কিশোরকে আসামি করে মিথ্যা মামলা, এবার দুই পুলিশ আসামি

পুলিশের দায়ের করা মামলা মিথ্যা বলে রায় দিয়েছিলেন যে বিচারক তিনিই বাদী হয়ে এ মামলা করেছেন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Sept 2022, 10:29 AM
Updated : 13 Sept 2022, 10:29 AM

শুল্ক পরিশোধের কাগজ থাকার পরও এক কিশোরকে আসামি করে স্বর্ণ চোরাচালানের 'মিথ্যা মামলা' করা ও আদালতে 'মিথ্যা সাক্ষ্য' দেওয়ায় অভিযোগে বাদী ও তদন্তের দায়িত্বে থাকা দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন চট্টগ্রাম আদালতের এক বিচারক।

চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) ফেরদৌস আরা মঙ্গলবার চট্টগ্রামের মহানগর হাকিম আদালতে এ মামলা করেন।

মামলার আসামিরা হলেন- পতেঙ্গা থানার সাবেক এসআই আনোয়ার হোসেন ও এসআই সুবীর পাল। হাকিম আদাতের বিচারক জুয়েল দেব মামলাটি গ্রহণ করে দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির আদেশ দেন।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের পিপি খন্দকার আরিফুল আলম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০১৯ সালের ২২ এপ্রিল ১৫ বছর বয়সী এক কিশোরের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করেন পতেঙ্গা থানার এসআই আনোয়ার হোসেন। শুল্ক না দিয়ে দুটি সোনার বার পাচারের অভিযোগ আনা হয় মামলায়।

তদন্ত শেষে এসআই সুবীর পাল ওই বছর অক্টোবরে আদালতে অভিযোগপত্র দেন। মামলার বিচারে বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা আদালতে সাক্ষ্যও দেন।

ওই মামলার বিচার চলে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ এর বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) ফেরদৌস আরার আদালতে। এ বছর ৪ সেপ্টেম্বর তিনি মামলাটি খারিজ করে দিয়ে বলেন, শুল্ক পরিশোধের কাগজ থাকার পরও মিথ্যা মামলা করেছিল পুলিশ। তদন্ত প্রতিবেদন ও সাক্ষ্যও ছিল মিথ্যা।

বিচারক ফেরদৌস আরাই মঙ্গলবার নিজে বাদী হয়ে দুই পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দয়ের করলেন।

কী ঘটেছিল?

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ২০১৯ সালের ২১ এপ্রিল রাত পৌনে ১০টায় চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সংলগ্ন বাটারফ্লাই পার্কের সামনে তল্লাশি চৌকি থেকে স্কুল পড়ুয়া ছেলেটিকে আটক করে পুলিশ। তখন তার কাছে দুটি সোনার বার ছিল।

শিশুটির মা কুমিল্লার বাসিন্দা নারগিস আক্তার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তার স্বামীর ভাই বাহারাইন থেকে ‘কিছু জিনিসপত্র’ পাঠিয়েছিলেন তাদের প্রতিবেশী এএইচএম সুমনের মাধ্যমে।

“বিদেশ থেকে চাচার ফোন পেয়ে আমার ছেলে সেদিন বিমানবন্দরে গিয়েছিল সেসব জিনিস আনতে। সেখানে সুমন তাকে একটি প্যাকেট দেয়। সেটি নিয়ে ফেরার পথে আমার ছেলেকে আটক করে পুলিশ পতেঙ্গা থানায় নিয়ে যায়।”

পিপি খন্দকার আরিফুল আলম জানান, এএইচ এম সুমনকে বিমানবন্দরের ব্যাগেজ পরিদর্শক আটকালে তিনি বিধি অনুযায়ী শুল্ক পরিশোধ করে সোনার বার দুটি নেন। সেই বার তিনি হস্তান্তর করেন ওই কিশোরের কাছে।

“স্বর্ণ বার দুটি নিয়ে বাড়ি ফেরার সময় ছেলেটিকে আটক করা হয়। খবর পেয়ে পরিবার পরদিন থানায় গেলে একটি সোনার বার দিয়ে দিলে ছেলেকে ছেড়ে দেওয়া হবে বলে প্রস্তাব দেয় পুলিশ। তাতে রাজি না হওয়ায় এসআই আনোয়ার হোসেন বাদী হয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মামলা করে দেন।”

ওই মামলায় এক মাস ছয় দিন কারাগারে থাকার পর জামিনে মুক্তি পায় সেই কিশোর। কিন্তু ২০১৯ সালের ৩ অক্টোবর পতেঙ্গা থানার এসআই সুবীর পাল তাকে আসামি করেই অভিযোগপত্র দিলে আদালতে বিচার শুরু হয়।

চলতি বছরের ১১ এপ্রিল বাদী আনোয়ার হোসেন ও আইও সুবীর পাল আদালতে ওই কিশোরের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন। তারা দুজন ছাড়াও আরও তিনজনের সাক্ষ্য নেওয়া হয় রাষ্ট্রপক্ষে।

অন্যদিকে ছেলেটির পক্ষে তিনজন আদালতে সাক্ষ্য দেন। সোনার বারের জন্য বিমানবন্দরে শুল্ক পরিশোধের নথিপত্রও আদালতে জমা দেওয়া হয়।

পিপি আরিফুল আলম বলেন, “আদালতে দুই পুলিশ সদস্যের কাছে জানতে চান, স্বর্ণের বারের জন্য রাজস্ব পরিশোধের বিষয়টি তারা যাচাই করেছেন কিনা? তারা জানান, তা নিশ্চিত করেননি। রাজস্ব কর্মকর্তা এসে নথি দেখিয়ে নিশ্চিত করেন, এ দুটি সোনার বারের জন্য রাজস্ব দেওয়া হয়েছে।"

পরে ৪ সেপ্টেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্রুনাল রায় দেয়। সেখানে বলা হয়, কাগজপত্র আমলে না নিয়ে মিথ্যা মামলা করা হয়েছে, বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা শপথ নিয়ে আদালতে মিথ্যা সাক্ষ্য দিয়েছেন। মিথ্যা অভিযোগ থেকে ওই কিশোরকে অব্যাহতি দেওয়া হল।

ছেলেটির আইনজীবী আজমুল হুদা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিচারক ওই কিশোরকে খালাস দেওয়ার পর তারা মামলার বাদী এবং তদন্ত কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেন।

“এই প্রক্ষিতে আজ বিচারক বাদী হয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে মামলা করলে দুই পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছে।"

শিশুটির মা বলেন, “গত সাড়ে তিন বছর এ মামলার জন্য আমরা অনেক কষ্ট ভোগ করেছি। যেহেতু ঘটনায় পুলিশ সদস্যরা জড়িত, তাই আমরা মামলা না করে আদালতের কাছেই সুবিচার প্রার্থনা করি।”

পিপি আরিফুল আলম খন্দকার বলেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১৯৫ (বি) এবং সিআরপিসির বিভিন্ন ধারা অনুযায়ী পুলিশের করা মামলাটির রায়ের কপি এবং পর্যবেক্ষণ আদালতে জমা দিয়ে নতুন মামলাটি করা হয়েছে।

“এটি একটি ব্যতিক্রমী মামলা। ন্যায়বিচার নিশ্চিতের প্রশ্নে দায়িত্বে থেকে বিশেষ অপরাধ করায় এবং তাদের মিথ্যা মামলা ও মিথ্যা সাক্ষ্যের বিষয়টি বিচারে প্রমাণিত হওয়ায় বিচারক নিজে বাদী হয়ে মামলাটি করেছেন।”