রিজার্ভ চুরির পর ব্যাপক চাপের মুখে সরে যেতে হল গভর্নর আতিউর রহমানকে।
Published : 15 Mar 2016, 05:12 PM
মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রীর কাছে পদত্যাগপত্র দেওয়ার আগে-পরে দুই দফায় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন তিনি। এসময় নিজের অবস্থান যেমন ব্যাখ্যা করেছেন তিনি, তেমনি গত সাত বছর দায়িত্ব পালনের সময় বাংলাদেশ ব্যাংকের অর্জনও তুলে ধরেছেন।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যাওয়ার আগে পদত্যাগপত্র হাতে নিয়ে গুলশানের বাড়িতে কয়েকজন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন আতিউর। তার ওই কথোপকথনের পুরোটা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব ছাড়ার পর মঙ্গলবার বিকালে গুলশানে নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলনে আতিউর রহমান। ছবি: নয়ন কুমার
সম্প্রতি একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এটা অনেকটা জঙ্গি আক্রমণের মতো, অনেকটা ভূমিকম্পের মতো। কোন দিক থেকে এসেছে, কে করেছে আমি কিছুই বুঝে উঠতে পারিনি। আমাকে যখন বলা হল, আমি এতোটাই পাজলড ছিলাম…. কয়েকদিন আগে এটিএম আক্রমণ হয়েছে, এখন আবার রিজার্ভের উপর আক্রমণ। আমাদের সমস্ত অর্থনীতিকে যেন ভেঙে না ফেলে সেই ভয়ে আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিশেষজ্ঞদের মতামত নিয়েছি, তাদেরকে বিদেশ থেকে এনেছি। তাদের এনে আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের পুরো সিকিউরিটি নিশ্চিত করেছি, যাতে ভবিষ্যতে আর ক্ষতি না হয়। পাশাপাশি কোথা থেকে কেমন করে এই ঘটনার উৎপত্তি ঘটল খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছি।
এক্ষেত্রে আমি দেশের ইন্টেলিজেন্স ইউনিটগুলোকে সঙ্গে নিয়েছি। প্রথম দিনই আমি এফআইইউয়ে (ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট) এফআইআর করেছি এবং তাদের পরামর্শমতো কাজ শুরু করেছি। বিশেষজ্ঞ মতামত নিয়েছি। ফিলিপিন্সের গভর্নরের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করেছি। যেহেতু ইন্টেলিজেন্সের বিষয়- এগুলো গোপনীয়তার সাথে করতে হয়। আমি সব সময় স্বদেশের স্বার্থে কাজ করেছি, ২৮ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আমার সন্তানের মতো- তিলে তিলে এটা গড়ে তুলেছি। যখন দায়িত্ব নিয়েছিলাম, তখন রিজার্ভ ছিল ৬-৭ বিলিয়ন ডলারের মতো, সাড়ে চার গুণ আমি বাড়িয়েছি। সুতরাং এখান থেকে একটি ডলারও নষ্ট হোক আমি চাইনি। ডলার কীভাবে ফেরত আনা যায় এই কাজটিই করেছি।
আল্লাহর মেহেরবানি, আমরা একটা অংশ ফেরত পেয়েছি এবং আজকে ফিলিপিন্স থেকে খবর এসেছে যে আমরা পুরোটাই পাব।
আমি আমার সাধ্যমত চেষ্টা করেছি। এই কারণে মনে হচ্ছে যে ভূমিকম্প যেমন বারে বারে আসে, যে কোনো মুহূর্তে আসতে পারে, এটার দেওয়াল দেবার চেষ্টা আমি করেছি। যখন পরিস্থিতি খানিকটা আমার নিয়ন্ত্রণে এসেছে তখন আমি এনএসআইকে যুক্ত করেছি, র্যাবকে যুক্ত করেছি, ফায়ারআইকে তো আগেই যুক্ত করেছি। গোটা ব্যাপারটা কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এনে আমি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছি, পরে চিঠি লিখে মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে জানিয়েছি।
একটু সময় লেগেছে আমি অস্বীকার করি না। কিন্তু এই সময়টা আমি নিয়েছি দেশের স্বার্থে। এই অর্থগুলো যেন নিশ্চিতভাবে দেশে ফেরত আনা যায় তার স্বার্থে এবং বড় রকম আর কোনো সংকট আছে কি না তা দূর করার স্বার্থে। এখানে আমার ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নাই। এটা একটা সাইবার অ্যাটাক। কোথা থেকে এটা এসেছে তা আজও আমরা বুঝে উঠতে পারছি না। আমি র্যাবকে বলেছি, ভেতরে কেউ যদি এতে জড়িত থাকে, যে কোনো সময় তাদের তুলে ধরে নিয়ে যেতে পার। আমার দিক থেকে কোনো অসুবিধা থাকবে না। ভবিষ্যতে যাতে করে এ রকম না ঘটে সেজন্য এ লাইনে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ যারা তাদের যুক্ত করেছি ফায়ারওয়াল দিচ্ছি। শুধু তাই না, ব্যাংকগুলোকেও বলেছি যে, তোমরা ফায়ারওয়াল সৃষ্টি কর।
আর একটি প্রশ্ন উঠেছে যে, আমি বিদেশে কেন গিয়েছি এই সময়। আমি বলতে পারি ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় ও আইএমএফ এর যৌথ নেতৃত্বে একটি সভা ছিল, ওই সভায় মাননীয় অর্থমন্ত্রীরও যাওয়ার কথা ছিল এবং শেষ মুহূর্তে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে যেতে পারেননি। আমি যথাযথ অনুমতি নিয়ে, মাননীয় অর্থমন্ত্রী ও প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে সেখানে গিয়েছি। ওই সভায় আইএমএফ এর প্রধানসহ বিভিন্ন দেশের গভর্নররা এসেছিলেন। সেখানে দুটি প্যানেলে আয়োজকরা আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার সুযোগ দিয়েছেন। সেখানে কীভাবে অর্থ উদ্ধার করা যায়, সিকিউর করা যায় এই বিষয়গুলো তাদের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি।
সুতরাং আমি যা কিছু করেছি সব দেশের স্বার্থে। আপনারা সকলেই জানেন যে, আমি বাংলাদেশের স্বার্থের বাইরে গিয়ে কোনো কাজ করতে পারি না। দেশটা আমার মা এর মতো। এই মা-এর জন্য আমি আমার সংসারের দিকে তাকাইনি সাতটি বছর। আমি কখনো কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের কাজ করেছি। আমি চেষ্টা করেছি দুষ্টের দমন করবার জন্য এবং সেজন্য কেউ না কেউ হয়তো ক্ষুব্ধ হতে পারেন কিন্তু তাতে আমি মনে করি স্বদেশের জন্য এই ‘স্যাক্রিফাইস’ করতে আমার কোনো সমস্যা নেই। আমি আপনাদের নিশ্চিত করতে পারি যে, বাংলাদেশের ভালো ছাড়া মন্দ কখনো আমার মনে আসে না।
আমি বঙ্গবন্ধুর নীতিতে বিশ্বাস করি। তাকে শ্রদ্ধা করি। তার নির্দেশিত পথে অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কাজ করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাতটি বছর সর্বক্ষণ গাইড করেছেন, প্রটেক্ট করেছেন, প্রতিটি সংকটে তিনি আমার পাশে ছিলেন।
আপনাদের মাধ্যমে আমি দেশবাসীর উদ্দেশে বলতে চাই, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অর্থনীতির রোল মডেল হিসেবে বাংলাদেশ হাজির হয়েছে- এটা যেন অক্ষয় থাকে, এটা যেন সব সময় আমরা ধরে রাখতে পারি এবং এর জন্য যেখানেই থাকি না কেন আমি দেশের পক্ষেই কাজ করব। আমি সব সময় মানুষের পাশেই থাকব, গরীবের পাশে থাকব, কৃষকের পাশে থাকব। আমি আমার সন্তানদের রক্ষা করব, আমার…যে ২৮ বিলিয়ন ডলার, সেটা রক্ষা করতেই আমি কিছুটা সময় নিয়েছি। এতে যদি আমি অন্যায় করে থাকি, আমি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চাইছি। তবে আমি আবারও বললাম-বাংলাদেশ ব্যাংক আমার সন্তানের চাইতেও বেশি। আমি আমার সন্তানদের সময় দিইনি, বাংলাদেশ ব্যাংককে সময় দিয়েছি, কর্মীদের স্বার্থ দেখেছি। দেশটাকে উন্নত করার জন্য দিন-রাত পরিশ্রম করেছি। যতবার দেশের বাইরে গিয়েছি, বাংলাদেশের কথা বলেছি। আমি একদিনও ছুটি নিইনি গত সাত বছরে। সুতরাং আপনারা ধৈর্য্ ধরুন এবং লক্ষ করুন যে, আমরা কী করছি। আমি যে কাজগুলো করেছি সেগুলো বাংলাদেশের ভবিষ্যতের বিশেষ করে সাইবার নিরাপত্তাতে অনেকটা স্বার্থ রক্ষা করবে এবং আরও কিছু কাজ করার বাকি আছে সেগুলো করার চেষ্টা করছি। কাজগুলো আমরা করব এবং আমি থাকি বা না থাকি আমার অনুরোধ থাকবে এই সাইবার সিকিউরিটির ব্যবস্থা যেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মতো একটা উদ্যোগ নিয়ে কাজ করা হয়।
এখানে আমি অনুরোধ করব যে- এটি একটি ইন্টেলিজেন্স বিষয়, খোলামেলা এতো আলোচনার সুযোগ এখানে নেই, মানুষকে আত্ঙ্কিত করারও সুযোগ নেই। বরং আসুন যেভাবে আমরা বন্যা মোকাবেলা করেছি, রানা প্লাজা ধস পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলা করে আজকে রপ্তানি খাতকে ‘অ্যাক্টিভ’ পর্যায়ে নিয়ে এসেছি, এই সাইবার অ্যাটাকটাকেও আমরা সেইভাবে মোকাবেলা করি এবং আমাদের দেশটাকে সাইবার আক্রমণ থেকে একেবারে নিরাপদ করি।
ক্যাসপারস্কির রিপোর্ট অনুযায়ী, বাংলাদেশ এ সেক্টরে সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে আছে।
দেশের জন্য যা করতে পেরেছি- এতো মানুষের কাছে আমরা ঋণ পৌঁছে দিতে পেরেছি, অর্থনীতিকে ৯৫ বিলিয়ন থেকে ২১০ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে পেরেছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে, আমি তার জন্য খুবই তৃপ্ত। এই সাত বছরের কর্মজীবন একটি বড় অভিজ্ঞতা হবে আমার জন্য এবং দেশবাসীর জন্য আমি এইটুকুন বলতে পারি যে, আপনারা ধৈর্য ধরবেন এবং বাংলাদেশের অর্থনীতি যে এগিয়ে যাচ্ছে তার জন্য গর্ববোধ করবেন এবং যদি কখনো মনে পড়ে আমাকে স্মরণে করবেন।
ভারত থেকে ফিরে আগের রাতে অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে কথোপকথনের প্রসঙ্গ তুলে আতিউর রহমান বলেন, হয়তো আমার এক্সিটটা আরও ভালো হতে পারত। যদি একটা সংবর্ধনা দিয়ে…..(হাসি) বিদায় করলে গত সাত বছরের কষ্ট খানিকটা লাঘব হত।(মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার) সময়ও তো বেশি বাকি ছিল না। মাত্র তিন চার মাসের মতো ছিল। এর মধ্যে রিজার্ভের নিরাপত্তার কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া যেত। নতুন একজনের তো এই বিষয়গুলো বুঝে উঠতে কিছুটা সময় লাগবে। যাই হোক, এখন আর আমি সেগুলো ভাবছি না। মান-সম্মান নিয়ে বিদায়ই নিতে চাচ্ছি। এই ব্যাখ্যাগুলো দিয়েছি যেন দেশবাসী আমাকে ভুল না বোঝে।
[আতিউর রহমানের বক্তব্যের শ্রুতিলিখন করেছেন সালাহউদ্দিন ওয়াহিদ প্রীতম]