হাটহাজারীতে মামুনুলকে ছাড়াই মাহফিল হল, ক্ষোভ ঝাড়লেন বাবুনগরী

প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ দিনভর মাঠে থাকল; সারা দিন চললো নানা রকম গুঞ্জন; শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতাকারী হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে ছাড়াই মাহফিল হল চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2020, 04:38 PM
Updated : 27 Nov 2020, 04:44 PM

শুক্রবার সন্ধ্যায় হাটহাজারীর পার্বতী সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ‘আল আমিন সংস্থা’ আয়োজিত বার্ষিক মাহফিলের সমাপনী অধিবেশনে অন্যতম বক্তা হিসেবে উপস্থিত থাকার কথা ছিল মামুনুলের।

তিনি যে ‘আসেননি’, সন্ধ্যায় মাহফিলের প্রধান অতিথি হেফাজতের আমীর জুনাইদ বাবুনগরী সে কথা জানান।

দীর্ঘ বক্তব্যের শেষ দিকে তিনি বলেন, “সরকার প্রশাসনকে আমরা সম্মান করি, ইজ্জত করি, গোয়েন্দারা এখানে আছেন। কিন্তু কোনো হক কথা আমরা ছাড়ব না।

“মামুনুল হক শায়খুল হাদীস। উনার পিতা একজন শায়খুল হাদীস। উনার (মামুনুল) আসার কথা ছিল। সরকার-প্রশাসনের লোকজন আমাদের সাথে আলাপ করেছেন। আমরা শান্তি চাই।”

সেই সঙ্গে মামুনুলকে ঠেকানোর আন্দোলন নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে হেফাজত আমির বলেন, “একজন আলেমকে এভাবে অপমান করলে... মাননীয় প্রশাসন, এগুলোর দ্বারা আপনাদেরই সমস্যা হবে।”

বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব এবং বাংলাদেশ খেলাফত যুব মজলিসের কেন্দ্রীয় সভাপতি মামুনুল হক সদ্য ঘোষিত হেফাজতে ইসলামের কমিটিতে যুগ্ম মহাসচিবের পদ পেয়েছেন।

নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে ঢাকার বিএমএ মিলনায়তনে রাজধানীর ধোলাইরপাড়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাস্কর্য স্থাপনের বিরোধিতা করে তা অবিলম্বে বন্ধের দাবি তোলেন এই হেফাজত নেতা।

হাটহাজারীতে আল আমিন সংস্থা আয়োজিত বার্ষিক তাফসীরুল কুরআন মাহফিলের সমাপনী পর্বে তার অতিথি হয়ে আসার কথা থাকায় তাকে প্রতিহত করার ঘোষণা দেওয়া হয় ‘জঙ্গিবাদ বিরোধী ছাত্র ও যুব ঐক্য পরিষদ’ নামের এক সংগঠনের সমাবেশ থেকে।

বৃহস্পতিবার বিকেলে চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাব প্রাঙ্গণে ওই সমাবেশের পর রাত থেকেই মামুনুল হকের চট্টগ্রামে আসা নিয়ে নানা রকম গুঞ্জন  ছড়াতে থাকে।

সকালে নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ মিছিল করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। নগর যুবলীগ ও পতেঙ্গা থানা ছাত্রলীগ কর্মীরা চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবস্থান নেয়। পাশাপাশি দুপুর থেকে অক্সিজেন মোড়ে অবস্থান নেন নগর ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ছাত্রলীগ দুপুরে মূল ফটকের কাছে সড়ক অবরোধ করে। পরে তারা অবরোধ তুলে নিয়ে ফতেয়াবাদ এলাকায় অবস্থান নেন।

বিকেলে নগরীর জিইসি মোড়ে বিক্ষোভ মিছিল করে ওমরগণি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগ। সেখানে সংক্ষিপ্ত বিক্ষোভ সমাবেশে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহ-সম্পাদক হাবিবুর রহমান তারেক বলেন, “ধর্ম ব্যবসায়ী মামুনুল হক জাতির পিতাকে নিয়ে লাগামহীন বক্তব্য দিয়েছে, আমাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হয়েছে। তাই আমরা ঘোষণা দিয়েছি, তাকে চট্টগ্রামে প্রবেশ করতে দেব না।”

এদিকে মামুনুল হক বৃহস্পতিবার রাতেই হাটহাজারী এসেছেন বলে একটি গুঞ্জন চলতে থাকে দিনভর।

কিন্তু মাহফিল আয়োজনকারী আল আমিন সংস্থার সম্পাদক মোহাম্মদ আহসান উল্লাহ দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের কাছে দাবি করেন, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যার পর থেকে তাদের সাথে মামুনুলের আর কোনো যোগাযোগ হয়নি।

হেফাজতের সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী বিকেলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি হাটহাজারী আসেননি, মাদ্রাসায়ও আসেননি।”

শেষ পর্যন্ত মামুনুলকে ছাড়াই সন্ধ্যায় মাহফিলের সমাপনী অধিবেশন হয়।

জুনাইদ বাবুনগরী বলেন, “উনি (মামুনুল) বলেছেন, ‘আমি ছাড়াও মাহফিল হবে। আমি যাব না।’ এটা ছাড়া উনার হাজারো মাহফিল আছে। মামুনুল হক আর আসেননি। উনি আসার জন্য আগ্রহী নন। নিজেই ফিরে গেছেন। বয়ান করবেন না। যেখানে বিশৃঙ্খলা, সেখানে আমরা নেই। হেফাজতের উদ্দেশ্য শান্তি প্রতিষ্ঠা করা।”

মামুনুলকে প্রতিহতের ঘোষণা দিয়ে যারা রাজপথে বিক্ষোভ করেছেন, তাদের সমালোচনা করে হেফাজত আমির বলেন, “চলে গেছেন, খালাস। সে তো আসতেছে না। কিন্তু কিছু উগ্রপন্থি তার ছবিতে আগুন দেওয়ার কারণ কী।

“প্রশাসন আমার সাথে পরামর্শ করে, কথা বলে, সব জানে... তাহলে কেন? তাহলে এসব জুলুম নির্যাতন কেন করা হল।”

মামুনুল হকের ছবি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘অশালীন’ প্রচারের অভিযোগ করেন বাবুনগরী।

যারা এসব করেছে, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করে তিনি বলেন, “আইন আমরা হাতে নেব না। আইন থাকবে সরকার প্রশাসনের কাছে। দাবি করছি, এসব কুচক্রি মহলের কারণে আপনাদেরও ক্ষতি।”

চট্টগ্রামে এই মাহফিলের আগে দুপুরে মামুনুলের সমর্থক একদল মাদ্রাসা ছাত্র ঢাকার কাকরাইলে বিক্ষোভ করার সময় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ালে নয়জনকে আটক করা হয়।

এর প্রতিবাদ জানিয়ে বাবুনগরী বলেন, “ওস্তাদের মানহানি করলে মাদ্রাসায় পড়ুয়া ছাত্ররা বসে থাকতে পারে না। কুচক্রী মহল শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হককে বলেছে রাজাকার। তিনি আল্লাহর অলি। সেসব কারণে ছোট ছাত্ররা মিছিল বের করেছে। সেসব ছাত্রদের আবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

“প্রশাসন সরকার সব বুঝেছেন। আমরা প্রধানমন্ত্রীর শত্রু নই। নাস্তিক মুরতাদ আলেম ওলামার শত্রুরা আপনার কাঁধে চেপে বসে আছে। যেসব ছাত্ররা নিজের ওস্তাদের ইজ্জত রক্ষায় মিছিল করেছে তাদের যে গ্রেপ্তার করা হল, তাদের ২৪ ঘণ্টার ভিতরে ছেড়ে দিতে হবে।”

যদি সেই ‘মাসুম ছেলেদের’ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ছেড়ে দেওয়া না হয়, তাহলে কঠিন কর্মসূচি দেওয়ার হুমকি দেন বাবুনগরী।

এই মাহফিল এবং মামুনুলকে প্রতিহত করার ঘোষণা নিয়ে স্থানীয় প্রশাসনকেও সারা দিন সতর্ক থাকতে হয়।

হাটহাজারীর ইউএনও রুহুল আমীন এক প্রশ্নের জবাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আয়োজকদের সাথে আমাদের আলোচনা হয়েছিল। বলেছিলাম মামুনুল হক সাহেবের উপস্থিতি নিয়ে উত্তেজনা হতে পারে।

“এরপর তিনি হাটহাজারী এসেছেন এরকম কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। হেফাজতের আমীর মাহফিলে বলেছেন তিনি (মামুনুল হক) বয়ান করবেন না। এই বক্তব্য লাইভে সবাই শুনেছেন। আমরাও শুনেছি।”

নগর যুবলীগের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন বাচ্চু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছি। বাস্তবতা অনুধাবন করতে পেরে তিনি নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। শুধু মামুনুল হক নয়, জাতির জনককে নিয়ে আমাদের জাতীয় চেতনার পরিপন্থি বক্তব্য যত বড় ব্যক্তিই দিক, তাকে প্রতিরোধ করা হবে।”

আরও পড়ুন: