সম্প্রীতি বিনষ্টকারীদের বিরুদ্ধে জনপ্রতিনিধিদের সজাগ থাকার পরামর্শ

জেলা প্রশাসক বলেন, গত বছর যেসব এলাকার জনপ্রতিনিধিরা সজাগ ছিলেন, সেসব জায়গায় কোনো ঘটনা ঘটেনি।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Sept 2022, 01:59 PM
Updated : 27 Sept 2022, 01:59 PM

গুজব রটিয়ে কেউ যেন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, সে বিষয়ে জনপ্রতিনিধিদের সজাগ থাকার পরামর্শ এসেছে চট্টগ্রামের এক সম্প্রীতি সমাবেশ থেকে।

মঙ্গলবার চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে এলজিইডি মিলনাতায়নে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, পুলিশ ও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে এ সমাবেশ হয়।

গেল বছর দুর্গা পূজায় কুমিল্লার নানুয়া দিঘীর পাড় পূজামণ্ডপে কোরআন রাখার অভিযোগ তুলে বেশ কিছু মন্দিরসহ শহরের সালাউদ্দীন রোড কালীগাছতলা ও কাপুড়িয়া পট্টির মণ্ডপে হামলা হয়। এর জেরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মঠ-মন্দির ও হিন্দু পল্লীতে হামলা ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।

এ বছর পূজার আগে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়, জনপ্রতিনিধি ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তিদের নিয়ে সম্প্রীতি সমাবেশ ও শোভাযাত্রার আয়োজন করা হচ্ছে।

জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রহমান সমাবেশে বলেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। এখানে বিভিন্ন ধর্ম ও জাতির লোকজন সমান অধিকার ভোগ করে। স্বাধীনতা বিরোধী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তি ও জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষকরা এ সম্প্রতিকে প্রায় সময় ‘নস্যাৎ করার’ চেষ্টা করে।

“গত বছর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সফরকে কেন্দ্র করে সমগ্র বাংলাদেশে একটি নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞের খেলা শুরু হয়েছিল। এর ধারাবাহিকতায় কুমিল্লায় একটি সাজানো ঘটনাকে কেন্দ্র করে ফেইসবুকে বিভিন্ন তথ্য রটিয়ে চট্টগ্রামসহ সারাদেশে পূজা মণ্ডপে হামলা হয়।”

একটি গোষ্ঠী এবারও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ‘বিনষ্টের চেষ্টা’ করছে দাবি করে জেলা প্রশাসক বলেন, “আমরা বিভিন্ন সময়ে তথ্য পাচ্ছি, একই সাম্প্রদায়িক ও উগ্রবাদী গোষ্ঠী দুর্গা পূজাকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার অপচেষ্টা চালাতে পারে।

“তবে আমাদের সব ধরনের প্রস্তুতি রযেছে। আমরা হুঁশিয়ার উচ্চারণ করতে চাই, যারাই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করবে, সে যেই হোক, কাউকে বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেব না।”

স্থানীয় পৌর মেয়র, উপজেলা, ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, গত বছরে যেসব এলাকার জনপ্রতিনিধিরা সজাগ ছিলেন, সেসব জায়গায় কোনো ঘটনা ঘটেনি।

“চট্টগ্রাম দেশের লাইফলাইন, তাই চট্টগ্রামের আইনশৃঙ্খলা যদি কেউ বিনষ্ট করতে পারে তাহলে সমস্ত বাংলাদেশকে তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। তাই গুরুত্বপূর্ণ জেলা হিসেবে চট্টগ্রামের যে কোনো একটি ছোট ঘটনা অন্য জেলার বড় ঘটনার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং চট্টগ্রামের পরিবেশ পরিস্থিতি আইনশৃঙ্খলা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি যে কোনো ভাবে রক্ষা করব।”

ছোটোখাট বিষয়কে পুঁজি করে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেও ‘সাম্প্রদায়িক বিষ’ ছড়ানো হচ্ছে মন্তব্য করে মোমিনুর বলেন, “আমরা দেখেছি এসব ঘটনায় আশপাশের উপজেলা ও জেলা থেকেও বাস ভর্তি করে মানববন্ধন করার জন্য লোক নিয়ে আসা হয়েছে।

“এটা কেমন কথা!  আমরা জানার আগেই আশেপাশের জেলা উপজেলা থেকে লোক নিয়ে আসা হয়েছে মানববন্ধন করার জন্য। তার মানে আমরা বুঝতে পারছি এসব ঘটনার পেছনে কেউ কলকাটি নাড়ছে, অত্যন্ত পরিকল্পিত।”

জেলার পুলিশ সুপার এস এম শফিউল্লাহ বলেন, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রশাসনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ না করলে সম্প্রীতি কখনও রক্ষা করা যায় না।

“আমাদের মধ্যে একটা কমিটমেন্ট আছে। আমরা যারা সরকারি চাকরি করি তাদের চাকরিবিধিতে লেখা আছে জনস্বার্থে এ নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের শপথনামায় লেখা থাকে ‘আমরা জনগণের সেবা করব, এ ব্রত নিয়ে আমরা শপথ নিলাম।

“একই ভাবে রাজনৈতিক নেতাদের মেনিফেস্টোতে আছে, আমরা যাই করব জনস্বার্থে এ কাজটি করব। আমাদের কাজ যদি জনস্বার্থে হয়, আমাদের দায়িত্ব এড়ানোর কোনো সুযোগ নাই।”

জনপ্রতিনিধিদের উদ্দেশে পুলিশ সুপার বলেন, “আপনারা যদি বলেন, জেলা প্রশাসক, ওসি, ইউএনও এ কাজটি করবেন, তাহলে আমি বলব ভুল। যদি বলেন, আমরা জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সবাইকে নিয়ে কাজটি করব সেটা সঠিক।

“জনগণ আপনাদের ভোট দিয়েছে তাই আমি মনে করি এলাকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার বড় দায়িত্ব চেয়ারম্যানদের।”

পুলিশ সুপার বলেন, “চেয়ারম্যানরা তার এলাকার কোথায় কী হবে না হবে সবকিছু বলতে পারেন। এমনকি একটা পাতা পড়লেও তারা টের পান। তার অধীনে আছে মেম্বার, সংরক্ষিত মহিলা মেম্বার। তারপর আছে পুলিশ বাহিনী, উপজেলা, জেলা প্রশাসন…

“এত বিশাল একটা নেটওয়ার্ক, এ নেটওয়ার্কের মধ্য দিয়ে মুষ্টিমেয় কিছু সন্ত্রাসী, জঙ্গি, আমাদের সম্প্রীতি নষ্ট করে পার পেয়ে যাবে, সেটা অসম্ভব। আমরা তাদের আইনের হাত দিয়ে গলা চেপে শক্ত হাতে দমন করব। কোনো পার পাওয়ার সুযোগ নাই।”

তিনি বলেন, “গতবার যারা করেছে, তাদের সবার তথ্য আমরা নিয়েছি। কারা আমাদের সাথে থেকে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে ফায়দা লোটার চেষ্টা করেন, সে তথ্য আমাদের কাছে আছে। সেগুলো নিয়ে আমরা এবার মাঠে নেমেছি।

“মনে রাখতে হবে, আমাদের আগামী বছর নির্বাচন। স্বাধীনতার পক্ষের সরকারকে বিভিন্নভাবে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলার জন্য এবং উন্নয়নের ধারা ব্যাহত করার জন্য একটি সন্ত্রাসীগোষ্ঠী আমাদের পেছনে লেগে আছে। কিন্তু এটা অসম্ভব।”

গতবছর কুমিল্লাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলার ইন্ধনদাতারা ‘শনাক্ত না হওয়ায়’ ক্ষোভ প্রকাশ করে জেলা দক্ষিণ আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান বলেন, “পৃথিবীর কোথাও সাম্প্রদায়িকতা দিয়ে মঙ্গল হয়নি। এটা এখন অচল অস্ত্র। বিভিন্ন দেশে সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রাথমিকভাবে গ্রহণ করলে স্থায়ীভাবে কেউ গ্রহণ করে না।”

পূজার সময় স্থানীয় চেয়ারম্যানদের সজাগ থাকার আহ্বান জানিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, “গতবছর জেলা প্রশাসক ফোন করে চেয়ারম্যানদের পায়নি। পূজার সময় আপনারা মোবাইল খোলা রাখবেন। না হয় চোখ কান খোলা রাখবেন।”

অন্যদের মধ্যে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান, সিভিল সার্জন ইলিয়াছ চৌধুরী, পটিয়া পৌরসভার মেয়র আইয়ুব বাবুল, চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেখা আলম, সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর রেখা আলম, চট্টগ্রাম মহানগর মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোজাফ্ফর আহমদ, জেলা কমান্ডার সরোয়ার কামাল, মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মিনহাজুর রহমান, বাঁশখালী থানার ওসি কামাল উদ্দিন, লোহাগাড়া বড় হাতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বিজয় বড়ুয়া, চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শ্যামল পালিত, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ট্রাস্টি মিথুন বড়ূয়া, আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদের পেশ ইমাম মো. আনোয়ারুল ইসলাম আযাহারী সমাবেশে বক্তব্য দেন।

পরে সবাই শপথ বাক্য পাঠ শেষে সম্প্রীতি শোভাযাত্রায় অংশ নেন।