সৌন্দর্য বর্ধনে ‘অনিয়মে’র স্থাপনা, সরানোর ঘোষণা সুজনের

বন্দর নগরীতে সৌন্দর্য বর্ধনে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (সিসিসি) করা চুক্তি পর্যালোচনা করে অনিয়মের প্রমাণ পেয়েছে আইন শাখা।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরী চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2020, 01:27 PM
Updated : 20 August 2020, 01:27 PM

পাশাপাশি চুক্তির শর্ত ভেঙে নকশা বহির্ভূত স্থাপনা ও চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী স্থাপনার ক্ষেত্রে নোটিস দিয়ে এবং যাচাই শেষে চুক্তি বাতিলের সুপারিশও করা হয়েছে।

এই পর্যালোচনা প্রতিবেদনটি সিসিসি’র প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজনকে দেওয়া হয়েছে।

সুজন বলছেন, ফুটপাতে মানুষের চলাচলের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী কোনো স্থাপনা রাখা হবে না। সেগুলো যদি আইনগতভাবেও বরাদ্দ দেওয়া হয় সেক্ষেত্রেও ‘প্রয়োজনীয়’ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। 

নতুন প্রশাসক সুজনের নির্দেশে সৌন্দর্য বর্ধনে ৪২টি চুক্তিপত্র পর্যালোচনা করে সিসিসি’র আইন শাখা। পর্যালোচনা শেষে বুধবার এ সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়।

সিসিসির আইন কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা একটি প্রতিবেদন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে জমা দিয়েছি। এ বিষয়ে এখন কিছু বলতে চাই না।”

প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সামসুদ্দোহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ফাইলটি প্রশাসকের কাছে পাঠানো হয়েছে। যাচাই বাছাই শেষে করণীয় চূড়ান্ত করা হবে।”

সাবেক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীনের মেয়াদে নগরীরে বিভিন্ন এলাকায় সৌন্দর্য বর্ধনের জন্য বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৪২টি চুক্তি করে সিসিসি।

এসব চুক্তির পর প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কয়েকটি ফুটপাতে দোকান, নালার উপর অ্যাকুরিয়াম, যাত্রী ছাউনিতে স্টল, এটিএম বুথ, ফুটপাতে খাবার ও ওষুধের দোকান, ফুটব্রিজে স্টল, গাড়ি পার্কিং এর স্থানে দোকান, গণশৌচাগার ও ডিজিটাল স্ক্রিন স্থাপন করে।

রাজনৈতিক পরিচয়ে আওয়ামী লীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীদের প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থা, ওয়ার্ড কাউন্সিলরদের পরিবারের সদস্যদের প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমকর্মীর প্রতিষ্ঠান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এসব সৌন্দর্য বর্ধনের কাজ পায় বলে অভিযোগ রয়েছে।

সড়ক বিভাজকে সৌন্দর্য বর্ধনের আওতায় সবুজায়নের মাঝে বিভিন্ন সংস্থার পণ্যের বিজ্ঞাপন ডিজিটাল সাইন স্থাপন করতেও দেখা গেছে।

পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব চুক্তির মধ্যে ২৫টির ক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনকে বার্ষিক নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি পরিশোধের শর্ত রয়েছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯টি ক্ষেত্রে চুক্তির আওতায় ফুড স্টল, কুলিং কর্নার, গণ শৌচাগার ও এটিএম বুথ স্থাপনে অবকাঠামো নির্মাণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

তবে ২২টি চুক্তি সাধারণ সৌন্দর্য বর্ধন সম্পর্কিত উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, এসব ক্ষেত্রে চুক্তিপত্রে স্থায়ী প্রকৃতির অবকাঠামো বা স্থাপনা তৈরির কোনো বিষয় নেই।

বরাদ্দ দেওয়া এসব ফুটপাত, গোলচত্বর, সড়ক বিভাজক ও ফুট ওভার ব্রিজের মালিকানা সিটি করপোরেশনের।  

যেভাবে চুক্তি

আইন শাখার পর্যালোচনায় বলা হয়, ৪২টি চুক্তিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে এসব চুক্তির ক্ষেত্রে এস্টেট (ভূ-সম্পত্তি) শাখা হতে কোনো নথি খোলা হয়নি।

নগর পরিকল্পনা শাখার মাধ্যমে চুক্তি সম্পাদিত হলেও তাদেরকে এ সংক্রান্ত প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছে মর্মে কোনো রেজুলেশন পাওয়া যায়নি।

‘ভূ-সম্পত্তি সংক্রান্ত বিষয়াদি এস্টেট শাখার এখতিয়ারাধীন হওয়ায় চুক্তিপত্র অনুমোদন ও সম্পাদন প্রক্রিয়াটি এস্টেট শাখার মাধ্যমে হওয়া বাঞ্ছনীয় ছিল’ বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।

স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) আইন ২০০৯ এর ৫৯ ধারা অনুসারে করপোরেশনের পক্ষে সম্পাদিত সব চুক্তি সভায় অনুমোদনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও এসব ক্ষেত্রে তার ব্যত্যয় ঘটেছে বলে পর্যালোচনা প্রতিবেদনে বলা হয়।

জানতে চাইলে সিসিসি’র প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ একেএম রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, এগুলো জিএম (সাধারণ সভা) এর বিষয় না। সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেমন এস্টেট, নগর পরিকল্পনা, প্রকৌশল, রাজস্বসহ যখন যাদের সম্পৃক্ততা ছিল তাদের নিয়ে মেয়র (সাবেক) মহোদয়ের নেতৃত্বে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

“পাওয়ার পয়েন্ট প্রেজেন্টেশন দেখে যে প্রস্তাবনা আকর্ষণীয় মনে হয়েছে, সেভাবে নির্বাচন করা হয়েছে।”

সৌন্দর্য বর্ধনের এসব প্রকল্প ‘প্রশংসিত’ দাবি করে রেজাউল বলেন, যে কোনো কাজের শুরুতে কিছু সমস্যা হয়। চুক্তি লঙ্ঘনের যে বিষয় আছে তা পর্যালোচনা করা হবে।

“প্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের পয়সায় সৌন্দর্য বর্ধন করেছে। তাদের উপার্জনের জন্য কুলিং কর্নার, যাত্রী ছাউনি, এটিএম বুথ করতে দিয়েছিলাম। কিছু জায়গায় তারা নকশা মানেনি। সেগুলোর বিষয়ে এখন ব্যবস্থা নিচ্ছি। যেগুলো কথা দিয়ে সম্ভব সেগুলো কথায়, আর না হলে উচ্ছেদ করছি।”

সিসিসি প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জমির মালিক এস্টেট শাখা। তাদের অজান্তে এটা কেন হবে?

“ফুটপাতে কোনো অবৈধ স্থাপনা সহ্য করা হবে না। আইনিভাবেও যদি দিয়ে থাকে সেটার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ফুটপাতে নগরবাসীর চলাচলে কোনো বাধা থাকতে দেব না।”

এসব চুক্তির বাইরেও নগরীতে ‘বিজ্ঞাপনী স্বার্থে’ নানা কাজ হয়েছে দাবি করে সাবেক মেয়র নাছিরেরই দলের নেতা সুজন বলেন, “কোতোয়ালী আলকরণ সড়কে খুঁটি বসানো হয়েছে। খোঁজ নিয়ে দেখলাম সিসিসি’র বিদ্যুৎ বিভাগ বা পিডিবি কেউ জানে না। কারা নির্দেশ দিয়েছে? একটি বিজ্ঞাপনী প্রতিষ্ঠান ডিজিটাল সাইন বসাতে এ কাজ করেছে। সরানোর নির্দেশ দিয়েছি।”

“করপোরেশনের বাইরে থাকা দুর্নীতির বেনিফিশিয়ারিরা এসব কাজে যুক্ত,” বলেন তিনি।

 চুক্তি বাতিলের সুপারিশ

এসব চুক্তির আওতায় যেসব স্থানে স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণের কারণে জনস্বার্থ ব্যাহত হয়েছে অথবা চুক্তির শর্ত ভঙ্গ হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে চুক্তি বাতিলসহ পাঁচটি সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

পর্যালোচনা প্রতিবেদনের প্রথম সুপারিশে বলা হয়- যেসব চুক্তির কারণে স্থায়ী স্থাপনা নির্মাণ হয়েছে অথবা ফুটপাতে মানুষের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়েছে কিংবা করপোরেশনের স্বার্থ ও জনস্বার্থ বিঘ্নিত হয়েছে, এস্টেট শাখার মাধ্যমে সংশ্লিষ্টদের নোটিস দিয়ে চুক্তি বাতিল করা যেতে পারে।

নকশা বহির্ভূত কোনো কাজ বা স্থাপনা নির্মিত হলে সেসব ক্ষেত্রে প্রকৌশল বিভাগের মাধ্যমে সরেজমিন যাচাই করে চুক্তি বাতিল করা যেতে পারে বলে দ্বিতীয় সুপারিশে উল্লেখ করা হয়।

আর যেসব ক্ষেত্রে সিসিসি ও জনস্বার্থ বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই সেসব ক্ষেত্রে আলোচনার মাধ্যমে সংশোধন করে সম্পূরক চুক্তি করা, শর্তানুসারে কাজ না করলে চিঠি দেওয়া এবং নির্ধারিত ফি পরিশোধ করতে তাগাদা দেয়ার সুপারিশও করা হয় প্রতিবেদনে।

প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, চুক্তিগুলোর মধ্যে তিন ধরনের আছে। সেসব উল্লেখ করে চুক্তি বাতিলসহ বিভিন্ন সুপারিশ করেছে। পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।