অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে নিলেও ভবন উঁচু হল না  

১২ তলা ভিতের উপর ১০ তলা ভবন হওয়ার কথা ছিল চট্টগ্রামের প্রধান বিচারিক হাকিম আদালতের জন্য, অথচ হয়েছে সাত তলা ভিতের উপর ছয় তলা ভবন।

জাফর আহমেদ নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2017, 02:55 AM
Updated : 17 March 2017, 03:19 AM

প্রথমে ছয় তলা ভবন নির্মাণের প্রকল্পই নিয়েছিল একনেক, কিন্তু প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ভবনটি ১০ তলা করতে প্রকল্পে সংশোধন আনা হয়।

প্রকল্প সংশোধনের পর বরাদ্দও ২০০ শতাংশ বাড়িয়ে নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু ভবন উঁচু হয়নি।

ভবন প্রায় উঠে যাওয়ার পর গত ডিসেম্বরে গিয়ে এই অনিয়ম ধরা পড়ে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের পরিদর্শনে।

গত ডিসেম্বর ভবনটি পরিদর্শনের পর মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) যে প্রতিবেদন দিয়েছে, তাতে এই প্রকল্পের অর্থের ব্যাপক নয়-ছয়ের ইঙ্গিত করা হয়েছে।

একনেকে অনুমোদিত এই প্রকল্পের নকশা অনুসরণ না করে নিজের মতো করে তৈরি এবং প্রকৃত তথ্য না জানিয়ে প্রকল্প ব্যয় বাড়িয়ে নেওয়ায় জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশও করা হয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে গৃহীত এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

চট্টগ্রামের মতো আরও ছয়টি বিভাগেও একই ধরনের ভবন হচ্ছে একই প্রকল্পের আওতায়, যেখানেও একই ধরনের অনিয়ম হচ্ছে বলে আইএমইডি মনে করছে।

একনেক এই প্রকল্পটি নিয়েছিল বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ‘চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্ট’ ভবন তৈরির উদ্দেশ্যে। ২০০৯ সালে অনুমোদিত এই প্রকল্পের কাজ ২০১৪ সালে শেষ করার কথা ছিল।

সাত তলা ভিতের উপর ছয় তলা ভবন নির্মাণে প্রথম দফায় ৭৩১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। ৬৪ জেলার মধ্যে ২৭ জেলায় ভবন নির্মাণ এবং বাকি ৩৭টি জেলায় জমি অধিগ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়,গণপূর্ত মন্ত্রণালয় প্রয়োজনীয় জমি না পাওয়া এবং স্থানীয় বিচার প্রশাসনের চাহিদার সমন্বয় ঘটিয়ে সীমিত জমিতে অধিকতর স্থান সঙ্কুলানের জন্য ১২ তলা ভিতের উপর ১০ তলা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দিয় একনেকে।

সেই প্রস্তাবের ভিত্তিতে ২০১১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারির একনেক সভায় ২৭টির পরিবর্তে ৩৪টি ভবন নির্মাণ এবং ৩০টির জন্য জমি অধিগ্রহণের প্রকল্পটি প্রথমবারের মতো সংশোধন করা হয়। তখন প্রকল্পটির ব্যয় বাড়িয়ে ৮৭০ কোটি ৩০ লাখ টাকায় উন্নীত করা হয়।

এরপর ২০১৬ সালের ২৪ মে অনুষ্ঠিত একনেক সভায় প্রকল্পটির ব্যয় আরেক দফা বাড়িয়ে ২ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকায় উন্নীত করা হয়। তখন ৪২টি ভবন তৈরি এবং ২২ জেলার জন্য ভূমি অধিগ্রহণের নির্দেশনা দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু চট্টগ্রামের ভবন নির্মাণের সিভিল, ইন্টারনাল স্যানিটারি ও ওয়াটার সাপ্লাই এবং বৈদ্যুতিক কাজেই অতিরিক্ত ব্যয় বাড়ানো হয়েছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা। ছয় বিভাগীয় শহরেও একই আদলেই ভবন তৈরি হচ্ছে।

আইএমইডির মূল্যায়নকারীদের একজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “১২ তলার ফাউন্ডেশনে ১০ তলা ভবন তৈরির জন্য সাত তলার ফাউন্ডেশনে ৬ তলার ভবন তৈরির চেয়ে প্রায় ৪০ কোটি টাকা বেশি লাগে।

“ছয় বিভাগীয় শহরে ভবনের জন্য ২৪০ কোটি টাকা অতিরিক্ত ব্যয় হচ্ছে। মূলত এই বিপুল পরিমাণ অর্থ নয়-ছয় দেখিয়ে আত্মসাতের উদ্দেশ্যেই এমনটি করা হয়ে থাকতে পারে।”

এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক গণপূর্ত অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবন তৈরিতে কিছু জটিলতা দেখা দিলে গণপূর্তমন্ত্রীকে প্রধান করে একটি স্টিয়ারিং কমিটি করে সাত তলা ভিত্তির ওপর ছয় তলা ভবন তৈরির সিদ্ধান্ত হয়।”

একনেক সভায় প্রকল্প সংশোধনের পর কেন ছয় তলা ভবন হল- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি ওই সময়ে পরিচালক ছিলাম না। তাই এই বিষয়ে এর চেয়ে বেশি আমি বলতে পারব না।”

প্রতিবেদনে বলা হয়, “পরিদর্শনে গেলে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ তাদেরকে জানায় যে প্রকল্পের প্রথম সংশোধনের আগে এ ভবন নির্মাণ করার কারণে এটি সাত তলা ভিতের উপর ছয় তলা করে নির্মাণ করা হয়েছে।”

এটাকে ‘মিথ্যা ও অসত্য তথ্য’ বলছে আইএমইডি; প্রতিবেদনে একনেক সভার প্রকল্প সংশোধনীর ২ বছর পরে এ ভবন নির্মাণকাজ শুরু তথ্য-প্রমাণসহ তুলে ধরা হয়েছে।

আইএমইডি প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১১ সালের ফেব্রুয়ারির একনেক সভায় প্রকল্পটি সংশোধন করে ব্যয় বাড়িয়ে ১২ তলা ভিতের উপর ১০ তলা ভবন তৈরির নির্দেশনা দেওয়া হয়। আর চট্টগ্রাম জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভবনটির জন্য ২০১৩ সালের ১৪ এপ্রিল তারিখে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দৈনিক আজাদী ও দৈনিক সমকাল পত্রিকায় ২০১২ সালের ১৭ অক্টোবর আর ওই বছরের ২০ অক্টোবর ডেইলি স্টার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে দরপত্র আহ্বান করেছিল গণপূর্ত অধিদপ্তর। ওই বিজ্ঞাপনেও ৬ তলার ভবন নির্মাণের কথা বলা হয়েছিল।

এরপর দরপত্র মূল্যায়ন কমিটি সর্বনিম্ন দরদাতা প্রতিষ্ঠান জামাল এন্ড কোং এন্ড দি ডেল্টা ইঞ্জিনিয়ার্স কনসোর্টিয়ামকে ২১ কোটি ১৫ লাখ টাকার দরপ্রস্তাব অনুমোদনের জন্য সুপারিশ করে। এরপর ২০১৩ সালের ১৪ মার্চ ওই কোম্পানির সঙ্গে চুক্তি করা হয়। 

‘উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে’ প্রকৃত তথ্য গোপনের অভিযোগ তুলে প্রতিবেদনে বলা হয়, “প্রকল্পটি অনুমোদনকারী কর্তৃক নির্দেশিত অনুশাসন না মেনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এধরনের অনিয়মের দায়ভার কোনোভাবেই বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ এড়াতে পারে না।”

এক সপ্তাহ আগে সরেজমিনে দেখা যায়, চট্টগ্রামের ওই আদালত ভবনের পাঁচতলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে, ছয় তলার কাজ শুরু করেছে।

এই অসম্পূর্ণ ভবনটিই গত ১৯ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা উদ্বোধন করেন।

স্থান সঙ্কুলানের যে উদ্দেশ্য থেকে প্রকল্পটি নেওয়া হয়েছিল, তাও পূরণ হচ্ছে না বলে চট্টগ্রামের আইনজীবীদের অভিমত।

চট্টগ্রামের মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের এজলাস রুমে উকিল, মক্কেলসহ দর্শনার্থীদের জন্য ৪ সিটের আট সারি বেঞ্চ বসানো আছে। কিন্তু নবনির্মিত ভবনে একই আকারের মাত্র চার সারি বেঞ্চ বসানো সম্ভব হয়েছে।

চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি কফিল উদ্দিন চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ ভবনটি তৈরির প্রথম দিকেই আমরা বলেছিলাম, এটি যেন আগামী ২০৫০ সাল পর্যন্ত ব্যবহার উপযোগী হয়। কিন্তু তা এখনই ব্যবহারের অনুপযোগী।

“ভবনটির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেও আমি এই কথা বলেছি। কিন্তু প্রকল্পটি এই অনিয়ম নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।”