“বাজেটে ঘাটতি আরও কমিয়ে, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন কমিয়ে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রক্ষা করার সুযোগ ছিল।”
Published : 08 Jun 2024, 06:44 PM
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি অর্জনের যে লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সরকার, তা ‘বাস্তবসম্মত নয়’ বলে মনে করে অর্থনীতির গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকনোমিক মডেলিং-সানেম।
তারা মনে করে, বর্তমান অর্থনীতির বিবেচনায় বাজেটের আকার আরেকটু ছোট করা যেত। করমুক্ত আয়সীমা বাড়িয়ে মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া যেত।
প্রস্তাবিত বাজেটে তাদের দৃষ্টিতে আরও বেশ কিছু দুর্বলতা রয়ে গেছে, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়াও উচিত হয়নি বলে মত দিয়েছে সানেম।
বাজেট পরবর্তী এক সংবাদ সম্মেলনে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য ২ বছরের পরিকল্পনা নেওয়ার প্রস্তাব করে তারা সতর্ক করে বলেছে, যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাবে।
শনিবার রাজধানীর মহাখালীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জন্য অর্থমন্ত্রীর প্রস্তাবিত বাজেট সম্পর্কে পর্যবেক্ষণ জানাতে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করে সানেম।
সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, “বাজেটের লক্ষ্যমাত্রাগুলো পুরোপুরি বাস্তবসম্মত নয়। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগগুলো যথেষ্ট নয়।”
মূল্যস্ফীতি টানা দুই বছর ১০ শতাংশ ছুঁই ছুঁই থাকলেও আগামী অর্থবছরে তা সাড়ে ছয় শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যের কথা বলেছেন অর্থমন্ত্রী। তবে কোন কৌশলে সেটি কমানো হবে, সে বিষয়ে দিক নির্দেশনা আছে কি না সেটি স্পষ্ট নয়।
সেলিম রায়হান বলেন, “মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতার প্রয়োজন। একদিকে সুদের হার বাড়াচ্ছি, সেটা বিনিয়োগকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, আবার আমাদের বিনিয়োগও দরকার কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য, প্রবৃদ্ধির জন্য। এ দুটি বিপরীতমুখী সমস্যা সমাধানের জন্য যে সুগভীর চিন্তার ভিত্তির প্রয়োজন ছিল, সেগুলো বাজেটে আমরা দেখিনি।”
মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে প্রশ্ন তোলে সানেমের গবেষণা পরিচালক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, “মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে আরো কিছু পদক্ষেপ নেওয়া যেত।
“আমরা মনে করি সামষ্টিক অর্থনীতির পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে বাজেটের আকার আরেকটু ছোট করা যেত। যেমন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণ নেওয়ার পরিকল্পনা এবারও রয়েছে যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দেয়। বাজেটে ঘাটতি আরও কমিয়ে, অভ্যন্তরীণ অর্থায়ন কমিয়ে সাধারণ মানুষকে মূল্যস্ফীতির চাপ থেকে রক্ষা করার সুযোগ ছিল।”
করের চাপে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত
প্রস্তাবিত বাজেট নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের ওপর করের হার চাপ তৈরি করবে বলেও মত দেন সেলিম রায়হান। তিনি বলেন, “মোবাইলের মত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের ওপর কর বাড়ানোয় নিম্ন আয়ের মানুষের উপর বোঝা বেশি পড়বে। অন্যদিকে, ধনীদের একটা বড় অংশ করের আওতার বাইরে থাকবে।”
২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে দেওয়া সেবার বিপরীতে বিদ্যমান সম্পূরক শুল্ক ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ করার প্রস্তাব করা হয়। সেই সঙ্গে সিমের মূল্য সংযোজন করও বাড়ানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
রাজস্ব আদায়ে প্রত্যক্ষ কর আদায়ে গুরুত্ব দেওয়া দরকার ছিল মত দিয়ে তিনি বলেন, “পরোক্ষ করে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, কারণ, সেটা করা তুলনামূলক সহজ।”
অতি ধনী ও ধনীরা নানাভাবে করের ‘আওতামুক্ত’ রয়েছে বলেও মনে করেন সেলিম রায়হান। বলেন, “রাজনৈতিক অর্থনৈতিক যোগসাজশ ব্যবহার করে প্রভাবশালীরা করের আওতামুক্ত থাকে। কিন্তু আমরা যদি ধনী ও অতিধনীদের করের আওতার মধ্যে আনতে না পারি, যৌক্তিক কর যদি তারা না দেন, তাহলে আমরা কর কাঠামোয় কোনো পরিবর্তন দেখব না।”
অধ্যাপক বিদিশা বলেন, “প্রতি বছরই কর হারের দিকে যতটা নজর দেওয়া হচ্ছে, কর জালের আওতা বৃদ্ধির ব্যাপারে ততটা নজর দেওয়া হচ্ছে না।সে কারণে, বাজেটের ঘাটতি পুষিয়ে নেয়ার জন্য যে অর্থায়ন করা হচ্ছে, যার নেতিবাচক প্রভাব সার্বিকভাবে অর্থনীতির উপর পরছে।“
করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ানোর পদক্ষেপ মধ্যবিত্তকে কিছুটা স্বস্তি দিতে পারত বলেও মত দেন তিনি।
জনপ্রশাসন খাতে বাজেটের ২২ শতাংশ বরাদ্দ যুক্তিযুক্ত কি না, সেই প্রশ্ন রেখে সানেমের গবেষণা পরিচালক বলেন, “বিলাসদ্রব্য, আমদানি দ্রব্য, বিদেশ ভ্রমণ, আপ্যায়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যয় কমিয়ে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের স্বস্তি ও তাদের সুবিধার ক্ষেত্রে বেশি জোর দেওয়া প্রয়োজন ছিল।”
সরকারের ঋণ প্রসঙ্গ
অর্থমন্ত্রী যে বাজেট প্রস্তাব করেছেন, সেখানে ঘাটতি থাকছে আড়াই লাখ কোটি টাকারও কিছুটা বেশি।
বৈদেশিক ঋণ বেড়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে সেলিম রায়হান বলেন, “কিছুদিনের মধ্যেই আমরা এলডিসি উত্তরণ করব। সেক্ষেত্রে বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলোর পাশাপাশি আরও চ্যালেঞ্জ যুক্ত হবে। সেক্ষেত্রে বিনিয়োগ বহুমুখীকরণের ব্যাপারে জোর দিতে হবে।
“সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, ঋণ পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। সে কারণে এটা মাথায় রাখতে হবে যে, প্রকল্পগুলো যেন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারে। আমরা তো টাকায় পরিশোধ করতে পারব না। রপ্তানির বহুমুখীকরণও প্রয়োজন। সেই উদ্যোগ বাজেটে আমরা দেখছি না।”
ঋণ নিয়ে যে মেগা প্রকল্পগুলো করা হয়েছে, সেগুলোর ‘যথাযথ মূল্যায়ন’ করা দরকার বলে মত দেন তিনি।
ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ কেন কমানো যাচ্ছে না, এই প্রশ্ন রেখে সানেম প্রধান বলেন, “কেন ব্যাংকিং খাতে বড় ধরনের সংস্কার করা যাচ্ছে না? যারা ঋণখেলাপি, করখেলাপি- তারা কোনো না কোনোভাবে এক সূত্রে গাঁথা। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে এত ইতস্তত কেন?”
‘দুর্নীতিকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে’
১৫ শতাংশ কর দিয়ে অপ্রদর্শিত আয় টাকা সাদা করার সুযোগেরও বিরোধিতা করেন সানেম প্রধান।
তিনি বলেন, “আমরা যে নৈতিক সমাজের কথা বলি, সেটি কোনোভাবে এ সমাজের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না। এর মাধ্যমে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
“একদিকে আমরা বলছি, আমরা কর আদায় করতে চাই, অন্যদিকে আমরা বলছি, যারা কর ফাঁকি দিয়েছে, তারা কম কর দিয়ে… তারা বিভিন্নভাবে যে কালো টাকা অর্জন করেছে, সেটাকে সাদা করতে পারবে। এটি বাতিল হবে বলে আমি আশা করছি।”
বিনিয়োগের পরিবেশ
বৈদেশিক বিনিয়োগে সেভাবে বাড়ছে না উল্লেখ করে অধ্যাপক বিদিশা বলেন, “সেই জায়গায় কার্যকর পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল, যা প্রস্তাবিত বাজেটে আমরা দেখছি না।”
ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগের জন্য বাজেটে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা কতটা বাস্তবসম্মত, সেই প্রশ্ন রাখেন সানেম প্রধান সেলিম রায়হান।
তিনি বলেন, “আমাদের আর্থিক ও মুদ্রানীতির সমন্বয়ের সমস্যা রয়েছে। বাজারে হঠাৎ করে অযৌক্তিক দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়। এরকম প্রতিযোগিতাবিরোধী কাজের পরেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয় না। বাজেটের উদ্দেশ্য সৎ হলেও কোনো সমন্বয় নেই।
অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে দুই বছরের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা নেওয়ার পরামর্শ দিয়ে সানেম প্রধান বলেন, “যাতে ব্যবসার আস্থা ও প্রাইভেট সেক্টরের বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আস্থা বাড়ে। ব্যাংকে আমরা যারা ডিপোজিট করছি, তারা যেন আস্থা ফিরে পাই।
“দুর্নীতির ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত এবং সংসদীয় কমিটি করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। দুর্নীতির বোঝা বহন করতে হচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের। দুর্নীতির জায়গায় আমরা জিরো টলারেন্স দেখতে চাই।”
‘রেমিটেন্সের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দরকার ছিল’
রেমিটেন্সদাতাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনার পাশাপাশি অনার্থিক প্রণোদনারও প্রয়োজন ছিল বলে মনে করছেন সায়মা হক বিদিশা।
তিনি বলেন, “সামাজিক স্বীকৃতির ব্যবস্থা করা যেতে পারে। যেমন- তাদের জন্য বিমানবন্দরে আলাদা সুবিধার ব্যবস্থা করা, গ্রামে গিয়ে তাদের একটি বিশেষ স্বীকৃতি প্রদানসহ নানারকম অনার্থিক প্রণোদনা দেওয়া সম্ভব।”
ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতনের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “যতক্ষণ পর্যন্ত খোলা বাজারের সঙ্গে ব্যাংক রেটের পার্থক্য থাকবে ততক্ষণ পর্যন্ত হুন্ডির প্রবণতা থাকবে।”