প্রতিশ্রুতির অর্থছাড়: পাইপলাইন পর্যালোচনা, প্রকল্প সংশোধন বন্ধেই পরিত্রাণ

পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেছেন, বিদেশি অর্থায়নের ব্যবহার বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজও হচ্ছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2023, 04:25 PM
Updated : 3 July 2023, 04:25 PM

ডলার সংকটে বছর দেড়েকের বেশি সময় ধরে অর্থনীতিতে চলছে টানাপড়েন; অথচ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ঋণ ও অনুদানে প্রতিশ্রুতির পরিমাণ ৫৪ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে।

অর্থায়নকারী উন্নয়ন সহযোগী এবং বিভিন্ন দেশ ও সংস্থার কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ এ অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা থাকলেও নানা কারণে দীর্ঘদিন থেকেই তা ক্রমেই বাড়ছে। বছরের পর বছর ধরে চলা এ অব্স্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পাইপলাইনের বর্তমান অবস্থা পর্যালোচনা যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন আর সময়োপযোগী নেই সেগুলো বাদ দেওয়ার পরামর্শ এসেছে এক অর্থনীতিবিদের কাছ থেকে।

বিদেশি ঋণ দেখভালকারী সংস্থা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) কর্মকর্তারা প্রকল্পের সংশোধন কমানোর তাগিদ দিয়েছেন।

পাইপলাইনে থাকা এ অর্থ বিদেশি ঋণ সংশ্লিষ্ট উন্নয়ন প্রকল্পে কাজে লাগানোর পরিমাণ বাড়াতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগকে (ইআরডি) পদক্ষেপ নিতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি জানান, বিদেশি অর্থায়নের ব্যবহার বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও রয়েছে। সে অনুযায়ী কাজ হচ্ছে।

এ বিষয়ে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর পাইপলাইনের অর্থ ব্যয় বাড়াতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষ বা মন্ত্রণালয়ের একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠনের পরামর্শ দিয়েছেন। প্রকল্প পরিচালকসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনার তাগিদ দেন তিনি।

প্রকল্পে বিদেশি অর্থায়নের জন্য সরকার প্রতিবছর উন্নয়ন সহযোগী ও দাতা দেশ বা সংস্থার সঙ্গে ঋণ চুক্তি করে। অর্থায়ন নিয়ে আলোচনার বিভিন্ন পর্যায় পেরিয়ে এ নিয়ে চূড়ান্ত চুক্তির পর থেকেই তা প্রতিশ্রুতি হিসেবে গণ্য করা হয়।

প্রতিবছর দাতাদের সঙ্গে হওয়া এসব চুক্তির অর্থ প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু না হলে বা বাস্তবায়নের ধীরগতির কারণে অব্যবহৃত থেকে গেলে অতিরিক্ত অর্থ পাইপলাইনে জমা হয়। এভাবেই স্বাধীনতার পর থেকে এখন পর্যন্ত প্রতিশ্রুতির অর্থ জমে বিপুল আকার ধারণ করেছে।

বছরের পর বছর অর্থ ছাড় না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে পরিকল্পনা কমিশন, ইআরডি ও অর্থনীতিবদের অভিমত, প্রকল্প শুরু হতে দেরি হওয়া, নির্ধারিত মেয়াদের মধ্যে বাস্তবায়ন করতে না পারা এবং অদক্ষতা ও অব্যবস্থাপনাই মূল বাধা।

পাইপলাইনে আটকে থাকা অর্থের পরিমাণ বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় ৫ লাখ ৮৩ হাজার কোটি টাকা (প্রতি ডলার ১০৮ টাকা ধরে)।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে টানা তিন মেয়াদে অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে বিদেশি অর্থায়নের জন্য চুক্তি করায় প্রতিবছর পাইপলাইনের আকার বাড়ছে। বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ায় অর্থছাড়ের পরিমাণও বেড়েছে।

ইআরডির হালনাগাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় চুক্তির অধীনে প্রায় ৩ হাজার ১৭৮ কোটি ডলার এবং বহুপক্ষীয় সংস্থার ঋণের প্রায় ১ হাজার ৮৫৬ কোটি ডলার পাইপলাইনে যুক্ত হয়েছে। এরসঙ্গে শেষ হতে যাওয়া ২০২২-২৩ অর্থবছরের মে পর্যন্ত ১১ মাসে আরও প্রায় চার বিলিয়ন ডলার পাইপলাইনে যুক্ত হয়েছে।

পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান সম্প্রতি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, “প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চলমান বৈদেশিক মুদ্রার সংকট সামাল দিতে পাইপলাইনে থাকা বিদেশি ঋণের অর্থ ব্যবহারের দিকে নজর দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।”

এ নির্দেশনার পর বৈদেশিক অর্থায়নের প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন কীভাবে বাড়ানো যায় সেই উপায় বের ব্যবস্থা নিতে ইআরডিকে বলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

Also Read: এগার মাসে এডিপির ৬২ শতাংশ বাস্তবায়ন

অর্থনীতিবিদ ও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলমান ডলার সংকটের সময়ে প্রকল্পের কাজে গতি বাড়িয়ে পাইপলাইন থাকা বিদেশি মুদ্রা ছাড় করানোর হার বাড়ানো গেলে তা অর্থনীতিকে গতিশীল করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে।

এমন প্রেক্ষাপটে অর্থনীতিবিদ আহসান মনসুর পাইপলাইন পর্যালোচনা করার পরামর্শ দিয়ে বলেন, “এখানে বাস্তবায়নযোগ্য কত প্রকল্প আছে তা বের করতে হবে। এখানে নিশ্চয় অনেক পুরণো প্রকল্প আছে। যেগুলো এখন আর বাস্তবায়নযোগ্য নয়। সেগুলো কেটে ছেঁটে বাদ দিতে হবে।”

তার মতে, প্রয়োজনে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করে প্রকল্প পরিচালকসহ বাস্তবায়ন কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট সবাইকে জবাবদিহীতার মধ্যে আনতে হবে। শুরুর সময়ই পরিচালকদের সময় বেঁধে দিয়ে এত বছরের মধ্যে প্রকল্প শেষ করতে হবে-এমন বাধ্যবাধকতা দিয়ে দিতে হবে।

এ কমিটি চলমান প্রকল্পের অগ্রগতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করবে। প্রকল্প ঠিকমতো বাস্তবায়ন না হলে কারণ চিহ্নিত করে দায়ীদের শাস্তির আওতায় আনতে সুপারিশ করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবকেও জবাবদিহীতার আওনার পরামর্শ দেন তিনি। এ বিষয়ে তার যুক্তি, “গণমাধ্যম থেকে আমরা জানতে পারি প্রকল্পের ঠিকাদার বা প্রকল্প থেকে গাড়ির সুবিধা বা অন্যান্য সুবিধা নিয়ে সংশ্লিষ্টরা ব্যস্ত থাকেন।”

প্রকল্প সংশোধনই বড় বাধা

পাইপলাইনের আকার কমানোর উদ্যোগের বিষয়ে ইআরডির এক কর্মকর্তা বিদেশি ঋণের ছাড় বাড়াতে সর্বোচ্চ একবারের বেশি প্রকল্প সংশোধন বন্ধের কথা বলেন। ২০১৮ সালে ইআরডির নেওয়া উদ্যোগ তুলে ধরে তিনি জানান, সেসসয় অনেকগুলো বৈঠক করে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছিল, যার মধ্যে প্রকল্পের সংশোধনী যথাসম্ভব বন্ধের পরামর্শ ছিল।

এখনও অনেক প্রকল্পে পঞ্চম সংশোধনীও হতে দেখা যায়। জরুরি না হলে একবার সংশোধনের মধ্যে প্রকল্প শেষ করা গেলে অর্থছাড় বাড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

এ বিষয়ে পরিকল্পনামন্ত্রী মান্নান বলেন, “প্রকল্প সংশোধন হবেই। পৃথিবীর কোনও দেশ নেই যেখানে প্রকল্প সংশোধন হয় না। তবে আমরা চেষ্টা করছি প্রকল্পের সংশোধন কম করতে।”