়ান স্টপ ঘুষ কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। সেটিও আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি।”

মানুষের আস্থা ও নির্ভরতার জায়গা তৈরিতে জোর দিয়ে তৌফিক ইমরোজ খালিদী বলেন, “এবং যে লোকগুলো এখানে কাজ করবে, তারা যেন দক্ষ হয়, সেখানে যেন দীর্ঘসূত্রতা না থাকে। সেখানে যাদের এখানে নিয়োগ দেওয়া হবে, তাদের সবাই যেন সিভিল সার্ভিসের লোক না হয়। প্রয়োজন হলে বেসরকারি খাত থেকে লোকজন আনতে হবে।”

প্রয়োজনে বেশি বেতন দিয়ে বেসরকারি খাতের লোক সেখানে নিয়ে আসার পরামর্শ দেন তিনি।

“বেসরকারি খাতে যারা পেশাদার আছেন, যারা ব্যবসা পরিচালনায় অভিজ্ঞ, যারা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশ সম্পর্কে জানেন, তাদের সমস্যাগুলো সম্পর্কে জানেন, তাদের প্রয়োজনগুলো সম্পর্কে জানেন, তাদেরকে প্রয়োজনে এখানে নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে খুব একটা ভালো কাজ হবে না।”

কাজী এম আমিনুল ইসলাম

তৌফিক ইমরোজ খালিদী

গত ২০-২৫ বছর ধরে বাংলাদেশে ওয়ান স্টপ সার্ভিসের কথা শোনো গেলেও শেষ পর্যন্ত কাজে না আসার প্রসঙ্গে টেনে তিনি বলেন, “কাজের কাজ হতে হলে এখানে দক্ষ লোকজনদের দিয়ে, সৎ লোকজনদের দিয়ে এ কাজটি চালাতে হবে। সেখানে জবাবদিহিতার ব্যবস্থা করতে হবে। জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকলে সমস্যা থেকেই যাবে, দুর্নীতি হবে, দীর্ঘসূত্রতা থাকবে।”

বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ব্যবসায় নিবন্ধন, কর পরিশোধ, অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ-পানি সংযোগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে অভিযোগ শুনতে হয় বলে জানান বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আমিনুল ইসলাম।

তিনি বলেন, “সেগুলো বিশ্লেষণ করেই আমরা প্রাথমিকভাবে যে কার্যক্রমটা হাতে নিয়েছি অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে, অল্প সময়ে, অতি কম খরচে আমরা বিনিয়োগ সেবাগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দেব। সেজন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওয়ান স্টপ সার্ভিস অ্যাক্ট হয়েছে।”

বাংলাদেশে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে বড় ধরনের সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান।

‘স্ট্র্যাটেজিক রোডম্যাপ অ্যান্ড করপোরেট প্ল্যান’ চূড়ান্ত করার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, দেশের সমন্বিত উন্নয়নের বিষয় মাথায় রেখে বিনিয়োগ বাড়াতে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।

পরিকল্পনার নানা দিক তুলে ধরে তিনি বলেন, “এতদিন ঢাকা এবং চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ইনভেস্টমেন্ট প্রমোশনের কার্যক্রম দেখেছেন, সেটাকে আমরা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল পর্যন্ত নিয়ে যেতে চাই।

“তৃতীয়ত ইনভেস্টমেন্টের কাজগুলো এতদিন পর্যন্ত কতিপয় সরকারি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল, এই কাজটার সঙ্গে প্রাইভেট সেক্টরকে ব্যাপকভাবে, ওতপ্রোতভাবে জড়িত করা হচ্ছে।”

 

দেশি-বিদেশি উভয় বিনিয়োগের জন্য রেগুলেটরি স্ট্রাকচার ও রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্কে স্বচ্ছতা আনার পরামর্শ দেন মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এমসিসিআই) সভাপতি নিহাদ কবির।

তিনি বলেন, “সবার ক্ষেত্রেই রুলস অ্যান্ড রেগুলেশন সমানভাবে প্রয়োগ করতে হবে এবং যে কোনো সিদ্ধান্ত দ্রুত ও সঠিকভাবে দিয়ে দিতে হবে। এই সিদ্ধান্ত যে কোনো একটা বিষয়ে নেওয়ার জন্য মাসের পর মাস অপেক্ষা করে থাকতে হয়, এটা করলে বিনিয়োগকে কোনোভাবে আকৃষ্ট করা সম্ভব না।”

 ফরেন অ্যাকচেঞ্জ রেগুলেশনস ও করারোপের আইন ও পদ্ধতি যুগোপযোগী করার আহ্বান জানান নিহাদ কবির।

“ট্যাক্স রেটগুলোকে আমাদের আশেপাশের দেশের সঙ্গে মিলিয়ে কমিয়ে আনতে হবে। ট্যাক্স আহরণের জন্য শুধু যারা এলটিইউ’র প্রতিষ্ঠান, তাদেরকে টার্গেট করলে হবে না।”

বিদেশি বিনিয়োগে বাধার জন্য ১৯৪৭ সালের পুরনো ফরেন এক্সচেঞ্জ রেগুলেশনকে দায়ী করে তিনি বলেন, “এই আইনটি সম্পূর্ণরূপে কোনোদিন সংশোধন করা হয়নি। এর গাইড লাইন প্রয়োজন অনুযায়ী সময়ে সময়ে পরিবর্তন করা হয়েছে।

“ফরেন এক্সচেঞ্জ গাইডলাইনসে একটা নিয়ম আছে, আমি সেই অনুযায়ী কাগজপত্র জমা দিলাম, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরো ১০টা কাগজ চেয়ে পাঠাল। এগুলো কিন্তু বিনিয়োগের ক্ষেত্রে খুবই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।”

যে নিয়ম নীতি আছে, সেগুলোর যেন যথাযথ প্রয়োগ হয়, তার উপর জোর দেন নিহাদ কবির।

মাশরুর রিয়াজ

১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল যেন বিচ্ছিন্ন অবস্থায় চলে না যায় সেজন্য পদক্ষেপ নেওয়ার উপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, “এগুলো আইসোলেটেড অবস্থায় থাকবে না, তার আশেপাশের যেই অবকাঠামোগুলো সেখানে আসা-যাওয়ার রাস্তা, রেললাইন, পানি-বিদ্যুৎ সংযোগ, এগুলো সব নিশ্চিত করতে হবে।”

গ্যাস-বিদ্যুতে মনোযোগ দিয়ে কাজ করা হলেও সড়কের উন্নতি না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

“গাজীপুর থেকে ঢাকায় আসতে যদি ৫ ঘণ্টা সময় লাগে, তাহলে তো কারও পক্ষে বিনিয়োগ করতে আসা সম্ভব না।”

ঢাকা শহরকে কেন্দ্র করে চার দিকে ৫০ কিলোমিটার এলাকায় কমিউটার রেল চালুর পরামর্শ দেন তিনি।

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের (ডিসিসিআই) সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, “একটা দেশে জিডিপির ৫-৬ শতাংশ বিনিয়োগ দরকার অবকাঠামোতে, সেখানে আমরা করছি মাত্র ৩ শতাংশ।

“পার্শ্ববর্তী ভিয়েতনামে যদি দেখেন তারা গত ১০ বছর ধরে ১০ থেকে ১১ বিনিয়োগ করেছে অবকাঠামো। আজকে ভিয়েতনামে প্রায় ১৮ বিলিয়ন ডলার বিদেশি বিনিয়োগ আসছে, সেখানে আমরা আমাদের এফডিআই শুধু ২ বিলিয়ন ডলার। আমাদের এখানে শেখার আছে, ওরা কেন এত বিনিয়োগ পাচ্ছে।”

মাহফুজুল হক শাহ

রূপালী চৌধুরী

বিনিয়োগ অবকাঠামোর ক্ষেত্রে নব্বই দশকের অবস্থায় বাংলাদেশ পড়ে আছে বলে মন্তব্য করেন আবুল কাশেম।

করারোপের বিষয়ে তিনি বলেন, “করপোরেট ট্যাক্স, ট্যাক্স রিডাকশন, আমাদের ধারণা খুবই দরকার। ট্যাক্স টু জিডিপিতে বাংলাদেশ ওয়ান অব লোয়েস্ট, এখানে আমাদের অনেক কাজ করার আছে। আমাদের ট্যাক্স নেট বাড়াতে হবে, ট্যাক্স হার কমাতে হবে, বিশেষ করে করপোরেট ট্যাক্স।”

দেশীয় গ্যাসের মজুদ বাড়াতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।

বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রূপালী চৌধুরী বলেন, “এখন বিদ্যুৎ আমাদের যথেষ্ট আছে। কানেকশন দিতে এত দেরি হচ্ছে কেন? সেটা তো ইমেডিয়েটলি করা যায়। সে রকম অনেকগুলো ব্যাপার আছে, তাতে আমাদের রেগুলিটরি প্রসেস বাস্তবায়ন করলেই হয়ে যায়।”

বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট করার স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের দিকে মনোযোগ বাড়ানোর পরামর্শ আসে চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের পোর্ট অ্যান্ড শিপিং স্ট্যান্ডিং কমিটির আহ্বায়ক মাহফুজুল হক শাহ’র বক্তব্যে।

তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর একটি প্রাকৃতিক বন্দর। এই বন্দরকে যদি সময়মতো উন্নত করা যেত, সময়মতো বর্ধিত করার প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেত, তাহলে আমাদের বিনিয়োগ পরিবেশের জন্য সহায়ক বার্তা আমরা পেতাম।“

গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধি প্রতি বছর ১৫ থেকে ১৬ শতাংশ হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এখান যে পরিমাণে কার্গো আসা-যাওয়া করছে, সেখানে চট্গ্রাম বন্দরে ৪০টি জেটি দরকার। কিন্তু আছে মাত্র ১৯টা। তার মানে টার্মিনাল কম আছে এবং ইকুইমেন্টের স্বল্পতা আছে।”

বন্দরকে কার্যকর করতে বন্দর কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা আরও বাড়ানোর পক্ষে মত দেন তিনি।

“যখন বিনিয়োগকারীরা এসে শোনে, চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ দিন ১৫ দিন ২৫ দিন পর্যন্ত জাহাজ এসে ওয়েট করতে হয়, তাহলে তো সে কোনদিন আগ্রহী হবে না।”

তিনি বলেন, “অবকাঠামোর কথা যেটা আসছে, আমাদের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অনেক আগেই চার লেইন হওয়ার কথা ছিল। আমাদের রেলওয়ে সিস্টেম যেটা আছে, সেটাকেও পরিবর্তন করা যায়। আমাদের চট্টগ্রামে যে কার্গোগুলো আসে তার মধ্যে মাত্র ৩-৫ শতাংশ রেলের মাধ্যমে পরিবহন হয়ে থাকে, কিন্তু এটাকে ৩০ শতাংশে নিয়ে যেতে পারি, যদি ট্রেন বাড়াতে পারি।”

ঢাকায় বিশ্ব ব্যাংক গ্রুপের জ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদ মাশরুর রিয়াজ বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস আইন সংসদে পাস হয়েছে। এবং ওয়ান স্টপ শপ সার্ভিসের জন্য পাঁচটি কোম্পানি আইডেন্টিফাইড হয়েছে।

 

তিনি বলেন, “রেগুলেটরি গভার্ন্যান্সকে নিয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের একটি নতুন উদ্যোগ এসেছে- লেজিসলেটিভ ইমপ্যাক্ট এসেসমেন্ট। যেটা পৃথিবীর অনেক উন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশে ব্যাবহৃত হয়। তাকে বাংলাদেশে প্রচলন করার কাজ শুরু হয়েছে।”

রপ্তানি বহুমুখীকরণ নিয়ে সভায় আলোচনা হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “রপ্তানি বহুমুখীকরণ নিয়ে বিআইসিএফ সরকারকে দুইভাবে সহায়তা করছে। এর একটি হলো তৈরি পোশাক শিল্পের বাইরে আরও দুটি বা তিনটি সেক্টরকে কীভাবে আরো শক্তিশালী করা যায়। সেই সহায়তাটা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে দেওয়া হচ্ছে।”

অন্যদের মধ্যে ডিএফআইডির বেসরকারি খাতের উন্নয়ন বিষয়ক উপদেষ্টা কিথ টমসন, পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহীম, ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অফ কমার্স বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান ও আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরিফ খান আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন।