‘অসাধারণ নেতা’ রোহিতের জন্য মাঠে ‘জীবন দিতে’ রাজি অশ্বিন

রাজকোট টেস্টের মাঝপথে দল ছেড়ে যাওয়া, ৪৮ ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া সব ঘটনা নিয়ে বিস্তারিত বললেন রবিচন্দ্রন অশ্বিন।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 March 2024, 02:33 AM
Updated : 13 March 2024, 02:33 AM

ইংল্যান্ডের বিপক্ষে রাজকোট টেস্টের মাঝপথে জরুরি পারিবারিক প্রয়োজনে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের দল ছেড়ে যাওয়া এবং পরে আবার ফিরে আসার সেই ঘটনার প্রায় এক মাস হতে চলল। ওই ৪৮ ঘণ্টায় ঘটে যাওয়া সব ঘটনা নিয়ে অবশেষে কথা বললেন ভারতের অভিজ্ঞ এই স্পিনার। কঠিন সময়ে পাশে থাকায় বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানালেন তিনি অধিনায়ক রোহিত শার্মার প্রতি। তার চোখে, রোহিত অনেক বড় হৃদয়ের মানুষ। 

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাজকোট টেস্টের দ্বিতীয় দিন জ্যাক ক্রলিকে আউট করে এই সংস্করণে ৫০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন অশ্বিন। ভারতের দ্বিতীয় বোলার হিসেবে এই কীর্তি গড়েন তিনি। ওই দিন রাত ১১টায় বিসিসিআই সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, জরুরি পারিবারিক প্রয়োজনে দল ছেড়ে চলে গেছেন অশ্বিন। এই টেস্টে তাকে আর পাওয়া যাবে না। 

বোর্ড বিস্তারিত কিছু না জানালেও সংবাদমাধ্যমে খবর বের হয়, অশ্বিনের মা গুরুতর অসুস্থ। চেন্নাইয়ে ফিরে মাকে দেখে নাটকীয়ভাবে ওই ম্যাচেই আবার দলের সঙ্গে যোগ দেন তিনি। তার স্ত্রী পৃথি নারায়ানান পরে সেই প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তাদের জীবনের ‘দীর্ঘতম ৪৮ ঘণ্টা।’  

ওই ঘটনা নিয়ে অবশেষে পাওয়া গেল অশ্বিনের বক্তব্য। নিজের ইউটিউব চ্যানেলে মঙ্গলবার পুরো ঘটনা তুলে ধরলেন ৩৭ বছর বয়সী ক্রিকেটার। 

"দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষ হওয়ার পর আমি (অফিসিয়াল ব্রডকাস্টারকে) সাক্ষাত্কার দিতে রাজি হই এবং মিডিয়া অঞ্চলে যাই। সবেমাত্র আমার ৫০০তম উইকেট পেয়েছি, তাই আমার স্ত্রী বা বাবার কাছ থেকে ফোন আশা করছিলাম। তা না পেয়ে কিছুটা অবাক হই। যেহেতু তখন প্রায় সন্ধ্যা ৭টা। পরে আবার ভাবলাম, তারা হয়তো সাক্ষাৎকার নিয়ে এবং অভিনন্দন বার্তার জবাব দিতে ব্যস্ত, তাই এ নিয়ে খুব একটা ভাবিনি তখন।” 

“আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পারার পর অবশেষে আমি ফোনে আমার স্ত্রীকে পেলাম। তার কণ্ঠস্বর অন্যরকম ছিল। আমি তাকে বললাম, গোছল করতে যাচ্ছি, সে আমাকে সতীর্থদের থেকে দূরে কোথাও একা যেতে বলল। সে বলল, আমার মা প্রচণ্ড মাথাব্যথার পর জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।” 

খবরটি শোনার পর অশ্বিন তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলেন না তার কী করা উচিত। প্রথম ইনিংসে ভারতের ৪৪৫ রানের জবাবে দ্বিতীয় দিন শেষ ইংল্যান্ডের রান ২ উইকেটে ২০৭। সিরিজে তখন ১-১ সমতা।   

"নিজেকে যেন শূন্য মনে হচ্ছিল, আমি কী করেছি মনে নেই, কিন্তু আমি কাঁদছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, তাকে (স্ত্রী) কী জিজ্ঞাসা করব। আমি চাইনি, কেউ আমাকে কাঁদতে দেখুক। আমি আমার ঘরে একা বসে ছিলাম, কী করব বুঝতে পারছিলাম না। একদিকে, আমি জানতাম, আমাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে, কিন্তু এটাও ভাবছিলাম, কীভাবে আমার সতীর্থদের ফেলে চলে যাব…কোচ, অধিনায়ককে কী বলব, বুঝতে পারছিলাম না। আমি একাদশের একজন, যদি বাড়ি চলে যাই তাহলে আমাদের মাত্র ১০ জন খেলোয়াড় থাকবে, যা ইংল্যান্ডকে বাড়তি সুবিধা দেবে।” 

“কিন্তু মায়ের কথাও ভাবছিলাম। ভাবছিলাম, সবশেষ কখন তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম। আমি জানতাম, আমাকে বাড়ি ফিরে তাকে দেখতে হবে, কিন্তু চিকিৎসকরা আমাদের জানিয়েছিল, কাউকে তার সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দেওয়া হবে না।” 

এমন সময়ে ড্রেসিং রুমে আসেন রোহিত ও প্রধান কোচ রাহুল দ্রাবিড়। দ্রুত অশ্বিনকে বাড়ি চলে যেতে বলেন অধিনায়ক। 

“যেহেতু আমি তাদের ফোন কল রিসিভ করছিলাম না, তাই আমার স্ত্রী নিশ্চয় রোহিত ও দ্রাবিড়কে খবরটি জানাতে ফোন করেছিল। রোহিত ভেতরে এসে আমাকে বসে থাকতে দেখে বলে, ‘কী করছো? তোমাকে এখনই যেতে হবে। ব্যাগ গুছিয়ে চলে যাও।” 

পরবর্তী চ্যালেঞ্জটি ছিল দ্রুত বাড়ি ফেরার ফ্লাইট ধরা। কিন্তু পরের দিন সকাল পর্যন্ত রাজকোট থেকে চেন্নাইয়ের কোনো ফ্লাইট ছিল না। তখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন দলের বাইরে থাকা এক ব্যাটসম্যান। 

“চেতেশ্বর পুজারাকেও অবশ্যই অনেক ধন্যবাদ জানাতে হবে, সে অনেকের সঙ্গে কথা বলে আমার জন্য একটি চার্টার্ড ফ্লাইটের ব্যবস্থা করে দেয়। আমাদের দলের ফিজিও কামলেশ জাইন একজন ভালো বন্ধু। কামলেশকে চেন্নাইয়ের ফ্লাইটে আমার সঙ্গে যেতে বলেছিল রোহিত। যদিও কামলেশ আমাদের দলের মাত্র দুইজন ফিজিওর একজন।”

“আমি কামলেশকে বললাম, ‘সমস্যা নেই, তুমি থাকো।’ কিন্তু আমি বিমানে উঠতে গিয়ে দেখি, কামলেশ ও একজন নিরাপত্তাকর্মী আগে থেকেই সেখানে আছে। শুধু তাই নয়, রোহিত বারবার কামলেশকে ফোন করছিল আমার অবস্থা জানার জন্য…আমাদের মতো স্বার্থপর সমাজে, যে অন্য কারোর ভালোর কথা চিন্তা করে, সে সত্যিই খুব ভালো মানুষ।” 

রোহিতের প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই অশ্বিনের। 

"রোহিত স্পেশাল একজন মানুষ, অসাধারণ নেতা, বড় হৃদয়ের অধিকারী। আমি নিজেই এর সাক্ষী। মাঠে তার জন্য আমি আমার জীবন দিয়ে দেব, সে এমনই একজন অধিনায়ক। এই গুণগুলোর কারণেই সে পাঁচটি আইপিএলসহ অনেক শিরোপা জিতেছি। আমি ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি, রোহিত তার ক্যারিয়ার এবং জীবনে আরও বেশি অর্জন করুক।” 

তাকে দেখার পর মায়ের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল, সেটাও জানালেন অশ্বিন। 

“আমার মা আমাকে দেখে প্রথমে অবাক হয়েছিলেন। আর এটাই আজকের ও আগের প্রজন্মের বাবা-মায়ের মধ্যে পার্থক্য। তিনি শুধু আমার জন্য সবচেয়ে যা ভালো হয়, তাই চেয়েছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন, আমি দলের সঙ্গেই থাকি। এমনকি ওই কঠিন পরিস্থিতিতেও তিনি আমাকে নিয়েই ভাবছিলেন।” 

ম্যাচের চতুর্থ দিন সকালে বিসিসিআই জানায়, এ দিনই দলের সঙ্গে যোগ দেবেন অশ্বিন। বিসিসিআই সচিব জয় শাহর সহায়তায় চেন্নাই থেকে আরেকটি চার্টার্ড ফ্লাইটে রাজকোটে ফেরেন তিনি। ওই দিন বল হাতে একটি উইকেট নিয়ে দলের জয়ে অবদান রাখেন এই অফ স্পিনার। ৪৩৪ রানে জিতে সিরিজে ২-১ ব্যবধানে এগিয়ে যায় ভারত।

ম্যাচ শেষে অশ্বিনের দায়িত্ববোধ ও পেশাদারিত্ব নিয়ে প্রশংসা করেছিলেন অধিনায়ক রোহিত। 

“টেস্টের মাঝমথে দলের সবচেয়ে অভিজ্ঞ বোলারকে হারানো কখনোই সহজ নয়। তবে সবকিছু এক পাশে সরিয়ে সবার আগে আসে পরিবার। আমরা যখন খবরটি শুনেছি, দ্বিতীয় আর কোনো চিন্তা আসেনি যে, তার মন যা চাইছে, সেটিই করা উচিত।” 

“পরিবারের পাশে থাকতে চাইছিল সে এবং সেটিই একদম ঠিক কাজ। এটাই তার জন্য ভালো হয়েছে এবং যেভাবে সে আবার ফিরে এসে দলে যোগ দিয়েছে, এটিই তুলে ধরে সে কেমন মানুষ এবং তার মানসিকতা কেমন। তাকে ফিরে পেয়ে আমরা খুশি।” 

ধারামশালায় শেষ টেস্টে ইনিংস ব্যবধানে জিতে পাঁচ ম্যাচের সিরিজ ৪-১ ব্যবধানে জিতে নেয় ভারত। ম্যাচটি ছিল অশ্বিনের শততম টেস্ট। শেষ ইনিংসে পাঁচটিসহ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়ে মাইলফলকের উপলক্ষ রাঙান তিনি।