পাথরঘাটায় বিস্ফোরণ: দায় কার?

চট্টগ্রামের পাথরঘাটায় সাতজনের মৃত্যুর কারণ হয়েছে যে বিস্ফোরণ; তার দায় নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে।

চট্টগ্রাম ব্যুরোউত্তম সেনগুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2019, 02:05 PM
Updated : 17 Nov 2019, 03:30 PM

ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তারা এজন্য গ্যাসলাইনে ত্রুটিকে দায়ী করছে, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পুলিশ কর্মকর্তাদের বক্তব্যও তাদের মতোই।

তবে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (কেজিডিসিএল) কর্মকর্তারা দাবি করছেন, গ্যাস লাইনে ত্রুটি থেকে ওই বিস্ফোরণ ঘটেনি।

রোববারের এই ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও সিটি করপোরেশন সমন্বিতভাবে, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশ ও কেজিডিসিএলের পক্ষ থেকে মোট তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

সকালে নগরীর পাথরঘাটা ব্রিকফিল্ড রোডে বড়ুয়া ভবনের নিচ তলায় বিস্ফোরণে মারা যান সাতজন। এদের মধ্যে ওই বাসার বাসিন্দাদের সঙ্গে পথচারীও রয়েছেন।

নিহতরা হলেন- স্কুলশিক্ষক অ্যানি বড়ুয়া (৪০), গৃহবধূ জুলেখা খানম ফারজানা (৩৩), তার দ্বিতীয় শ্রেণি পড়ুয়া সাত বছর বয়েসী শিশু আতিকুর রহমান শুভ, রিকশাচালক আব্দুল শুক্কুর (৫০), ভ্যানচালক মো. সেলিম (৪০), রঙ মিস্ত্রি নুরুল ইসলাম (৩১)। আর ৫০ বছর বয়েসী এক ব্যক্তির পরিচয় জানা যায়নি। 

বিস্ফোরণে ওই ভবনের নিচতলার দেয়াল ও সীমানা প্রাচীর ধসে রাস্তার উপর পড়লে পথচারীরাও হতাহত হন। ভবনটির পাশাপাশি উল্টো দিকের জসীম বিল্ডিংয়ের নিচতলার দোকানও বিস্ফোরণের ধাক্কায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকায় রোববার গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে নিহতদের স্বজনদের আহাজারি। ছবি: সুমন বাবু

ঘটনাস্থলে দায়িত্বরত চট্টগ্রাম ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উপসহকারী পরিচালক পূর্ণচন্দ্র মুৎসুদ্দী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বড়ুয়া বিল্ডিংয়ের নিচতলায় সীমানা প্রাচীরের পাশেই ওই বাড়ির গ্যাস রাইজার। বিস্ফোরণটি নিচতলাতেই হয়েছে।

“হয়ত রাইজারে কোনো সমস্যা ছিল, হয়ত লিকেজ থেকে গ্যাস বের হয়ে জমে গিয়েছিল। সকালে বাসায় কেউ আগুন ধরালে তাতে বিস্ফোরণ ঘটে থাকতে পারে।”

ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ সদস্যরাও কথা বলেছিলেন ফায়ার সার্ভিসের সুরে। পরে চট্টগ্রাম সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন ও জেলা প্রশাসক ইলিয়াছ হোসাইন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেও সাংবাদিকদের বলেন, গ্যাস লাইনের ত্রুটির কারণে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।

ভবনের যে ঘর বিস্ফোরণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, সে বাসার বাসিন্দা আহত সন্ধ্যা নাথ ও অর্পিতা নাথের উদ্ধৃতি দিয়ে স্বাস্থ্য দপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক হাসান শাহরিয়ার কবির চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, সকালে পূজার ঘরে ম্যাচ জ্বালানোর পরপরই এ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে বলে আহতরা জানিয়েছেন।

দুপুরে কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড মহা ব্যবস্থাপক (বিপণন) আ ন ম সালেক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্যের বিরোধিতা করে বলেন, গ্যাস লাইনের ত্রুটি থেকে কোনো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেনি।

তিনি বলেন, “গ্যাস লাইনের ত্রুটি থেকে কোনো বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটলে চুলা অক্ষত থাকতে পারে না। এখানে চুলা ছিল অক্ষত। এছাড়াও ওই বাসায় শুকাতে দেওয়া কাপড় চোপড়েও আগুন লাগেনি। গ্যাস লাইনের রাইজার অক্ষত পাওয়া গেছে।”

এ ঘটনায় কেজিডিসিএল চার সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে। মহাব্যবস্থাপক (ইঞ্জিনিয়ারিং ও সার্ভিসেস) প্রকৌশলী সারোয়ার হোসেনকে প্রধান করে করা কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- উপ-মহা ব্যবস্থাপক (কোয়ালিটি কন্ট্রোল) প্রকৌশলী আহসান হাবিব, উপ-মহাব্যবস্থাপক (বিক্রয়) প্রকৌশলী আবু জাহের উপ- মহাব্যবস্থাপক (প্লানিং) প্রকৌশলী শফিউল আলম।

তদন্ত কমিটির প্রধান সারোয়ার সন্ধ্যায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, তাদের কমিটি কাজ শুরু করে দিয়েছে।

তিনি বলেন, “যদি গ্যাস লাইনে যদি দুর্ঘটনা ঘটে, তাহলে রান্না ঘর অবশ্যই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তবে বাসাটির রান্নাঘর অক্ষত আছে। যে রুমে ঘটনা ঘটেছে, সে রুমে শুকাতে দেওয়া কাপড় এখনও আছে।”

চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকার ব্রিক ফিল্ড রোডের একটি বাড়ির নিচতলায় রোববার গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণে অন্তত সাতজনের মৃত্যু হয়েছে। ছবি: সুমন বাবু

গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে অগ্নিকাণ্ডের মাত্রা ব্যাপক হয় জানিয়ে সারোয়ার বলেন, “যদি গ্যাস লাইন থেকে দুর্ঘটনা ঘটত, তাহলে বেশ কিছুক্ষণ সময় নিয়ে আগুন জ্বলত। কিন্তু এখানে সামান্য একটু অগ্নিকাণ্ড হয়েছে।”

গ্যাস লাইনের ত্রুটিতে আগুন ব্যাপক হলেও বিস্ফোরণ শক্তিশালী হয় না বলেও দাবি করেন প্রকৌশলী সারোয়ার।

তিনি বলেন, “ভবনের দেয়ালগুলো যত দ্রুত গতিতে পার্শ্ববর্তী ভবনে আঘাত করেছে, গ্যাস বিস্ফোরণে তা এত শক্তিশালী হওয়ার কথা না।”

তাহলে কীভাবে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে- জানতে চাইলে সারোয়ার বলেন, ওই ভবনের নিচে থাকা সেফটিক ট্যাংক থেকে তা হতে পারে। তদন্ত করে তা বলা যাবে।

এদিকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারাও বিস্ফোরণের জন্য গ্যাস লাইনের ত্রুটিকে দায়ী করেন।

অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভবনের রাইজার ও পাইপ লাইন খুব পুরনো।

“পাইপ লাইন রবার দিয়ে মোড়ানোর কথা ছিল। যেহেতু পাইপ লাইন রবার দিয়ে মোড়ানো ছিল না, আমরা ধারণা করছি, পাইপ লাইনের কোনো ফুটো দিয়ে গ্যাসটা বের হয়েছে। যেহেতু পাশে দেয়াল ছিল তাই গ্যাস রুমের মধ্যে প্রবাহিত হয়েছে।

“প্রবাহিত গ্যাস ঘরের ইলেকট্রনিক্স সুইচ বোর্ডেও প্রবেশ করতে পারে এবং সেখানে স্পার্কিংয়ের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। আমরা জানতে পেরেছি, আহত একজন ঘরে দেয়াশলাই জ্বালিয়েছে। এতে আগুনের উৎস পেয়ে বিস্ফোরণ ঘটেছে।”

চট্টগ্রামের পাথরঘাটা এলাকায় রোববার একটি বাড়ির নিচতলায় গ্যাস লাইনের বিস্ফোরণে পাশের রাস্তায় থাকা একটি রিকশা দুমড়েমুচড়ে যায়। ছবি: সুমন বাবু

গ্যাস থেকে বিস্ফোরণ হলে আগুনের মাত্রা ভয়াবহ হত বলে কেজিডিসিএল কর্মকর্তাদের বক্তব্যটি তুলে ধরলে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের কর্মকর্তা তোফাজ্জল বলেন, “আমাদের কাছে ছবি আছে। যে গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ হয়েছে, সেটা ব্যবহার করতে করতে খুব পুরাতন ও সূক্ষ্ম হয়ে গেছে। আর গ্যাসের সাথে আগুনের স্পর্শ হলে আগুনের ঝলক হয়। এতে আগুন লাগার কোনো সুযোগ নেই। কারণ গ্যাসের তীব্রতা শেষ হয়ে যায়।”

তবে গ্যাস চুলা থেকে না কি লাইন থেকে গ্যাস ছড়িয়েছে, সে বিষয়টি প্রথমে শনাক্ত করা প্রয়োজন বলে মনে করেন বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল।