এস আলম সুগার মিলে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘অপর্যাপ্ত’, আগুন নেভাতে ‘সময় লাগবে’

গুদামের আগুন নেভাতে মঙ্গলবার রাতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করতে চায় ফায়ার সার্ভিস।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 March 2024, 04:25 PM
Updated : 5 March 2024, 04:25 PM

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী থানার ইছানগরে এস আলম যে চিনি পরিশোধন কারখানা গড়েছে, সেটির অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ‘পর্যাপ্ত ছিল না’ বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের একাধিক কর্মকর্তা।

তবে দেশের অন্যতম বড় শিল্পগোষ্ঠীর কর্মকর্তাদের দাবি, তাদের চিনিকলে আগুন নেভানোর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা আছে।

ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, চিনি কলটির ফায়ার সেফটি প্ল্যান অনুমোদনের জন্য কিছুদিন আগে আবেদন করা হয়েছে। গত সপ্তাহে ফায়ার সার্ভিসের এ সংক্রান্ত কমিটি কারখানা ঘুরে প্রতিবেদন দিয়েছে। এখনো সেটি অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

আর আগুন লাগার পর কারখানার ভেতরে যে রিজার্ভারটি পানির উৎস হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে সেটি গুদাম থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পাইপ দিয়ে সে পানি টেনে আনতে গিয়ে কমে যাচ্ছে পানির চাপ।

ফলে বিশাল আয়তনের গুদামে তুলনামূলক কম চাপের পানি ছিটিয়ে সুফল মিলছে না। আগুন লাগার পরপরই তা নিয়ন্ত্রণে রাখা গেলে ক্ষয়ক্ষতি এত ব্যাপক হত না বলে মত সংশ্লিষ্টদের।

সেজন্য চিনি কলটির নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আরো উন্নত এবং এ কাজে প্রশিক্ষিত নিজস্ব জনবল থাকা প্রয়োজন ছিল বলে মতামত ফায়ার সার্ভিসের।

একদিন পরও নির্বাপণ না হওয়ায় গুদামের আগুন নেভাতে মঙ্গলবার রাতে নতুন পরিকল্পনা নিয়ে কাজ শুরু করতে চায় ফায়ার সার্ভিস।

তবে পুরো গুদামের আগুন নির্বাপণে আরো কত সময় লাগবে তা সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারছেন না তারা।

আগুনের সূত্রপাত

কর্ণফুলী থানার ইছানগরে এস আলম রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের চিনি পরিশোধনাগারটি নদী তীরের কাছেই।

মূলত নদীপথে কারখানায় আসে অপরিশোধিত চিনি। চিনি তৈরির এই কাঁচামাল উঁচু কনভেয়ার বেল্টের মাধ্যমে অদূরের গুদামে নিয়ে রাখা হয়। গুদাম থেকে অপরিশোধিত চিনি যায় পরিশোধন প্ল্যান্টে।

চিনিকলের এক শ্রমিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল (সোমবার) আমার ছিল নাইট ডিউটি। তাই আমি কারখানার পিছনে আমাদের থাকার জায়গায় শুয়ে ছিলাম। শোরগোল শুনে বাইরে আসি।

“এসে দেখি উপরের দিকে (কনভেয়ার বেল্টের অংশ) আগুন লাগছে ১ নম্বর গুদামে। এই বেল্ট চলে কারেন্টে (বিদ্যুতে)। পরে আগুন শুধু বাড়তে থাকে। তখন যারা গুদামের ভিতর ছিল তারা দৌড়ে বের হয়ে যায়।”

তবে আগুন লাগার কারণ কি সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারেননি কারখানার কর্মকর্তা বা ফায়ার সার্ভিসের কেউ।

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক (চট্টগ্রাম) এম ডি আবদুল মালেক বলেন, “প্রাথমিক অবস্থায় যদি আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা যেত বা নেভানো যেত তাহলে এতটা ব্যাপক আকার হয়ত ধারণ করত না।

“এত বিশাল জায়গা জুড়ে আগুন জ্বললে সেটা নেভানো আসলেই অনেক কঠিন।”

অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা ‘অপর্যাপ্ত’

ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক এম ডি আবদুল মালেকের কাছে প্রশ্ন ছিল এস আলমের চিনিকলের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল কি না।

জবাবে তিনি বলেন, “এটা অনেক বড় কারখানা। একটি চিনি পরিশোধন প্ল্যান্ট এবং পাঁচ-ছয়টি গুদাম। এখানে পানির রিজার্ভার আছে একটি। তবে সেটি গুদামটি থেকে একটু দূরে। আরো কয়েকটি রিজার্ভার থাকলে ভালো হত।

“অনেক দূর থেকে লম্বা পাইপ ব্যবহার করে গতকাল পানি আনতে হচ্ছিল। এতে পানির প্রেসার কমে যাচ্ছিল। কম চাপের পানি ছিটিয়ে এত বড় জায়গার আগুন নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। তাদের নিজস্ব ফায়ার ফাইটিং ব্যবস্থা আরো উন্নত এবং জনবল প্রশিক্ষিত হওয়া প্রয়োজন ছিল।”

ফায়ার সার্ভিসের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “এখানে একটি রিজার্ভার আছে। দক্ষিণ পশ্চিম দিকে, সেটি পুকুরের মত বড়। সেখান থেকে পাম্প বসিয়ে পাইপ দিয়ে পানি এনে আমরা ছিটাচ্ছি।

“কারখানাটি ফায়ার সেফটি প্ল্যানের জন্য কিছুদিন আগে আবেদন করেছে। গত সপ্তাহে মাত্র ফায়ার সার্ভিসের তিন সদস্যের কমিটি পরিদর্শন করে গেছেন আবেদনের প্রেক্ষিতে। এখন তাদের সেই আবেদন অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। অনুমোদন পেলে তারপর ফায়ার সেফটি প্ল্যান বাস্তবায়ন করবে।”

প্রায় ১৫ বছর আগে স্থাপিত কারখানাটি এতদিন তাহলে কীভাবে চলছিল প্রশ্ন করা হলে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, “নরমাল ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম ছিল। পুকুর আছে। তবে রাসায়নিক নির্বাপণের ব্যবস্থাপনা ছিল ছোটখাটো।

“ফায়ার সার্ভিসের লোকজন পরিদর্শন করেন নিয়মিত, পরামর্শ দেন। বাস্তবায়ন করাটা কারখানা কর্তৃপক্ষের বিষয়।”

এস আলম গ্রুপের প্রধান ভূ-সম্পদ কর্মকর্তা মো. মোস্তাইন বিল্লাহ আদিলের কাছে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যাপ্ত ছিল কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের যথেষ্ট অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা ছিল। যদি না থাকত আমাদের পুরো প্ল্যান্টে আগুন ছড়িয়ে যেত। আমরা মেইন প্ল্যান্ট সেইভ করতে পেরেছি। অন্যান্য গোডাউন সেইভ করতে পেরেছি। যদি আমাদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকত তাহলে আরো ম্যাসিভ ক্ষতি হতো।”

মঙ্গলবার আগুনের ঘটনাস্থলে আসেন ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর, ঢাকার উপপরিচালক (প্রশাসন ও অর্থ) মো. জসীম উদ্দিন। তিনি অবশ্য অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার ঘাটতি বিষয়ে এখনই কিছু বলতে নারাজ।

অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নির্দেশে আগুন দ্রুত নির্বাপণে করণীয় ঠিক করতে ঢাকা থেকে এসেছেন জানিয়ে মো. জসীম উদ্দিন বলেন, “এস আলম অনেক বড় প্রতিষ্ঠান। তাদের সুনাম আছে। আমাদের তরফ থেকেও কমিটি করা হবে। তদন্তের পরে বুঝতে পারব কি ত্রুটি ছিল বা সেফটিতে ঘাটতি ছিল কিনা।”

দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু?

ঢাকার বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডের কয়েকদিনের মধ্যেই রমজানের মাত্র এক সপ্তাহ আগে চিনির কারখানায় আগুন নিছক দুর্ঘটনা নাকি অন্যকিছু তা নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে প্রশ্ন উঠেছে।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের উপপরিচালক মো. জসীম উদ্দিন বলেন, “এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে এটা দুর্ঘটনা। কারণ দিনের বেলায় ঘটেছে।

“প্রশাসন তদন্ত কমিটি করেছে। তারা তদন্ত করে দেখবে। আমরা এখনো আগুন নেভানোর বিষয়ে কাজ করছি। পুরো নির্বাপণ হলে তখন আমরাও তদন্ত করে দেখব কি কারণে কীভাবে আগুন লেগেছে। এখনই কিছু বলছি না।”

অগ্নিকাণ্ডটির নেপথ্যে নাশকতার আশঙ্কা করছেন কিনা জানতে চাইলে এস আলম গ্রুপের জিএম (কর্মাশিয়াল) মো. আকতার হোসেন বলেন, “কেন কীভাবে এসব বিতর্কিত প্রসঙ্গে না যাওয়াই ভালো। কাউকে সন্দেহ করছি কিনা, এসব প্রসঙ্গের জন্য আমরা প্রস্তুত নই। আমরা এখন আগুন নেভানো এবং কারখানার সুরক্ষা নিয়ে চিন্তিত। সে বিষয়ে কাজ করছি।”

ঘটনাস্থলে তদন্ত কমিটি

মঙ্গলবার দুপুরে ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যায় জেলা প্রশাসনের তদন্ত কমিটি।

এর আগে সোমবার রাতে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। যাদের তদন্তের জন্য তিনদিন সময় দেয়া হয়েছিল। পরে মঙ্গলবার কমিটির সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে নয়জন করা হয়। বাড়ে তদন্তের সময়ও।

মঙ্গলবার দুপুরে পরিদর্শনে এসে তদন্ত কমিটির সদস্যরা এস আলম গ্রুপের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।

পরে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মামুনুর রহমান বলেন, “তদন্ত কমিটির সদস্যদের নিয়ে আজ সকালে আমরা বসেছিলাম। সেখান থেকে এখন পরিদর্শনে এসেছি। এখানকার ম্যানেজমেন্টের সাথে কথা বলেছি।

“নেপথ্যের কারণ কি, ভবিষ্যতের জন্য নির্দেশনা কি হবে সব বিষয়ে আমরা কাজ করছি। প্রত্যেকের বক্তব্য নিয়েছি। এখানে আমাদের সাথে ইউএনও, ওসি, ফায়ার সার্ভিসের ও কল কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরেরসহ সব প্রতিনিধি আছে। তদন্ত শেষ করতে কিছু সময় লাগবে। যেহেতু এখনো আগুন নিয়ন্ত্রণে আসেনি। পরশু আমরা আবার আসব।”

আগুন লাগার কারণ এবং তদন্ত প্রতিবেদন বিষয়ে জানতে চাইলে মামুনুর রহমান বলেন, “আশা করি, দ্রুত অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানাতে পারব। এটা দুর্ঘটনা নাকি অন্য কিছু তা এখনো নিশ্চিত নয়। ফায়ার সার্ভিসের যারা কাজ করছেন তারাও এখনো ভিতরে যেতে পারেননি। কীভাবে কী হয়েছে তা আমরা দেখব।

“এখন বিভিন্ন ডকুমেন্ট দেখেছি। আমাদের কমিটিকে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে সুপারিশও দিতে বলা হয়েছেছ। যেন আর না ঘটে। ৯ সদস্যের এই কমিটিকে সাত দিন সময় দেয়া হয়েছে প্রতিবেদন দেয়ার জন্য। তদন্ত চলছে।”

কত চিনি ছিল

আগুন লাগার পর সোমবার রাতে এস আলম গ্রুপের ম্যানেজার (এইচআর) মোহাম্মদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, এক নম্বর গুদাম পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে গেছে। চারটি গুদামের প্রতিটিতে এক লাখ টন করে চার লাখ টন অপরিশোধিত চিনি ছিল। বাকি তিনটি গুদামে আগুন ছড়ায়নি। মিলেও আগুন ছড়ায়নি। পাশের বিদ্যুৎকেন্দ্রেও আগুন ছড়ায়নি।

“গত দুই মাসে এসব চিনি ব্রাজিল থেকে আমদানি করা হয়। রমজানে পরিশোধিত হয়ে বাজারে যাওয়ার কথা ছিল।”

মঙ্গলবার দুপুরে গ্রুপের জিএম (এইচআর) মোহাম্মদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “রোজায় সারাদেশে এক লাখ টন চিনি লাগে। শুধু আমাদেরই চার লাখ টন চিনি আছে। ‘র’ সুগারের একটা গুদাম জ্বলেছে। তিনটা অক্ষত আছে। আরেকটা গুদাম ফিনিশড সুগারের, সেটাও অক্ষত আছে।

“আমাদের প্রায় ২৫ হাজার টন পরিশোধিত চিনি রেডি আছে। সেটা ১০-১৫ দিনের মত ফিনিশড গুড।”

এস আলমের এই চিনি শোধনাগারটির পরিশোধন ক্ষমতা দিনে ২২০০ টন। সে হিসেবে অপরিশোধিত চার লাখ টন চিনি পরিশোধনে সময় লাগার কথা প্রায় ১৮২দিন, মানে ছয় মাস।

আগুনের অবস্থা

সোমবার বিকাল ৪টার দিকে লাগা আগুন মঙ্গলবার রাত ৮টার সময়ও নির্বাপণ সম্ভব হয়নি।

মঙ্গলবার বিকালে ফায়ার সার্ভিস অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জসীম উদ্দিনের কাছে কীভাবে আগুন নেভানোর কাজ চলছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এখানে অপরিশোধিত চিনি আছে এক লাখ টনের বেশি। এতে কার্বন ও অক্সিজেন আছে। দুটোই আগুন জ্বলতে সাহায্য করছে।

“পানি ছিটানোর পর সেগুলো উপর থেকে চিটাগুড়ের মত ঘন হয়ে নেমে আসছে। হিট কন্ট্রোলের জন্য আমরা চারদিক থেকে পানি ছিটাচ্ছি। ক্রেন দিয়ে গুদামের ছাদের দিকের নির্দিষ্ট জায়গার টিন সরানো হচ্ছে। তারপর সেখানে ফোম ব্যবহার করছি। এভাবে কাজ চলছে। তবে এখনই নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব না কত ঘণ্টা পর বা কতক্ষণ পর আগুন পুরোপুরি নির্বাপণ হবে।”

আগুন নেভাতে কি কার্যক্রম নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী বলেন, “আমরা একটা পরিকল্পনা করেছি। আজ রাত ১০টা থেকে ৭-৮টা পাম্প একসাথে বসানো হবে।

“এরমধ্যে লংবুম পাওয়া গেলে সেটা দিয়ে গুদামের ভিতরে থাকা অপরিশোধিত চিনি রাতের মধ্যে অর্ধেক সরিয়ে ফেলতে চাই। তারপর চারদিক থেকে সবগুলো পাম্প ব্যবহার করে একসাথে পানি ছিটানো হবে।”

এভাবে মঙ্গলবার রাতে আগুন নির্বাপণে কাজ করতে চায় ফায়ার সার্ভিস। এরপর রাতের মধ্যে আগুন নেভানো সম্ভব না হলে বুধবার সকালে আবার নতুন পরিকল্পনা করা হবে।