চট্টগ্রামে চার দিনে শিশুসহ চার খুন, গ্রেপ্তার নেই

চট্টগ্রামে চার দিনে শিশুসহ চারজন খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হয়নি কেউ। একটি হত্যাকাণ্ড প্রকাশ্যে রাস্তায় ঘটলেও আসামিরা রয়ে গেছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

উত্তম সেন গুপ্ত চট্টগ্রাম ব্যুরোবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 June 2018, 05:36 AM
Updated : 20 June 2018, 05:48 AM

গত ১২ জুন চট্টগ্রাম নগর পুলিশের দায়িত্ব নেওয়ার পরদিন নতুন কমিশনার মাহাবুবর রহমান সাংবাদিকদের কাছে দাবি করেছিলেন, নগরীর আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের চেয়ে ভালো।

তিনি বলেছিলেন, “মানুষকে ভীত করে এমন সেনসেটিভ ঘটনা যাতে না ঘটে এবং ঘটে গেলে দ্রুত উদঘাটন করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা আমার অন্যতম কাজ হবে।”

ঈদের আগে ও পরে মিলিয়ে চার দিনে পতেঙ্গা, হালিশহর, বাকলিয়া ও চকবাজার থানায় চারটি হত্যাকাণ্ড ঘটে।

ঈদের পরদিন রোববার রাতে চট্টেশ্বরী রোডের মুখে প্রকাশ্যে খুন করা হয় এম আর অনিক নামে ২৬ বছর বয়েসী এক যুবককে।

নিহত অনিকের বাবা মো. নাছির বাদী হয়ে চকবাজার থানায় ১২ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। স্থানীয়দের অভিযোগ, আসামিদের প্রায় সকলেই এলাকায় যুবলীগ, ছাত্রলীগকর্মী বলে নিজেদের পরিচয় দিত।

ঘটনার দিন পুলিশ বলেছিল, অনিকের ছোট ভাই রনিক ব্যাটারি গলিতে মোটর সাইকেল নিয়ে ঢোকার সময় হর্ন দিয়েছিল, তা নিয়ে তার সঙ্গে ব্যাটারি গলির স্থানীয় কয়েকজনের ঝগড়া হয়। ওই সময় পুলিশ গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।

নিহত এম আর অনিক

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রাতে চট্টেশ্বরী মোড়ে ব্যাটারি গলির মহিউদ্দিন তুষার ও ইমনসহ কয়েকজন জড়ো হয়। এসময় অনিক ও তার বাবা নাছির ঘটনার বিষয়টি মীমাংসা করতে গেলে তুষার ফাঁকা গুলি ছোড়েন। অন্য একজন অনিকের বুকে ছুরিকাঘাত করে।

অনিককে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

হামলাকারীরা নিজেদের যুবলীগসম্পৃক্ত বলে পরিচয় দিলেও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর গিয়াস উদ্দিনের দাবি, তারা যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত নয়। এলাকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপ করে বেড়ায়।

কোতোয়ালি থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসান মনসুরের দাবি, হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতরা আওয়ামী লীগ-যুবলীগের বিভিন্ন নেতার পাশে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তা ফেইসবুকে প্রচার করত।

চকবাজার থানার ওসি আবুল কালাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, অনিক হত্যামামলার আসামিদের ধরতে পুলিশ বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। তবে কাউকে এখনও ধরা যায়নি।

তিনি বলেন, “প্রত্যেক আসামির বাসায় অভিযান চালানো হয়েছে। তাদের পাশাপাশি স্বজনরাও বাসায় তালা লাগিয়ে পালিয়ে গেছে।”

একই দিন রাত সাড়ে ১২টার দিকে হালিশহর আর্টিলারি সড়কে বন্ধুদের নিয়ে সিনেমা দেখে ফেরার পথে খুন হন মো. সুমন নামে এক কিশোর।  

পুলিশ জানিয়েছিল, বন্ধূদের নিয়ে বিডিআর সিনেমা হল সিনেমা দেখে বাসায় ফেরার পথে একদল যুবক তাদের পথরোধ করে মোবাইল ছিনিয়ে নেয়। এসময় ধস্তাধস্তিতে সুমনসহ দুজন ছুরির আঘাতে আহত হয়।

চমেক হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে চিকিৎসক সুমনকে মৃত ঘোষণা করেন।

হালিশহর থানা

নিহত সুমনের বড় ভাই বাদী হয়ে অজ্ঞাতদের আসামি করে হালিশহর থানায় একটি মামলা করেছেন।

হালিশহর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) বদরুল কবীর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রাথমিকভাবে মনে হচ্ছে পেশাদার ছিনতাইকারীরা এই ঘটনা ঘটায়নি। হামলাকারীরা ছুরিকাঘাত করে দৌড়ে পালিয়ে গেছে।”

এখনও কেউ গ্রেপ্তার না হলেও পুলিশ কর্মকর্তা বদরুল বলেন, “আমাদের কাজ অনেক গুছিয়েছে। আশা করি দু’একদিনের মধ্যেই আসামি ধরার কোন সংবাদ দিতে পারব।”

সোমবার রাতে বাকলিয়া এলাকায় পাওনা নিয়ে বিরোধের জেরে বন্ধূর ছুরিকাঘাতে খুন হন জসীম নামে এক যুবক।

বাকলিয়া থানার ওসি প্রণব চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ঈদের আগে মোবারক জসীমকে একটি শার্ট দিয়েছিল। সোমবার সে পাওনা টাকা চাইলে জসীম তার কাছ থেকে আগের এক হাজার টাকা পাওনা থাকার কথা জানান। এই নিয়ে দুইজনের কথা কাটাকাটির জেরে মোবারক জসীমকে পেটে ছুরিকাঘাত করে।”

এই ঘটনায় এখনও মামলা না হলেও মোবারককে ধরতে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন বলে ওসি জানান।

এদিকে গত ১৫ জুন বিকালে পতেঙ্গা এলাকায় নয় মাস বয়েসী এক শিশুকে পানিতে চুবিয়ে হত্যা করে তার মার কাছ থেকে ২০ টাকা ও স্বর্ণ ছিনিয়ে নেওয়ার অভিযোগে পতেঙ্গায় থানায় একটি মামলা হয়।

পুলিশ বলছে, ঘটনাটি ‘রহস্যজনক’।

এই ঘটনায় নিহত শিশুর বাবা রিপন মিত্র বাদী হয়ে একটি মামলা করেছেন।

মামলার বরাত দিয়ে পতেঙ্গা থানার ওসি আবুল কাশেম ভূঁইয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, রিপন মিত্র তার ছয় বছর ও নয় মাস বয়েসী দুই মেয়েকে নিয়ে পতেঙ্গা সতীশ মহাজন লেইনের সাজু মহাজনের বাড়িতে থাকেন।

মামলায় বলা হয়েছে, গত ১৫ জুন রিপন তার বড় মেয়েকে নিয়ে গ্রামের বাড়ি সাতকানিয়া গিয়েছিলেন।

সেদিন বিকাল ৫টার দিকে দুই যুবক বাসায় ঢুকে রিপনের স্ত্রীকে ‘জিম্মি করে’ নয় মাস বয়েসী ছোট মেয়েটিকে বাথরুমে নিয়ে বালতির পানিতে চুবিয়ে রাখে।

সাড়ে ৫টায় দুই যুবক বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর আনুমানিক সাড়ে ৬টার দিকে প্রতিবেশীরা শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়।

ওই সময় রিপনের স্ত্রী চম্পা মিত্র তার হাতের আংটি ও বাসায় থাকা ২০ হাজার টাকা তাদের হাতে তুলে দেন বলে মামলায় বলা হয়েছে। তবে বাসায় অন্য একটি ড্রয়ারে টাকা থাকলেও তারা তা নিয়ে যায়নি।

ওসি কাশেম বলেন, রিপন যে ভবনে থাকেন তার সাথে লাগোয়া আর একটি ভবন আছে। দুই ভবন মিলে অন্তত ৪০টি ফ্ল্যাট আছে। এছাড়াও পাশে আরও কয়েকটি ভবন আছে এবং সামনে একটি খেলার মাঠ আছে। যেখানে নানা বয়েসী ছেলেরা খেলাধুলা করে।

পতেঙ্গা থানা

পুলিশ কর্মকর্তা কাশেম বলেন, “রিপন জানিয়েছেন, দুই যুবক তার বাসায় প্রবেশ করে প্রায় আধা ঘণ্টা অবস্থান করলেও কোনো চিৎকার করেনি। বিষয়টি আমাদের কাছে রহস্যজনক মনে হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “বাসার গলির মুখে একটি সিসি ক্যামেরা আছে। সেখানে শিশুটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার ছবি থাকলেও অন্য কিছু পাওয়া যায়নি। দুই যুবক বাসায় প্রবেশ করা থেকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত দেড় ঘণ্টা পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্যের একটির সঙ্গে অপরটি অসঙ্গতি মনে হচ্ছে।”

এখন রিপনের স্ত্রীর বক্তব্য শোনার অপেক্ষায় রয়েছে পুলিশ।

ওসি বলেন, “সেদিন কী ঘটেছিল, তা একমাত্র রিপনের স্ত্রী বলতে পারে। শোকাহত থাকায় থাকায় আমরা তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেনি। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা গেলে বিষয়টি পরিষ্কার হবে।”

সিএমপি কমিশনার মাহাবুবর রহমান

চারটি খুনের বিষয়ে সিএমপি কমিশনার মাহাবুবর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চারটির মধ্যে হালিশহরের (সুমন হত্যাকাণ্ড) ঘটনাটি পুলিশের জন্য হেডেক হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে এটা ভাবাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “চট্টেশ্বরী রোডের ঘটনাটি পুলিশ মীমাংসা করে দিয়েছিল। তারপরও রাতে ঘটনাটি ঘটেছে। এর সাথে জড়িতদের সবাইকে ধরা হবে। আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি কাউকে এখানে ছাড় দেওয়া হবে না।

বাকলিয়ার ঘটনাটি পাওনা আদায়ের অভ্যন্তরীণ বিরোধে হয়েছে বললেও পতেঙ্গার শিশু খুনের ঘটনাটি ‘সন্দেহজনক’ বলছেন পুলিশ কমিশনার।