বিপ্লব উদ্যানে চুক্তির ‘শর্ত লঙ্ঘন’, বন্ধ থাকবে দোকান

সৌন্দর্য বর্ধন প্রকল্পের আওতায় বিপ্লব উদ্যানে শর্ত ভঙ্গ করে বড় আকারের দোকান ও দ্বিতল অবকাঠামো করায় দোকানগুলো বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন।

চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 August 2020, 01:11 PM
Updated : 25 August 2020, 01:11 PM

মঙ্গলবার নগরীর দুই নম্বর গেট এলাকায় বিপ্লব উদ্যান পরিদর্শন ও গণশুনানিতে অংশ নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) প্রশাসক এই নির্দেশনা দেন।

এসময় সুজন বলেন, “বিপ্লব উদ্যানে সৌন্দর্য বর্ধন কার্যক্রমে নির্মিত দোকানের বর্ধিত অংশ ভেঙ্গে ফেলা হবে। একই সাথে চুক্তি লঙ্ঘিত হওয়ায় এর সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত দোকান বন্ধ থাকবে।”

করোনাভাইরাস মহামারীর প্রাদুর্ভাবে প্রায় চার মাস বন্ধ থাকার পর সম্প্রতি বিপ্লব উদ্যানের দোকানগুলো খুলেছিল।

পরিদর্শনে প্রশাসক দেখতে পান সিসিসির সঙ্গে করা চুক্তিতে ১৫০ বর্গফুটের দোকান করার কথা থাকলেও প্রতিটি দোকান ২০০ বর্গফুটের।

এছাড়া জনসাধারণের চলাচলের রাস্তা সংকুচিত করে দোকানের সামনে বসার জন্য স্থায়ী আসন বানানো হয়েছে।

চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করে দ্বিতল ভবন নির্মাণ করে দোকান বসানো হয়েছে, যা সিসিসির সঙ্গে করা চুক্তিতে ছিল না।

এসব অনিয়ম ও অসঙ্গতি দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করে প্রশাসক সুজন বলেন, “বর্তমানে পার্কটিতে কোনো প্রাকৃতিক পরিবেশ নেই। সিটি কর্পোরেশনের চুক্তির বাইরে গিয়ে কিংবা ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থ করে শুধুমাত্র বাণিজ্যিক চিন্তা ভাবনায় এই কাজ করতে দেয়া যায় না।

“এ বিষয়ে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের প্রকৌশলী ও সিসিসির সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা চুক্তি অনুযায়ী কাজ সম্পাদনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। উভয়পক্ষ যতক্ষণ সিদ্ধান্তে উপণীত হতে পারবেন না, ততদিন এই অবৈধ দোকান বন্ধ থাকবে। অন্যথায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।”

যা আছে চুক্তিতে

বিপ্লব উদ্যানের সৌন্দর্য বর্ধনে ঢাকার রিফর্ম লিমিটেড এবং চট্টগ্রামের স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেড নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের সময়ে চুক্তি করা হয়।

বিপ্লব উদ্যান ও এর চারপাশের ফুটপাতসহ আনুমানিক এক একর জমি এই প্রতিষ্ঠান দুটিকে বরাদ্দ দেওয়া হয়।  

আধুনিকায়নের মাধ্যমে ‘সৌন্দর্য বর্ধন এবং জনসাধারণের সুযোগ সুবিধা ও সেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে’ ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর থেকে কার্যকর হওয়া ওই চুক্তির মেয়াদ ২০ বছর।  

চুক্তিতে উল্লেখ আছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কোনো রকম ‘সৌন্দর্যহানি ছাড়া’ ডিজিটাল স্ক্রিন, যাত্রী ছাউনি, এটিএম বুথ, কিয়স্ক ইত্যাদি স্থাপন করতে পারবে।

সিসিসি ‘অনুমোদিত ডিজাইন’ অনুযায়ী উদ্যানের পূর্ব পাশে আনুমানিক ২৫টি স্টল, যাত্রী ছাউনি ও পাবলিক টয়লেট নির্মাণ করতে পারবে। পাশাপাশি ওয়াকওয়ে, ২৫টি ডিজিটাল স্ক্রিন, আলোকায়ন, ম্যুরাল, বসার স্থান, গ্লাস টাওয়ার, ফোয়ারা, স্কাল্পচার নির্মাণের কথাও চুক্তিতে উল্লেখ আছে।

চুক্তি অনুসারে যাত্রী ছাউনি ও স্টল বিক্রি, বরাদ্দ ও ভাড়া থেকে পাওয়া টাকা দিয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনা ব্যয় নির্বাহ করবে।

যেহেতু রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহ করবে তাই সিটি করপোরেশনকে বছরে মাত্র এক লাখ টাকা কর বাবদ দেবে প্রতিষ্ঠান দু’টি। এছাড়া ডিজিটাল স্ক্রিনগুলোর জন্য সরকার নির্ধারিত হারে কর দিবে।

চুক্তির শর্ত অনুসারে, জাতীয়-আন্তর্জাতিক প্রয়োজনে বা রাস্তা সম্প্রসারণ বা বিশেষ কোনো প্রয়োজনে ওই চুক্তি বাতিল করতে হলে প্রকল্পের প্রাক্কলিত ব্যয়ের ৫০ শতাংশ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে দিতে হবে বলেও চুক্তিতে উল্লেখ আছে।

সিসিসির পক্ষে চুক্তি স্বাক্ষরকারী প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডিজাইনে দ্বিতল ভবন করার কোনো বিষয় ছিল না। একতলা ছিল। তারা দ্বিতল ভবন নির্মাণ করেছে। দোকানগুলো ১৫০ বর্গফুটের পরিবর্তে ২০০ বর্গফুট করা হয়েছে।

“কী কী ব্যত্যয় ঘটেছে তা দেখতে একটি কমিটি করা হবে। আপাতত প্রশাসক মহোদয় দোকানগুলো বন্ধ রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন। আগামীকাল থেকে সেগুলো বন্ধ রাখা হবে। মোট ২৫টি দোকান করার কথা ছিল। এর বেশিও থাকতে পারে, যাচাই করে দেখা হবে।”

তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী স্টাইল লিভিং আর্কিটেক্টস লিমিটেডের চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান দাবি করেছেন শর্তের কোনো ব্যত্যয় ঘটানো হয়নি।

“চুক্তিপত্র আছে। (ভবন) একতলা বা দুইতলা তা উল্লেখ ছিল না। চলাচলের পথ রাখার জন্য ড্রেনের উপর স্ল্যাব বসিয়ে ৩০ ফুট চওড়া ওয়াকওয়ে করা হয়েছে। অবকাঠামোর উপরও সবুজায়ন করা হচ্ছে লতা দিয়ে। একটি গাছও কাটা হয়নি বরং নতুন করে সবুজায়ন হয়েছে।”

তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা, ২৬ মার্চসহ সব ঐতিহাসিক আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে ‘বিজয় টাওয়ার’ এর কাজ হচ্ছে। নিরাপত্তার জন্য সিসিটিভি, সাউন্ড কন্ট্রোল সিস্টেম ও পুলিশ বক্স করা হয়েছে, যা চুক্তিতে ছিল না।

বিপ্লব উদ্যানের দোকানের সামনে এভাবে ক্রেতাদের বসার জন্য স্থায়ী আসন নির্মাণ করা হয়েছে যা চুক্তিতে ছিল না।

“প্রকৃতি রক্ষা ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবকাঠামো সব এক পাশে আনা হয়েছে, যাতে ওপেন স্পেস বেশি থাকে। উনারা (সিসিসি) চূড়ান্ত প্ল্যান সাবমিশন নেয়নি। সব মৌখিকভাবে ছিল। আগের মেয়রও সম্মতি দিয়েছেন। তারা কেন ড্রইং দিল না, সেটা তাদের সমস্যা।

“ইতিমধ্যে সাত কোটি টাকা খরচ হয়েছে। করোনার কারণে চার মাস বন্ধ ছিল। এখন দোকান বন্ধের বিষয়টি করপোরেশনের সাথে আলাপ করব।”

তিনি বলেন, “আরবান ফুড প্লাজা স্টাইলে করার চেষ্টা করেছি, যাতে মানুষের ক্ষতি না হয়। অন্যায় কিছু করে থাকলে সেটা সরিয়ে নেব।”

এই চুক্তির ফলে সিসিসি লাভবান হয়েছে দাবি করে মিজানুর রহমান বলেন, “আগে তাদের ১২ জন লোক কাজ করত। বিদ্যুৎ ও আলোর বিল দিতে হত। এক টাকাও খরচ না করে তারা বছরে এক লাখ টাকা পাবে। চুক্তি পাঁচ বছর পরপর নবায়নযোগ্য।”

সাবেক মেয়র নাছিরের সময়ে করা ৪২টি ‘সৌন্দর্য বর্ধন চুক্তি যাচাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে তিন সদস্যের কমিটি করেছেন প্রশাসক সুজন।

সিসিসির আইন শাখার পর্যালোচনা প্রতিবেদনে অনিয়মের মাধ্যমে এসব চুক্তি সম্পাদনের বিষয়টি উঠে এসেছে।