বুধবার রাতে বোমা হামলায় জাহাজের নাবিক মো. হাদিসুর রহমানের মৃত্যুর পর থেকে মাসুম বিল্লাহর পরিবারের কারও চোখে ঘুম নেই। তার মা ও ভাই-বোনরা কান্নাকাটি করছেন।
মাসুম বিল্লাহর বাবা ওবায়দুল হক কাঁদতে কাঁদতে বৃহস্পতিবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঘণ্টা দুয়েক আগে ছেলে আমাকে ফোন দিয়েছে। বলেছে, গতকালের ঘটনার পর তারা সবাই এক রুমে আছে। ভয়ে তারা আর জাহাজের উপরে যাচ্ছে না।
“ছেলে বলেছে- ‘আমাদের বাঁচান’। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন, আমার ছেলেকে আমার কাছে ফিরিয়ে দেন। সবাইকে সবার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন। আমরা বড় অসহায়। আমার স্ত্রী, সন্তানরা সবাই কান্নাকাটি করছে। আমার ছেলে কষ্টে আতঙ্কে আছে। শুধু আহাজারি করছে, আমাদের নিয়ে যান। কলিজাটা আমার বাইর হই যায়।”
ইউক্রেইনে যুদ্ধের মধ্যে ওলভিয়া বন্দরে বাংলাদেশ জাহাজ আক্রান্ত হওয়ার পর পরিস্থিতি খানিকটা বদলেছে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় ওই জাহাজটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নাবিকদের নামিয়ে আনা হয়।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম জানিয়েছেন, জাহাজের ২৮ জন নাবিককে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তাদের পোল্যান্ডের ওয়ারশ হয়ে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনের (বিএসসি) কার্যালয়ে গিয়েছিলেন ওবায়দুল হক। তিনি বলেন, “বিএসসির কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা চেষ্টা করছেন। আকাশপথে বা পানি দিয়ে, যেভাবে হয়।”
ফেনীর রামপুরের বাসিন্দা নাবিক সাজ্জাদ ইবনে আলমের (২১) বড় ভাই নজরুল ইসলাম শিপন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই প্রথমবার ভাই শিপে গেছে। আজকে ১২টার দিকে তার দেওয়া মেসেজ পেয়েছি। শুধু বলেছে, ‘ভাইয়া আমি ভালো আছি।’
“এরপর ২টার দিকে বাসায় আমার বোনের কাছে ফোন করেছে। তখন বলেছে, তাদের সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে এ বিষয়ে শিউর কিছু বলতে পারছি না।”
এর আগে বুধবার রাত ৮টার দিকে ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয় জানিয়ে শিপন বলেন, “পরে টেলিভিশনে খবর দেখে যোগাযোগের চেষ্টা করি। পারিনি। সকালে বিএসসি অফিসে গেছিলাম। তারা চেষ্টা করছে বলে জানিয়েছে।”
গত ১৪ জানুয়ারি শ্রীলঙ্কায় গিয়ে জাহাজে ওঠেন সাজ্জাদ। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি সবার ছোট।
১৯৯১ সাল থেকে নগরীর কলসির দিঘীর পার এলাকার মো. হানিফ (৫৫) জাহাজে চাকরি করেন বলে জানান তার আত্মীয় জোবায়ের আহমেদ ইফতি।
তিনি বলেন, “আমার খালু গতকাল সকাল সাড়ে ৯টার দিকে যোগাযোগ করেছিলেন। তখন বলেছিলেন, ‘আমাদের জন্য দোয়া করিও। এখানে থাকতে পারছি না বোমার আওয়াজে।’ পরে আজকে ফেসবুকে একটা ভিডিওতে উনাকে দেখেছি।”
দুই ছেলে, এক মেয়ের জনক মো. হানিফও গেল জানুয়ারিতে শ্রীলঙ্কা থেকে ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজে যাত্রা করেন।
‘বাংলার সমৃদ্ধি’তে থার্ড অফিসার হিসেবে আছেন রুকনুজ্জামান রাজীব (২৬)। ময়মনসিংহ সদরের কাঁচিঝুলির ওয়াজেদ আলীর ছেলে রাজীব জাহাজটিতে যোগ দেন মাস চারেক আগে। তার ঘরে দুই বছর বয়সী এক ছেলে আসে। অন্যদের মতো তার স্বজনরাও উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় সময় পার করছেন।
অসহায়ত্ব প্রকাশ করে রাজীবের বড় ভাই কামরুজ্জামান রাসেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রাজীবসহ অন্যান্য নাবিকরা এখন কঠিন সময় অতিবাহিত করছে। তাদের জাহাজে একমাসের মতো খাদ্যের যোগান জোগান থাকলেও জাহাজের বিদ্যুৎ সিস্টেম নষ্ট হয়ে যাওয়ায় ফ্রিজসহ সব কিছুই অকেজো হয়ে গেছে।”
বাংলার সমৃদ্ধি’র মালিকানা বিএসসির হলেও ডেনিশ কোম্পানি ডেলটা করপোরেশনের অধীনে সেটি ভাড়ায় চলছিল। গত ২৬ জানুয়ারি মুম্বাই বন্দর থেকে রওনা হয়ে তুরস্কের ইরেগলি হয়ে ইউক্রেইনের ওলভিয়া বন্দরে পৌঁছায় জাহাজটি।
২২ ফেব্রুয়ারি জাহাজটি বন্দরের আউটার অ্যাংকরেজে ছিল, পরদিন ইনার অ্যাংকরেজে নিয়ে যাওয়া হয়। এই বন্দর থেকে সিমেন্ট ক্লে নিয়ে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইতালির রেভেনা বন্দরের উদ্দেশ্যে রওনা হওয়ার কথা ছিল বাংলার সমৃদ্ধির। কিন্তু সেদিন ভোরে রাশিয়া ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করলে পরিস্থিতি রাতারাতি বদলে যায়।
এরমধ্যে বুধবার স্থানীয় সময় বিকেল সোয়া পাঁচটার দিকে হামলা হলে জাহাজের ব্রিজে থাকা থার্ড ইঞ্জিনিয়ার মো. হাদিসুর রহমান মারা যান। বৃহস্পতিবার বিএসসি’র কর্মকর্তারা জানান, জাহাজে থাকা বাকি ২৮ জনকে নিরাপদে সরিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
বাংলার সমৃদ্ধির দুই নারী ক্যাডেটের ভিডিও বার্তা
গোলার আঘাতের পর ‘বাংলার সমৃদ্ধি’ জাহাজের দুই নারী ক্যাডেট ভিডিও বার্তা দিয়ে সবাইকে জাহাজ থেকে উদ্ধারের আহ্বান জানিয়েছিলেন।
জাহাজ থেকে সরিয়ে নেওয়ার আগে ফেইসবুকে দেওয়া দুটি ভিডিও বার্তায় জাহাজে থাকা ফারজানা ইসলাম মৌ এবং ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি তাদের আকুতি জানান।
ইঞ্জিন ক্যাডেট ফারজানা ভিডিওতে বলেন, “আমি ইঞ্জিন ক্যাডেট মৌ। বাংলার সমৃদ্ধি থেকে বলছি। আমাদের থার্ড ইঞ্জিনিয়ার স্যার মারা গেছেন। আমাদের শিপে বোম্বিং হয়েছে।
“আমরা চাইছি এখান থেকে বের হতে। প্লিজ কোনো একটা উপায় করে আমাদের এখান থেকে বের করেন। আমরা কেউ এখানে আর থাকতে চাই না।”
জাহাজের ডেক ক্যাডেট ফারিয়াতুল জান্নাত তুলি ভিডিওতে বলেন, “আমি তুলি। বাংলার সমৃদ্ধি থেকে বলছি। ... আমরা সবাই খুব বিপদে আছি। আমাদের সবাইকে উদ্ধার করেন প্লিজ। এখান থেকে আমাদের বাঁচান।”