ফেলে আসা দশকগুলোতে পেরিয়ে আসা অর্থনৈতিক সংকটগুলো

যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বড় ব্যাংকের পতন এবং প্রতিপক্ষ ইউবিএসের কাছে ক্রেডিট সুইসের বিক্রির মধ্য দিয়ে দুই প্রতিষ্ঠানের একীভূত হওয়ার পর বৈশ্বিক ব্যাংকিং খাত এখনও ঝুঁকিতে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2023, 07:17 PM
Updated : 26 March 2023, 07:17 PM

যুক্তরাষ্ট্রে দুটি বড় ব্যাংকের পতন এবং ইউরোপে ব্যাংক খাতে নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে খ্যাত সুইজারল্যান্ডের আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্রেডিট সুইসের বিক্রি হয়ে যাওয়ার ধাক্কা এখনও সামলে উঠতে পারেনি বিশ্বের বড় পুঁজিবাজারগুলো।

রয়টার্সের বিশ্লেষণ বলছে, বৈশ্বিক ব্যাংকিং খাত সঙ্কুচিত হয়ে পড়ার কালো মেঘ এখনও কাটেনি এবং বিনিয়োগকারীরা আশঙ্কায় আছেন যে ঋণে সুদের হার বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আরও অনেক ব্যাংকের জন্যই ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে।

এই পটভূমিতে পেরিয়ে আসা গত চার দশকে বিশ্বে অন্যতম বড় আর্থিক সংকটগুলো তুলে ধরেছে রয়টার্স।

যুক্তরাষ্ট্রে সঞ্চয় ও ঋণ সংকট

১৯৮০ এর দশকজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রে এক হাজারের বেশি আমানত ও ঋণ বিতরণকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়, যার ফলাফল হিসেবে এই ক্ষতি মেরামতে সেদেশের করদাতাদের পকেট থেকে ১২ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি বের হয়ে যায়।

মূলত যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রকেরা ওইসব আমানতকারী ও ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য বেঁধে দেওয়া সুদ হারের সীমা তুলে নেওয়াতেই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। সুদ হারে সীমা না থাকায় ওই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অবিক্রিত আবাসন এবং বাণিজ্যিক খাতে টাকা খাটিয়ে বসে, যেখান থেকে তারা আর ওই টাকা তুলতে পারেনি।

জাংক বন্ড ক্র্যাশ

এক দশকজুড়ে দারুণ প্রবৃদ্ধির পর ১৯৮০ এর দশকের শেষের দিকে ‘জাংক বন্ড মার্কেটে’ ধস নামে। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ কয়েক দফায় ঋণে সুদের হার বাড়িয়ে দেওয়ার জেরে এই ধস হয়। ‘জাংক বন্ড’ হচ্ছে পুঁজিবাজারের তালিকাভুক্ত ওইসব বন্ড যেগুলোর ‘ক্রেডিট রেটিং’ বা আস্থার সূচক ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে ঘোষণা করে ক্রেডিট রেটিং সংস্থাগুলো।

মাইকেল মিলকেন নামের এক ব্যক্তি এই জাংক বন্ড মার্কেটে বিনিয়োগকে আকর্ষণীয় করে তুলেছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এই বিনিয়োগের কৌশল টিকতে পারেনি এবং বাজারে ধস নামে। এর জেরে মাইকেল মিলকেনকে কারাগারেও যেতে হয়েছে। তার বিরুদ্ধে বিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। রায়ে ২২ মাসের কারাবাস এবং ২০ কোটি ডলার জরিমানা গুণতে হয় তাকে।

মেক্সিকোর পেসো সংকট

১৯৯৪ সালের ডিসেম্বরে অপ্রত্যাশিত এক ঘোষণায় মেক্সিকোর মুদ্রা পেসোর অবমূল্যায়ন ঘোষণা করে সেদেশের সরকার। আন্তর্জাতিক মুদ্রার মজুদ কমে যাওয়ায় এবং দেশটির চলতি হিসাবে টান পড়ায় এই পদক্ষেপ নেয় তারা। পরিস্থিতি সামাল দিতে শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে ৫ হাজার কোটি ডলার ‘বেইল আউট’ ঋণ নিতে হয় মেক্সিকো সরকারকে।

এশিয়ায় মুদ্রা সংকট

১৯৯০ এর দশকের মাঝামাঝিতে এশিয়ার অর্থনীতিগুলো থেকে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ বের হয়ে যাওয়ার কারণে ওই অঞ্চলের দেশগুলোর মুদ্রার উপর বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। এই চাপ সামলাতে ওই সব দেশের সরকারকে মুদ্রার বাজারে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছিল।

সংকটের শুরু থাইল্যান্ডে, যেখানে দেশের রিজার্ভের ঘাটতি মোকাবেলায় ডলারের বিপরীতে স্থানীয় মুদ্রা থাই বাথের ব্যাপক অবমূল্যায়ন করা হয়। এর ধাক্কা ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবেশী মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন পুঁজিবাজারে।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের মতো বহুজাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এগিয়ে আসতে হয়। শেষ পর্যন্ত ওই অঞ্চলের অর্থনীতিতে ১০ হাজার কোটি ডলারের বেশি ঋণ বিতরণের মাধ্যমে সংকট কাটানো হয়।

হেজ ফান্ডের ধাক্কা

এশিয়ায় মুদ্রা বাজারের সংকটের পরপর রাশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকটের ধাক্কায় যুক্তরাষ্ট্রের হেজ ফান্ড (বিনিয়োগ তহবিল) ১৯৯৮ সালের কয়েক মাসে পুঁজিবাজারে ৪০০ কোটি ডলারের বেশি খুইয়ে বসে। রাশিয়ার বন্ড মার্কেটে ব্যাপক মাত্রায় বিনিয়োগ করেছিল এই হেজ ফান্ড। কিন্তু রাশিয়ার সরকার বন্ডের ঋণ-কিস্তি পরিশোধে খেলাপি হওয়ায় এবং সেদেশের মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়নের জেরে এই লোকসান গুণতে হয় যুক্তরাষ্ট্রের হেজ ফান্ডকে।

আরও ক্ষতি ঠেকাতে নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক বেসরকারি খাতে ৩৫০ কোটি ডলারের একটি ‘বেইলআউট’ প্যাকেজ (ঋণ প্যাকেজ) ঘোষণা করে এবং যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ পরের কয়েক মাসে তিন বার ঋণে সুদের হার কমানোর ঘোষণা দেয়।

২০০৮ সালের মন্দা

গত শতকের ৩০ এর দশকের ‘গ্রেট ডিপ্রেশন’র পর সবচেয়ে বড় আর্থিক সংকট হিসেবে চিহ্নিত এই আর্থিক মন্দা মূলত ঝুঁকিপূর্ণ ঋণ বিতরণ ও দোদুল্যমান ঋণ গ্রহিতাদের কারণে সৃষ্ট। একাধিক কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণে সুদ হার বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়ায় এসব ঋণ গ্রহীতা ও ঋণ বিনিয়োগ পাওয়া খাতগুলো দর হারাতে শুরু করে। ২০০৮ সালে বিশেষ করে আবাসন খাতে বড় ধরনের দরপতনে এই মন্দার শুরু।

এই মন্দার ধাক্কায় ওয়াল স্ট্রিটের এক সময়ের ‘জায়ান্ট’ হিসেবে খ্যাত বেয়ার স্টার্নস ও লেম্যান ব্রাদার্সের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো ধসে পড়ে, যারা বন্ধকী খাতে বড় ধরনের বিনিয়োগ করেছিলো। এই মন্দার ধাক্কায় বিমা খাতের অন্যতম বড় প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল গ্রুপও বসে পড়ে, শেষ পর্যন্ত ১৮ হাজার কোটি ডলারের বেইলআউট প্যাকেজ ঘোষণা করে এই প্রতিষ্ঠানকে রক্ষা করা হয়।

কিন্তু ওয়াশিংটন মিউচুয়াল ব্যাংককে রক্ষা করা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এই ব্যাংক বন্ধ ঘোষণা করে, যা এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ব্যাংকের সবচেয়ে বড় লোকসান হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে।

ইউরোপের ঋণ সংকট

২০০৮ সালের মন্দার ধাক্কা ইউরোপকেও বিপর্যস্ত করে তোলে। ওই অঞ্চলের অনেকগুলো দেশের অর্থনীতি দারুণ ঝুঁকির মুখে পড়ে এবং সেখানকার পুঁজিবাজারের উপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা কমে যায়।

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় পড়ে গ্রিসের অর্থনীতি। তারাই ইউরো জোনের প্রথম দেশ যাদের বেইলআউটের দরকার হয়। এছাড়া পর্তুগাল, আয়ারল্যান্ড ও সাইপ্রাসের অর্থনীতিকেও খেলাপি হওয়া থেকে রক্ষা করতে উদ্ধার প্যাকেজ দিতে হয়েছে। এর ধাক্কায় ভূমধ্যসাগরের উপকূলবর্তী দেশগুলোতে বেকারত্বও কয়েকগুণ বেড়ে যায়।

Also Read: ‘এসভিবি’র পথে যাওয়ার শঙ্কায় যুক্তরাষ্ট্রের আরও ২০০ ব্যাংক